আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের বাবুল সাহেব

বাবুল সাহেব দোতলার ব্যালকনিতে বসে আছেন। বিশাল বাগান বাড়ির বিশাল ব্যালকনি। ধপধপে সাদা বাড়িটার,সামনে সবুজ ঘাসের লন,ফাঁকে-ফাঁকে সাজানো গোছানো বাগান। ফুঁটে আছে বর্ষার সব ফুল। ফুলের সৌরভে চারপাশ মাতোয়ারা।

কিন্তু এর কিছুই বাবুল সাহেবকে স্পর্শ করতে পারছে না। তার মন ভালো নেই। গত চার বছরের অভ্যাস। সকাল হলেই সাক্ষাতপ্রার্থী,নেতাকর্মীর ভিড়। প্রায়ই মিডিয়ার লোকগুলাও আসত।

চারিদিকে একটা উৎসব-উৎসব ভাব। অফিসে যাবার সময় পুলিশ ভ্যানটা উৎকট সাইরেন বাজিয়ে তার পাজেরোকে এসকট করে যখন সাঁই-সাঁই করে ছুটে যেত কি ভালই না লাগত তার। পাশের লেনের স্থবির হয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি এক ধরনের সুখ অনুভব করতেন। বাবুল সাহেব একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। “স্যার”।

বাবুল সাহেব বিরক্ত হলেন। আজকের দিনটা একা-একা কাটাবেন ভেবেছিলেন। এমন কি অর্থমন্ত্রী সাহেব এসে ঘুরে গেছেন,দেখা পান নি। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেই বললেন, “কিরে কুদ্দুস,এত সকালে আসছস কেন? জানছ না আমি আর মন্ত্রী নাই। ” “স্যার,আমিতো সবসময়ই আপনার পাশে আছি,সময় ভালো হোক আর খারাপ।

” বাবুল সাহেব নিজেও ব্যাপারটা জানেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী, কুদ্দুস ছেলেটাকে তিনি মনে মনে খুব পছন্দ করেন। যদিও সে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য,গাঁধা। এতটাই অকর্ণ্য যে গত ২০ বছর বাবুল সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী থাকা সত্ত্বেও সে ভাগ্যের চাকাটা ঘোরাতে পারেনি। বাবুল সাহেবের সাথে দু-একাবার হাত মিলিয়ে আর মালা পড়িয়ে যেখানে কত লোক কত কিছু করে ফেলল, সেখানে কুদ্দুসের পরিবারটাকে তাকেই দেখাশোনা করতে হয়।

কিন্তু কুদ্দুস সাথে থাকলে বাবুল সাহেবের ভালো লাগে। তার প্রতি ছেলেটার অগাধ বিশ্বাস আর ভক্তি বাবুল সাহেবকে মুগ্ধ করে। তিনি জানেন তিনি যদি বলেন, “ কুদ্দুস আজকেতো সূর্য পশ্চিম দিকে উঠছৈ। ” কুদ্দুস বলবে, “জি স্যার, আপনি যেহেতু বলছেন সূর্য পশ্চিম দিকেই উঠছে। ” সরাদেশ যখন বাবুল সাহেবের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে কুদ্দুস তখন বলেছে, “পূর্ণিমার চাঁদের গায়ে কলঙ্ক থাকতে পারে, কিন্তু আমার স্যার সম্পূর্ণ নিঃকলঙ্ক, একদম সদ্যজাত ল্যাংটা শিশুর মতো।

এই সব যারা শ্যাম্পেইনে ভিজাইয়া স্যান্ডোইচ খায় হেগো ষঢ়যন্ত্র। ” এমন ভক্তকে কার না ভাল লাগে। বাবুল সাহেব বললেন, “ কিছু বলবি?” “স্যার, আজকের পত্রিকাটা পড়ছেন?” বাবুল সাহেব যেদিন থেকে মন্ত্রী হয়েছেন সেদিন থেকেই পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। এদের কাজই হচ্ছে সারাদিন মন্ত্রীদের দোষত্রুটি খুজে বের করা, আর বড় করে তা হেড লাইন করা। যেদেশের ১৪ আনা মানুষই আছে সবসময় এদিক সেদিক করা, আর যেখানে সেখানে টু পাইস বানানোর ধান্দায়, সেখানে মন্ত্রী, এম.পি দের দোষ কি।

