আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ জোকার

স্বপ্নের ডানাগুলি আর মেলা হল না বুঝি--------ওড়াতে চাইলেও যে উড়তে হয় না রাজি। এবারের প্রতিটা ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় যে ফার্স্ট হবে সেই ফার্স্টবয়কে সেই ক্লাসের যারা পরীক্ষা দেবে তাদের মাধ্যমে মেরে রক্তাক্ত করতে হবে আর যদি না করা হয় তাহলে স্কুলের অন্য পরীক্ষার্থীরা রক্তক্ত হবে। এই রক্তপাত ততদিন ঘটতে থাকবে যতদিন না ফার্স্ট হওয়া ছেলেটা রক্তাক্ত হয়। - একজন অজ্ঞাত লোক নাকি স্কুলের উপর এ হুকমি দিয়েছে। রতনপুর জেলা শহরের রতনপুর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বসিরউদ্দীন আজ সকালে এখন অ্যাসেম্বলির সময় সমস্ত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলবেন।

গতকাল রাতে কথাগুলো যে কয়জন ছাত্রকে বলা সম্ভব হয়ে তিনি বলেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় এই অজ্ঞাত লোকের গুজবটা শুনে যতটা না বেশি আশ্চর্য হয়েছেন তারথেকে বেশি আশ্চর্য হয়েছেন স্কুলের ছাত্ররা গুজবটা বিশ্বাস করেছে দেখে। তবে গুজবটা যে ভয়াবহ এক্ষেত্রে সন্দেহ নেই। বসিরউদ্দীন বললেন, আমার স্কুলের প্রিয় ছাত্ররা, স্কুলের পরীক্ষা বন্ধ করতে কেউ একজন একটা গুজব ছড়িয়েছে। তোমাদের সবার উচিত এই গুজবে কান না দিয়ে মন দিয়ে পড়াশুনা করা।

আর যদি এ গুজবটা তোমরা বিশ্বাস কর তাহলে যে পাগলটা এটা ছড়িয়েছে সে আরও উৎসাহ পেয়ে আরও গুজব ছড়াতে শুরু করবে। তাই মন দিয়ে পড়াশুনা কর আর চিন্তা কর যে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে প্রাইজ হাতে তুমি সবার সামনে দাড়িয়ে আছ। আমি যখন তোমাদের মুখের দিকে তাকাই তখন এমনটাই আমার মনে হয়। বসিরউদ্দীন কথা শেষ করলেন। ছাত্ররা হাততালি দিল।

মনেহচ্ছে অনেকেরই মনভীতি কেটে গেছে। তবে হাততালির আওয়াজ শুনে তার নিজেকে কেমন যেন বিষন্ন লাগল। তিনি স্কুলের পিয়নকে ডেকে বললেন, ছাত্রদের মা-বাবারা সবাই জানে যে আজ দুপুরে লেইজার প্রিয়ডে অভিভাবক মিটিং ডাকা হয়েছে। - জানে স্যার। - অনেক ছাত্রের মা-বাবাই মনেহয় এখন আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।

তাদেরকে মিটিং রুমে পাঠিয়ে দাও-আমি আসছি। - জ্বি স্যার। অ্যাসেম্বলির শেষে ক্লাস এইটের বদখত ক্লাসটিচার রশিদ মল্লিক তার ক্লাসে বললেন, কি রে, তোদের নাকি কে বলছে যে ফার্স্ট হইলে সাইজ করবে। - জ্বি স্যার। - আমি হইলে উল্টাটা করতাম।

যে সবচে খারাপ তারে পিটাইয়া সিধা করব-দেখতি সব পরীক্ষার আগে এম্নিতেই সিধা হইছে। রশিদ মল্লিক খেক খেক করে হাসলেন। হঠাৎ তার টেবিলের এক কোনায় একটুকরা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি কাগজটা হাতে নিলেন। পেপারের অক্ষরগুলো কেউ কেঁচি দিয়ে কেটে স্কচ টেপ দিয়ে লাগিয়ে একটা কথা বলতে চেয়েছে।

