তোমাকে দিয়েছি চিরজীবনের বর্ষা ঋতু; এখন আমার বর্ষাতে আর নেই অধিকার । তবুও জলদমন্দ্রে কাঁপে যেহেতু, চোখ ঢেকে তাই মনে করি শুধু ক্ষনিক বিকার। আকাঙ্খা ছিলো তোমাকে সাজাবে বৃষ্টিকণা...
বড় একলা এ সময়। সময়ের গায়ে মেঘের ছায়া। কি ভীষণ ঘন।
ছাইরঙা তুলির পোঁচে কে যেন সমস্ত আকাশটাকে লেপ্টে দিয়েছে। ক্ষনে ক্ষনে আরও ঘনীভূত হচ্ছে তার ব্যাপ্তি। থমকে থমকে মেঘের নিনাদ সেই অমোঘ ধূসরতায় আলাদা ছন্দ দিয়ে যাচ্ছে। মেঘের কি অসীম আকর্ষণী ক্ষমতা। কি মায়াময় আবেশে জড়িয়ে ফেলছে মন।
এই মাতোয়ালা মেঘ আমার একলা সময়ে আচ্ছন্ন করে ফেলে আমায়।
এই যে এখন আমি আমার পৃথিবীতে একা...এক্কেবারে একা,আমাকে ঘিরে নেমে আসছে একটা চোরা বৃষ্টি-কবেকার একটা চোরা বৃষ্টি। তমাল হয়ত তার ডেলিগেশন মিটিংয়ে ব্যস্ত,কিংবা ঝুঁকে পড়েছে কোন ফাইলের ওপর। আমাদের একমাত্র মেয়ে,প্রমা,সে-ও স্কুলে হয়ত গভীর মনযোগের সাথে ক্লাস নোটস নিচ্ছে। সকলেই কত ব্যস্ত।
এদের বিদায় দিয়ে আমিও নিজেকে ব্যস্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি গার্হস্থ্যের টুকিটাকি কাজে। তবুও অগাধ শূন্যতা ছড়িয়ে থাকে ঘরময়। আমার সময় কাটতে চায় না। আমার ভরভরন্ত সংসার। অথচ এই একাকীত্বটুকু আমার টুটি চেপে ধরে।
দমবন্ধ হয়ে আসে। তখন আমি মুক্তি খুঁজি অসীমের কাছে,অজানার কাছে। কেউ আসেনা। কোথাও কেউ দাঁড়িয়ে নেই। চারদিকে শূন্যতার অপার দেওয়াল।
প্রাত্যহিকের মত আজও যখন সবে আয়োজন করছি এই একাকীত্বের প্রহরটুকু আমার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার,তখনই আমার চোখ বেধে নিলো ঐ বেপরোয়া ছাই রঙা আকাশ। একটা ভবঘুরে মেঘ ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলল গোটা আকাশটাই।
'ভবঘুরে মেঘ'...অনেকদিন পর শব্দটা কোন পাহারের খাঁজে খাঁজে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। প্রায় ১২ বছর পর। শুভ্রও তো এই ভবঘুরে মেঘ হতে চেয়েছিলো।
তখন আমি বি.মিউজিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। খুব একটা মিশুকে ছিলাম না। ক্লাসের পর কোন কোন দিন মিতা,সুতপা,অদিতিদের সাথে ক্যান্টিনে কিছুক্ষণ বসতাম। এরকমই একদিন একটা লম্বা,ছিপছিপে সবুজ পাঞ্জাবি আর জিন্স পড়া ছেলে এসে ঠিক আমাদের পেছনের টেবিলে গলা ছেরে গাইতে শুরু করলো-
এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে। ।
ক্যান্টিনের সেই কোলাহলের মধ্যেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম সেই উদাত্ত কণ্ঠের গান। সেই প্রথম ওর সাথে দেখা। এরপর একদিন ঝিলপারে পড়ন্ত বিকেলে সকলের মাঝে ওকে অনুরোধ করা হলো গান শোনানর জন্য। ও বলল,এখানে এত ভালো ভালো সঙ্গীত শিল্পীর মাঝে হেরে গলায় কিছুতেই গান শোনাতে পারবে না। বরং আসরের নতুন সদস্য গান শোনাবে।
সেইজন যে আমিই ছিলাম,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি অপ্রস্তুতের মত বললাম-আমি!?
জি হ্যাঁ আপনি। সেদিন ক্যান্টিনে আমার গানের সাথে যে গুনগুন করে তাল মেলাচ্ছিলেন। সেটা কিন্তু আমার কান এড়িয়ে যায়নি।
এর মধ্যেই কে যেন বলে উঠলো-"আরে!ও-তো মিউজিক ডিপার্টমেন্টেরই।
"ব্যাস। সকলের নাছোড়বান্দা
পিড়াপিড়িতে আমাকে রাজি হতেই হলো। তবে শর্ত দিলাম যদি শুভ্রও আমার সাথে গায় তবেই গাইবো।
শুনে ও বলল-"কাটাকুটি করতে চাইছেন?বেশ। তাই হোক।
"আমরা একসাথে গাইলাম-
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে !
