জীবিত মানুষ হতে চাই। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই হাসান সাহেব বিরক্ত বোধ করেন। বিরক্তির কারণ তার একমাত্র ছেলে অনিক। সন্ধ্যায় বাসার কলিংবেল চাপলে ছেলেটাই প্রতিদিন দরজা খুলে দেয়। এ সময় তার এক হাতে থাকে টিভির রিমোট আর আরেক হাতে মোবাইল ফোন।
টিভিতে হয় খেলা অথবা কোন মুভি চলে। আর মোবাইল হাতে সারাদিন কি করে তা এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি তিনি। জিজ্ঞেস করলে বলে ইন্টারনেট চালায়। কিন্তু তার জন্যে বাসায় কম্পিউটার আছে। অনেক চাপাচাপির ফলে তাতে ব্রডব্যান্ডের কানকশনও লাগিয়েছেন।
একথা বললে ছেলে আর কিছু বলে না। ভুঁরু কুঁচকায়। তার বিরক্তি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন হাসান সাহেব। অথচ ছেলের এ নিয়ে কোন বিকার নেই। অন্তত লুকিয়ে রাখলেও পারত।
এতে বাবা মনে কষ্ট পায় ব্যাপারটা সে বুঝে কিনা তিনি তা জানেন না। না বুঝার কথা না। ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এইটুকু বুঝার কথা অবশ্যই। সে প্রতিদিন ক্লাসে যায় কি না তা নিয়েও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন।
কারণ প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাকে ঘুমে দেখে যান আর অফিস থেকে ফিরে দেখেন টিভির সামনে। এক আধ দিন যে ছেলে রাত করে বাড়ি ফিরে না তা না। তবে তা খুব কমই। এই বয়সের ছেলেপেলে বন্ধু বান্ধবদের আড্ডা শেষে প্রতিদিনই দশটার পরে বাসায় ফেরার কথা। এমনটাই স্বাভাবিক।
সে ক্লাসে যায় কিনা তা তিনি প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন। মাঝে মাঝে উত্তর দেয় যায় না। বেশিরভাগ সময়েই বলে যায়। সেই উত্তরে অস্বস্তি মেশানো থাকে। তিনি ধরতে পারলেও চুপ করে থাকেন।
ছেলেকে ঘাঁটাতে তার ভালো লাগে না। ছেলে চলুক তার নিজের মত। তবু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সারাদিনই চিন্তায় থাকেন তিনি।
ইউনিভার্সিটির ক্লাসের ব্যাপারে বাবার সাথে প্রতিদিনই মিথ্যে বলতে হয় অনিকের। এটা তার ভালো লাগে না।
সে চায় বাবা যেন এ নিয়ে তাকে কোন প্রশ্ন না করে। কিন্তু মুখে বলতে পারে না। ক্লাসে যাবার দরকার কি তার?নোটপত্র যা কিছু আছে সব পরীক্ষার আগে সংগ্রহ করে পড়ে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আর উপস্থিতিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য বন্ধুরা তো আছেই। তার আর চিন্তা কি?চিন্তা অবশ্য সে করেও না।
তার এখন সকল চিন্তা পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনে লেখালেখি নিয়ে। ব্লগ আর ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেসব তর্ক চলে সেসবে যোগ দিতে তার বড় ভালো লাগে। সেই তর্কের খাতিরে বিভিন্ন বিষয় জানতে হয়। তার জন্য ইন্টারনেটে সারাদিন পড়ে থাকে সে। আর রাত জেগে মুভি দেখে অথবা গল্প উপন্যাসের ই-বুক পড়ে সময় কাটায়।
ইদানিং অবশ্য তার ব্যাস্ততা কিছুটা কমে এসেছে। অনেকদিন ধরে একটা প্ল্যান নিয়ে ভাবছিল সে। সেটার দিন ঘনিয়ে আসছে। পরিকল্পনায় শেষ মূহুর্তের কাটাকাটি চলছে।
সেলিনা বেগম ঘোর সংসারী মানুষ।
বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন চাকরি করলেও অনিকের জন্মের পরে চাকরি ছেড়ে দেন। ছেলেকে ভালোমতো মানুষ করাই তখন ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। সেই অনিক আজ বড় হয়েছে। মানুষ হয়েছে কিনা তিনি তা জানেন না। কারণ বড় হবার সাথে সাথে মার সাথে একটা দুরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে সে।
একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কোথাও যেতে চায় না। বাসায় কোন মেহমান আসলেও সে নিজের ঘর থেকে বের হতে চায় না। বড়জোড় দেখা করেই চলে আসে নিজের ঘরে। আর সারাদিনই হয় কম্পিউটার,টিভি অথবা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে।
মায়ের সাথে কথা বলার সময় নেই তার। কয়েকদিন হল ঠিকমত ইউনিভার্সিটিতেও যায় না। সারারাত জেগে থাকে আর দিনের বেলা পড় ঘুমায়। তার বাবা অফিস থেকে ফিরে ভার্সিটির কথা জিজ্ঞেস করলে সে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে। তাকে জিজ্ঞেস করলেও ছেলের খাতিরে নিজেও মিথ্যা করেই বলেন ছেলে ক্লাসে গিয়েছিল।
বিকেলে ফিরে এসেছে। ছেলের বাবা ঠিক আশ্বস্ত হয় না। তিনি বুঝতে পারেন এটা ঠিক হচ্ছে না। তবুও সংসারে ঝামেলা এড়িয়ে চলতে তাকে অন্য আরো কিছুর মত এই ব্যাপারটাও সবসময় চেপে যেতে হয়। এত বছরের সংসারে ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য খুব বেশি একটা না হলেও এসব তিনি অপছন্দ করেন।
এই বয়সে এসে এসব আর ভালো লাগারও কথা না।
মাঝরাতে হঠাত ঘুম ভেঙে গেল সেলিনা বেগমের। এমনটা গত কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। পরে অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খাবার পরে ফজরের আজানের আগে আগে ঘুম আসে। একারণে কয়েকদিন হল ফজরের নামাজ কাযা পড়তে হচ্ছে।
তিনি বুঝতে পারেন বয়স হয়ে যাচ্ছে। স্বামীর ঘুম যাতে না ভেঙে তাই আস্তে করে বিছানা থেকে নামেন তিনি। অনিক ঘুমিয়েছে কিনা জানার জন্য তার ঘরের দিকে পা বাড়ান। দরজা সামান্য একটু ভেজানো ছিল। সেখান দিয়ে বাইরে আলো আসছে।
তার মানে অনিক এখনো জেগে আছে। তিনি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। অনিক রুমে নেই। বারান্দা থেকে কথার আওয়াজ আসছে। ফোনে কথা বলছে কারো সাথে।
তার খুব জানতে ইচ্ছা করে ছেলে কার সাথে রাত জেগে কথা বলে। কোন মেয়ের সাথে কি প্রেম করে সে?মেয়েটি দেখতে কেমন হবে?এসব ভাবেন তিনি। কয়েকবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফোনে সে কার সাথে এত কথা বলে। অনিক উত্তর দেয়না। বলে তোমার জানার দরকার কি?তিনি দ্বিতীয়বার আর কিছু জিজ্ঞেস করেন না।
অনিকের কম্পিউটারটা খোলা আছে। টেবিলে ধুলা জমেছে অনেক। তিনি একটা ন্যাকড়া নিয়ে টেবিল মুছতে শুরু করেন। হঠাত তার চোখ পড়ে কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে। অনিকের একটা হাসোজ্জ্বল ছবির পাশে তার নাম লেখা।
এর নিচে কিছু লিখা রয়েছে। তিনি পড়তে শুরু করেন। "...যাক,অবশেষে সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললাম। আগামি সপ্তাহে বাবা মায়ের ২৫তম বিবাহবার্ষিকীতে একটি সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পন্ন। বন্ধুরা আমার জন্য দোয়া করো যেন বাব মা কে ভালো একটা সারপ্রাইজ দিতে পারি।
আই লাভ মাই প্যারেন্টস সো মাচ। "
সেলিনা বেগমের মনে পড়ে ১৩ই এপ্রিল তাদের বিবাহবার্ষিকী। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আশ্চর্য লাগে তার কাছে। ২৫ বছর কেটে গেছে!তবে ছেলে যে দিনটা মনে রেখেছে তা দেখে কিছুটা চমত্কৃতই হলেন।
এতকিছু করার প্ল্যান করে রেখেছে অথচ কাউকে কিছু বুঝতেই দেয় নি। অথচ গোপনে মা বাবার জন্য কত গভীর মমতাই না পুষে রেখেছে নিজের মধ্য। খুব পরিতৃপ্তি বোধ করলেন তিনি। অবশ্য তার একটু মন খারাপও হল। তিনি যেহেতু ব্যাপারটা জেনে ফেলেছেন সেহেতু সেটা আর সারপ্রাইজ থাকছে না তার কাছে।
অবশ্য অনিক তা জানছে না। তিনি নীরবে ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। ভাবলেন স্বামীকে একথা আর বলার দরকার নেই। থাকুক,সারপ্রাইজটা তার জন্যে তোলা থাকুক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।