ভ্রু কুঁচকে লেখাটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেলেন তিনি। মিটিং রুমে গিয়ে প্রধান শিক্ষক যা শুনলেন তাতে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। প্রতি ক্লাসের দশ থেকে পনেরজন অভিভাবক ঠিক করেছে তাদের ছেলেকে এবার পরীক্ষা দিতে দেবেন না যেখানে এ স্কুলে প্রতি ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা দেড়শর মত। নিচের ক্লাসে এই সংখ্যাটা আরও বেশি। বসিরউদ্দীন বললেন, আপনারা এ গুজব মেনে নিতে পারেন না।

অভিভাবকদের একজন বলল, আমরা এটা মেনে নিচ্ছি না তবে আমাদের ছেলেদের আমরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারি না। - এখানে কোন ঝুঁকি নেই। এটা শুধুই একটা গুজব। - আপনি কি করে জানেন সেটা? - এই স্কুলটা শহরের সেরা স্কুলগুলোর মধ্যে একটা। এই স্কুল নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এত সহজ নয়।

পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। এসময় এমন কথা আপনারা বলতে পারেন না। এমনসময় ক্লাস এইটের ক্লাসটিচার রশিদ মল্লিক, নাইনের হেদায়েত আলি এবং ফাইভের ক্লাসটিচার অমল মজুমদার তখন মিটিং রুমে হাজির হল। অমল মজুমদার বললেন, স্যার, আমরা সবাই আমাদের ক্লাসের টেবিলে এটা পেয়েছি। সাহেব কাগগজটা হাতে নিলেন যাতে লেখা, “ফার্স্ট হওয়া ছাত্রকে মারো নইলে অন্যরা মরো।

” পরীক্ষার আর দুইদিন বাকি। ক্লাস নাইনের তপু ওর ক্লাসের ইন্তেজারকে বলল, কি রে, তুই না কি এবার পরীক্ষা দিবি না? ইন্তেজার বলল, হ্যাঁ দোস্ত, এবার মনেহয় আর দেওয়া হবে না। - কি বলিস তুই! তোর মত ভাল স্টুডেন্ট পরীক্ষা দিবি না ভাবতেই অবাক লাগছে। - জানের মায়া বড় মায়া দোস্ত। আমার তো মনে হয় তোরও দেওয়া উচিত না।

- আমার আর খেয়ে পড়ে কাজ নাই পরীক্ষা না দিয়া নাইনেই পইরা থাকি! একটা ফালতু গুজবের ভয়ে পরীক্ষা দিব না-তা কি করে হয়। - সবাই কিন্তু ব্যাপারটাকে ফালতু বলতেছে না। অনেকেই সিরিয়াসলি নিচ্ছে। - ওইটা তাদের ব্যাপার। আমার কি আসে যায়! তুই পারলে পরীক্ষাটা দে।

- দেখি। তপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কর তোর যা ইচ্ছা। অবশেষে স্কুলে আজকে রেজাল্ট দিল। প্রধান শিক্ষক বসির উদ্দীন সাহেব ক্লাসের ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্টদের হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন। ওদের হাসিমুখের মাঝে কোন ভয়ের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে কি? মনে তো হচ্ছে না।

এবারের পরীক্ষাটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হল-মাত্র দু সপ্তাহে। রেজাল্টও তাড়াতাড়ি বের হল। পরীক্ষার মধ্যে আর কোন চিরকুট পাওয়া যায় নি কিংবা আর কোন গুজব ছড়ায় নি। যারা গুজবটা বিশ্বাস করেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই এখন ভুল টা বুঝতে পেরেছে। যারা এবার পরীক্ষা দেয়নি তাদের জন্য বসিরউদ্দীন সাহেবের মন খারাপ হচ্ছে।

তাদেরকে কি পাস করিয়ে পরের ক্লাসে তোলা যায় না! সম্ভব নয়-তাহলে ঐ গুজব টাকে সম্মান দেওয়া হয়ে যাবে। তবে রেজাল্টের দিন বিকালে তিনি যা শুনলেন তাতে তার বলার কিছু ছিল না। স্কুলের ক্লাস নাইনের একজন ছেলেকে দুপুরের সময় কেউ একজন ছুরি দিয়ে হাত পা ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে নির্জন রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে দিয়ে গেছে। ছেলেটার পকেটে ছিল আরেকটা পেপার কাটিং করা চিরকুট যাতে লেখা, ‘যে ক্লাসের পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছাত্রদের রক্তাক্ত না করা হবে সেই ক্লাসের পরীক্ষার্থীর আরও রক্ত ঝরবে। ’ রক্তাক্ত সেই হতভাগ্য ছাত্রটির নাম মাসুদ।