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে !
এভাবেই ওর সাথে পরিচয় হলো। ও তখন এম.এ. প্রথম বর্ষের ছাত্র। একেবারে আমার উল্টো চরিত্রের। সারাক্ষণ হাসি,ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতো সকলকে। আর খুব সহজে সকলের সাথে মিশে যেতে পারতো।
আমরাও খুব সহজে বন্ধু হয়ে গেলাম। বন্ধু?নাকি ওর ওই অগাধ ব্যক্তিত্বের কাছে আমি আরও বেশি কিছু চেয়েছিলাম?সেই গভীরতা মাপার ক্ষমতা আমার ছিলো না। আমি বড় তুচ্ছ ছিলাম ওর ব্যক্তিত্বের সামনে।
ধীরে ধীরে আমি ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে পড়ছিলাম নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে। অথচ প্রকাশের কোন ভাষা জানতাম না।
যেটুকু সময় ওকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম,সেটুকু অপ্রতুল মনে হতো। আমার মননের সমস্তটুকু জুড়েই যে শুধু শুভ্র। বড় অসহ্য লাগতো রাত। বড় দীর্ঘ লাগতো তার ব্যাপ্তি। তুমি কি কিছুই বোঝ না?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকো?-এইসব প্রশ্ন দিনরাত আমাকে ভেঙেচুরে তছনছ করতো।
অথচ শুভ্রই আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতো,আমাকে আমার মতো করে। ঠিক যখনটি চাইতাম ওকে পাশে পেয়ে যেতাম। আমার মনখারাপ নিমেষেই দূর করে দিত। আমার ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে আরও পূর্ণতায় ভরিয়ে দিতো। তাই বোধহয় আমার ভেতরটাও দেখতে পেতো।
এমনই এক সময় আমার হাতে ও একটা সাদা কাগজ গুঁজে দিয়ে মুহূর্তে রাস্তার ভিড়ে হারিয়ে গ্যালো। আমি কাগজের ভাঁজ খুললাম। তাতে লেখা ছিলো-
এই পথটুকু বহুদূর চলে গ্যাছে।
চলে গ্যাছে সীমাবদ্ধ দৃষ্টির বহুদূরে।
তোমার কাছে গচ্ছিত রাখা যা কিছু আমার সঞ্চয়,
একদিন উড়িয়ে দিও তোমারই খেয়ালীতে,উদাসী হাওয়ায়।
ফিরে পাই ,না পাই।
কিছু কিছু থেকে যায় বৃত্তের বাইরে।
তুমি ঠিক বলেছিলে শুভ্র। তুমিতো তোমার বৃত্তের সীমা লঙ্ঘন করোনি। আমিই পা বাড়িয়েছিলাম আমার গন্ডিরেখার বাইরে।
সীমানার বাইরের তুমিতো চির-অধরা।
শেষবার যখন ফ্যাকাল্টি এক্সকারসনে আমরা শান্তিনিকেতন গেলাম,সেদিনও খোয়াই-এর তীরে এরকম একটা গাঢ় আকাশ নেমে এসেছিলো। সেদিন সবার দৃষ্টির অগোচরে তোমাকে একলা পেয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি। নিজের মনের জমা মেঘগুলোও সেদিন ঝরে যেতে চেয়েছিলো।
আমি যে তোমায় ভালবাসি শুভ্র।
ভুল করো তৃণা। তোমার ভালবাসার প্রতিদান আমি দিতে পারবো না। শুধু কষ্টই পাবে।
পাই কষ্ট। তবু তোমাকেই ভালবাসবো।
তুমি শুধু আমার।
ছেলেমানুষি করোনা তৃণা। আমি একটা ভবঘুরে মেঘ,যার কোন স্থায়িত্ব নেই,স্থিতি নেই। আমি কারও নই। কেউ আমার নয়।
আমাকে পেয়ে তুমি সুখী হবে না।
সুখ!তুমিই আমার সুখ। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না।
না তৃণা। এটা তোমার মোহ।
একদিন ঠিক ভেঙে যাবে। ওইযে বললাম আমি একটা ভবঘুরে মেঘ। আমার কোন বন্ধন নেই। কোন বন্ধনে জড়াতে চাই না। এমন কেউ তোমার জীবনে আসুক যে সত্যিই তোমাকে সুখী করবে তৃণা।
খুব সুখী হবে তুমি।
হ্যাঁ শুভ্র,আজ আমি সত্যিই সুখী। সুখ উছলে পড়ছে আমার জীবন প্রবাহিণীতে। এতটা সুখ বোধহয় চাইনি আমি। এতটা সুখী না হলেও পারতাম।
সুখের মোড়কে থাকা একাকীত্বের নির্বাসনে এই দ্যাখো...এই দ্যাখো কত সুখে আছি আমি।
বৃত্তের বাইরে থেকেও আমার চোখে ভবঘুরে মেঘেরা জড়ো হয়ে আসে। এভাবে চলে যাওয়ার আগে একবার আমাকেও বলে যেতে পারতে ভবঘুরে মেঘের ঠিকানা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।