ক্লাসের অনেকে যখন মাসুদকে দেখতে ওর বাসাতে গেল তখন ওরা মাসুদকে দেখে আতংকে শেষ হয়ে গেল। মাসুদের হাতে-পায়ে এমনকি শরীরেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। - মাসুদ, তোর এই অবস্থা কে করছে? মাসুদ ওর বিছানায় জড় হয়ে শুয়ে রইল। মনে হচ্ছে শরীরের কষ্টের থেকে মনের ভয় ওকে বেশি ঘিরে রাখছে। ও নিজে নিজেই কথা বলছে যেন, দুপুরে একা হাটছিলাম...তারপর একটা অচেনা মুখোশ পড়া লোক এসে মুখে রুমাল ঠেসে ধরল...যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা।

মাসুদের মনের ভয়টা যেন স্কুলের সব ছাত্রদের মাঝে ঢুকে গেল। মাসুদের বাসা থেকে ওরা আসার সময় বেলাল বলল, মাসুদের অবস্থাটা দেখলি! আজকে ভয়ে আমি ঘুমাতে পারব না। ঐ নাম না জানা লোকটা এই কাজ কেন করল কে জানে। তারেক বলল, কেন করছে এটা আমরা সবাই-ই জানি। ঐ লোকটা আমাদের ফার্স্টবয় তপনকে মাসুদের মত অবস্থা করতে বলছে আর না করলে সে আমাদের মারবে।

- কিন্তু আমরা তপনকে শুধু শুধু কেনই বা মারব। আমরা লোকটার মত টেররিস্ট নই। - তপনের কোন ক্ষতি হবে কিনা জানি না। তবে একটা কথাই বলি ঐ ফার্স্টবয়গুলো পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে পুরষ্কার পেয়ে এখন আরামেই আছে আর আমাদের এখন হয়রান হতে হচ্ছে। - তুই চিন্তা করিস না।

পুলিশ আর শহরের লোকেরা আমাদের কিছু হতে দেবে না। - সবাই আমাদের নিরাপত্তা দিতে চাইবে। কিন্তু আমাদের স্কুলের আড়াই হাজার ছাত্রদের একসাথে কে নিরাপত্তা দেবে! যেকোন সময় ঐ মুখোশ পড়া লোকটা আমাদের যে কাউকে মাসুদের মত অবস্থা করতে পারে! বেলাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে মাসুদের খবর শুনে সবথেকে ভয় পেল ঐ ছাত্ররাই যারা এবার ফার্স্ট হয়েছে। যেমনটা ফার্স্ট হয়েছে মাসুদের ক্লাসের তপন।

তপন যখন মাসুদের খবর টা শুনছিল তখন ও বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলছিল। শুনে ওর গা শিরশির করতে লাগল। এখন ওর শত্রু মুখোশ পড়া লোকটা নয়- ওর শত্রু ওর বন্ধুরাই। তপনের ক্লাসের গুন্ডামত রগচটা ছেলে জামশেদ তপনকে বলল, তপন, তুই কোন কিছু নিয়ে ভয় করিস না-আমরা আছি না! আমরা থাকতে কার কত বড় সাহস যে আমাদের ফার্স্টবয়রে মাইর দেয়। ‘আমাদের ফার্স্টবয়’ কথাটা শুনে তপন আরও ভয় পেল।

পরদিন সন্ধ্যায় কলাপাড়ায় ক্লাস সেভেনের দুর্জয় কলেজের মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ও কলেজের মাঠের পাশে ঝোপের আড়ালে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেল। সন্ধ্যার আলো প্রায় মিলিয়ে গেছে। আশেপাশে কোন লোকজন নেই। দ্বিধাগ্রস্থভাবে ও ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল।

ঝোপের আড়ালে যা দেখল তাতে ভয়ে ওর মুখ সাদা হয়ে গেল। ওদের ক্লাসের ছাত্র নীরব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। নীরবের সারা শরীর মাসুদের মতই ক্ষতবিক্ষত। ওর বুকের পকেটে মাসুদের মত আরেকটা চিরকুট। ‘ফার্স্টবয়দের মেরো না, তাহলে আমি তোমাদের আরও মারার সুযোগ পাব!...হা হা হা...’ তখন তপন ওর বাসায় ফিরছিল।

হঠাৎ ও বুঝতে পারল কেউ ওর পিছনে পিছনে আসছে। এদিকটায় সন্ধ্যার দিকে তেমন কোন লোক থাকে না। তপন বাসার প্রায় কাছে পৌছে গেছে। এ গলিটার সামনে আরেকটা গলি পড়বে সেই গলিতে এগিয়ে গেলে ডানদিকের গলিতেই ওদের বাসা। ধীরে ধীরে ও প্রথম গলিটা পার হল।

কোন একজন এখনো ওর পিছনে আসছে। ওকেই অনুসরণ করছে কি-না সেটা এখনও তপন বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে পিছনে তাকিয়ে বাসার দিকে দৌড় দিয়ে কিছু একটা করা যেতে পারে। পিছনে তাকাতে ওর খুব ভয় লাগছে তবুও জোর করে ও পিছনে তাকাল। ও কাউকে দেখলে পেল না।

ওর বুকের হৃদপিন্ডের শব্দ নিজেই যেন শুনতে পারছে এখন। তপন বাসার দিকে মুখ করে দৌড় দিল। আর তখনই যা হবার হল। সামনে থেকে এক মুখোশ পড়া ছেলে এসে জাপটে ধরে মুখ চেপে ধরল আর পিছন থেকে আরেকটা মুখোশ পড়া ছেলে এসে ছুরি চালাল ওর শরীরের নানা জায়গাতে। তারপর পালিয়ে গেল দুজনে।

মুখোশ পড়া দুজন ছেলের মধ্যে লিডার ছেলেটা ছিল জামশেদ। ওকে তো ওর ক্লাসকে আর নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে! - এই, সেভেনের নীরব আর নাইনের তপনের খবর শুনছিস? নীরবকে নাকি ঐ নাম না জানা লোকটা মাসুদের মত অবস্থা করেছে। নীরবের পকেটেও মাসুদের মত একই চিরকুট। - আর তপনকে? - তপনকে মনেহয় ওর ক্লাসের কেউ মেরেছে। তারমানে বুঝতে পারছিস? - তারমানে কি? - তারমানে নাইনের ছাত্ররা এখন পুরোপুরি নিরাপদ।

তপনকে দেখে এখন ওর ক্লাসের ছাত্ররা যতই আহা উহু করুক না কেন ওরা কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছে। ওরা এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। আমাদের মত অন্য ক্লাসের ছাত্রদেরই যত ভয়। - তুই মনেহয় ঠিকই বলছিস। ব্যাপারটাতে অবাক না হয়েও পারছি না।

আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় সবুজের খবর কি? - শালায় নাকি কালকে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। - বলিস কি! - ঠিকই বলছি। কয়েকটা ক্লাসের ফার্স্টবয় আর অন্য ছাত্ররা এখন শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। আমাদেরও মনেহয় এখন পালান উচিত। - পালাব কেন? পুলিশ কি এখন বসে বসে আঙ্গুল চুষছে? - পুলিশ তো নাকি তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ এইসব শুরু করছে।

তাতে মনেহয় না পুলিশ ঐ লোকটার কিছু করতে পারবে। - তাহলে এই শহরে বসে থেকে আমরা এখন করব কি! - বাসা থেকে খুব একটা বের হস না। - এরকম কতদিন চলবে? - জানি না। স্কুলের ছাত্র বিশেষ করে উপরের ক্লাসের ছাত্ররা এখন বাসা থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছে। কে-ই বা কাকে এখন রক্ষা করবে! স্থানীয় সাংবাদিকরা পত্রিকায় রিপোর্ট লেখা শুরু করল, পুলিশও তদন্ত চালিয়ে যেতে লাগল আরও তদন্ত করা শুরু করল মাসুদের ছোট মামা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ওয়াহিদ।

অবশেষে কয়েকদিনের তদন্তের পর ওয়াহিদ অজ্ঞাত ব্যাক্তির রহস্য বুঝতে পারল। মাসুদ রুমে শুয়ে ছিল। ওয়াহিদ মাসুদের বিছানার পাশে বসল। - মাসুদ। - জ্বি মামা।

- কেমন আছিস? - আগের থেকে ভাল মামা। - আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি? - কোন কথা? - এই কাজটা তুই কেন করলি? কাজটা করে কি লাভ হল তোর? - কোন কাজের কথা বলছ! কিছুই তো বুঝতে পারছি না। - আমার চোখের দিকে তাকা। মাসুদ ছোট মামার দিকে তাকাতেই চমকে গেল। ওর মামা সব বুঝে গেছে।

ছোট মামা ওকে ছোটবেলা থেকে ভাল করে চেনে বলেই কি এত তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলতে পারল! মামার কাছে কোনদিন কিছু লুকাতে পরেনি মাসুদ। মামা নিশ্চয়ই সব প্রমান নিয়ে কথা বলছে। মাসুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। - সবকিছু খুলে বল আমাকে। আমি জানি এ ঘটনার পিছনে শুধু তুই একা নোস-আরও অনেকেই আছে।

ঠিক? মাসুদ ধীরে ধীরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল। - কিভাবে করলি কাজগুলো? সবার আগে বল, তোরা কি করে গুজবটা ছড়ালি? মাসুদ গুজব ছড়ানোর কথাটা বলতে লাগল। মাসুদ আর ওর দলের কাছে এটা অনেক সহজ কাজ ছিল আবার অনেক কঠিন কাজও ছিল। মাসুদের দলের একজন রেসাদ প্রথমে ওর ক্লাসের রতনকে বলেছিল, রতন! এইমাত্র একজনের কাছ থেকে যা শুনলাম তা শুনে তো খুবই ভয় লাগছে। - কি শুনেছিস? - আমি শুনলাম এবারের পরীক্ষায় ফার্স্টবয়দের কপালে দুঃখ আছে...সব ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় যে ফার্স্ট হবে...খুব ভয়ংকরভাবে নিজের বানানো গুজবটা ও রতনকে বলেছিল।

রতন শুনে বলেছিল, কার কাছ থেকে শুনলি এইটা? - স্কুল শেষে বাসায় আসছিলাম তখন কলেজের একটা ছেলে বলল। ওকে নাকি আমাদের স্কুলের কে বলছে কিন্তু ব্যাপরটা মনেহয় সত্যি। স্কুলের আরও অনেকের কাছ দিয়েও একই কথা শুনলাম। - বলিস কি! - আমি মনেহয় এইবার আর পরীক্ষা দিব না রে। রেসাদের ভয় পাবার অভিনয়টা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হয়েছিল কারন রতন ওর কথাটা বিশ্বাস করেছিল।

রতনের পর মাসুদ ক্লাসের অন্য ছাত্রদেরকে একই ভাবে গুজবের কথাটা বলে। যেমনটা বলে ওর দলের অন্য ক্লাসের ছাত্ররা। দল বলতে সবমিলিয়ে ছয়জন ছাত্র। গুজবটা ছড়ানোর ব্যাপারটায় বেশ ঝুকি ছিল। গুজবটাকে বিশ্বাস করাতে রেসাদ আর ওর দলের আরেকজন পরীক্ষা দেয়নি।

কেউ কেউ গুজবটাকে বিশ্বাস করে আবার কেউ কেউ করে না আবার কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়। তবে ওদের অভিনয়ের কারনে অনেকেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছিল আর যারা বিশ্বাস করেছিল তারা আবার অন্যদেরকে বলেছিল। গুজবটা ছড়াতে তাই দুই-তিনদিনের বেশি লাগেনি। মাসুদের ভয় লেগেছিল দুইটা ক্লাসের টেবিলের উপর পেপার কাটিংটা রাখা। ওর স্কুলের কয়েকটা ক্লাসের বাইরের জানালার কাচ ভাঙা।

মাসুদ খুব সকালে ঐ ভাঙা কাচের জানালার মধ্যে লাঠি দিয়ে পেপার কাটিংটা টেবিলের উপর রেখেছিল। ওয়াহিদ সব শুনে বলল, তারপর রেজাল্ট বের হবার পর কি করলি? মাসুদের চোখ চকচক করে উঠল। বলল, এই ব্যাপারটা ছিল সবথেকে সোজা আর সবথেকে মজার। চাকু দিয়ে নিজের শরীর কাটাকুটি করার পর আমাদের কারও মাধ্যমে ক্লোরোফরম দিয়ে মাঠের উপর অজ্ঞান হয়ে থাকাটা ব্যাপার ছিল না। ঐ জায়গাটাতে দুপুর দুইটার দিকে লোক থাকে না কিন্তু তিনটায় লোকে ভরে যায়।

- সেভেনের নীরবও তোদের দলের ছেলে। নীরবও তোর মত একই কাজ করেছে? - হ্যাঁ। - মাসুদ, তোকে খুঁজে বের করাটা আমার জন্য খুব একটা কঠিন ছিল না-যতটা না পুলিশের জন্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল কেন করলি এ কাজটা? কি মজা পেলি এগুলো করে? জানিস এতে কত ক্ষতি হয়েছে? - মামা, আমি আসলে সবার এতটা ক্ষতি হোক তা চাই নি। সবার অবস্থা দেখে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে।

কিন্তু আমরা কেউ আসলে ভাল ছাত্রদের দেখতে পারি না। খুব ঘৃণা করি ওদের। - এটাই তোর কাজের একমাত্র কারন? - এটা একমাত্র কারন না। আসলে আমরা একটা বিশ্বাসের জোড়ে কাজটা করেছি। আমাদের বিশ্বাস, পৃথিবীতে সবার ভালবাসা, আবেগ এইসবের কোন কিছুই সীমাহীন না বরং এই সীমানাটা অনেক ছোট।

এই ছোট সীমানাটা যদি কেউ ভেঙে দেয় তাহলে এরা স্বার্থের জন্য নিজেদের ছিড়ে খাবে। আমরা ক্লাসের কাউকে কোন ক্ষতি করিনি শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করেছি। আর যেটা করেছি- অন্যদের বন্ধুত্ব, ভালবাসার মুখোশটা ভেঙে দিয়েছি। তারপর সবার মুখোশের নিচের স্বার্থটা বের হয়ে এসেছে। নিজেরাই নিজেদের মেরেছে।

নিজেদের ভয়েই নিজেরা পালিয়েছে। আসলে আমি জোকারের থিওরিটা খুব পছন্দ করি। সাইকো বলতে পারো আমাকে। - তুই আসলে নিজেকে কি মনে করিস? মাসুদ হাসল। - মামা, যতটুকু আমি নিজের সম্পর্কে জানি সেটা হল একটা অন্ধকার জায়গা।

আমি জায়গাটা দেখতে পাই না তবে অন্ধকারটা দেখতে পাই। তুমি হয়ত আমাকে জিজ্ঞেস করতে পার- অন্ধকার কি করে তুই দেখতে পাস? আমি তাহলে তোমাকে জিজ্ঞেস করব- আলো কি তুমি দেখতে পাও? আমার কাছে মনে হয়, আলো সব জিনিসকে দেখায় কিন্তু নিজেকে দেখায় না। আর অন্ধকারের ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। অন্ধকার কাউকে দেখতে দেয় না- কেবল নিজেকেই দেখায়। - তুই কি সেই জায়গাটা নাকি অন্ধকারটা? - আমি দুটোই।

- তুই আসলেই একটা সাইকো। - এটা হয়তো সেই ম্যাডনেস যেটা আমাদের পথ দেখিয়েছে। আমরা আসলে সবাই পরীক্ষায় খারাপ করার হতাশায় ছিলাম। হয়তোবা এম্নিতেও নিজেদের শরীরে চাকু চালাতাম। কিন্তু এখন একটা কথা ভাবতেও আমার ভাল লাগছে।

আমরা মাত্র ছয়জন ছেলে। কারও কোন ক্ষতি করছি না। শুধু নিজেরা চাকু দিয়ে নিজেদের শরীর কাটছি আর সেটা দেখে শহরের হাজার মানুষ ভয় পাচ্ছে, পুলিশ তদন্ত করছে, কেউ কেউ শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। পরীক্ষায় খারাপ করে শরীরে চাকু চালালে কখনো এমনটা হত না। - তাহলে তোর কাহিনির ঐ মুখোশধারী মানুষটা বলতে আসলে কেউ নেই।

- অবশ্যই আছে। আসলে আমরা সবাই-ই তো মুখোশধারী...হা হা হা... ওয়াহিদ অবাক হয়ে মাসুদের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর হাসি কিছুটা জোকারের মতই লাগছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।