তারা কি সব ফেরেশতা! তাকে নিয়েও পত্রিকা গুলো লিখে। পাতার পর পাতা নষ্ট। আহা বোকা সাংবাদিক গুলো যদি জানত, তিনি পত্রিকাগুলোর পাতাও উল্টে দেখেন না। ব্যাপারটা চিন্ত্ করেই হেসে ফেললেন তিনি। আমুদে গলায় বললেন, “ তুই জানছ না, আমি পত্রিকা পড়ি না।

” “স্যার, আজকে লিখছে, সব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আপনে। ” বাবুল সাহেব আবার বিরক্ত হলেন। ব্যাপারটা নতুন কিছু না। গত ২ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই তিনি প্রথম পাতায় স্থান পাচ্ছেন। অনেকে অনেক কথা বলছে,টেলফোন করছে।

এইতো সেদিন তার ছোট শালা আমেরিকা থেকে ফোন করেছে, “দুলাভাই আপনিতো দেখছি ন্যাশনাল হিরো হয়ে যাচ্ছেন। ” স্পষ্ট টিটকারীর সূর। তবে যে যাই বলুক বাবুল সাহেব কিন্তি মনে মনে বেজায় খুশি,বিনে পয়সায় এমন প্রচারণা কয়জনে পায়। “কিছু নতুন কথা আছে? নাকি আগের গুলারে নিয়াই কচলাইছে?” “স্যার, নেত্রী বলেছেন আপনে বিশাল দেশপ্রেমিক। খালি দেশের কথা চিন্তা করে, দেশের মানুষের জন্য কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়া আপনি পদত্যাগ করছেন।

” বাবুল সাহেব উদাস হয়ে গেলেন। তার কাছে মনে হলো একেই বোধহয় লোকে বলে, “জুতো মেরে গরু দান”। অথচ কাল সকালেই নেত্রী লন্ডন যাবার আগে তার অফিস থেকে ফোন এল। বাবুল সাহেব দুরু দুরু বুকে নেত্রীর রুমে ঢুকলেন এবং কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এলেন সাদা পাংশু মুখে। পিছনের দরজা দিয়ে, মিডিয়া এড়িয়ে বাসায় ফিরে এলেন পুলিশ প্রোটোকল ছাড়াই।

ওই সময়টাতে কি হয়েছিল তার পুরোটা তার মনে পড়ছে না। সবই কেমন ঘোলাটে। তবে নেত্রী যে তার সততা,দক্ষতা,বুদ্ধিমত্ত্বা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রাঞ্জল শব্দ ব্যবহার করেছেন ব্যাপারটা নিশ্চিত। ব্যাপার না, রাজনীতিবিদদের একটু বেহায়াই হতে হয়। তার প্রথম জীবনের গুরু মহান সৈরশাসক হু.মু র এই গুণটা তিনি ভালই রপ্ত করতে পেরেছেন।

তবে তিনি এও জানেন নেত্রী আর নেত্রীর পরিবারের সবাই তাকে পছন্দ করে। আর একারণে অনেকে তাকে হিংসাও করে। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টালেন। “কুদ্দুস বলতো আমার সম্পর্কে তোর কি ধারণা?” কুদ্দুস একটু অবাক হয়ে বললো “ এইটা কেমন কথা স্যার, আপনে একজন সফল মানুষ,সফল ব্যবসায়ী,সফল রাজনীতিবীদ। পরপর চারবার টানা এম.পি হওয়াতো মুখের কথা না।

তার উপর একবার আধামন্ত্রী,আরেকবার পুরা, যদিও মেয়াদ শেষ করতে পারেন নাই, সবই আল্লাহর ইচ্ছা”। “কুদ্দুস, তুই কয়দিন বাড়ি থ্যাইকা ঘুইরা আয়,যাওয়ার সময় ম্যানেজারের সাথে দেখা কইরা যাইছ। এতদিন পর বাড়ি যাইতেছস”। বাবুল সাহেব নিজের জগতে ফিরে যান। আসলেই কুদ্দুস যা বলছে, মিথ্যা বলেনিতো।

বাবুল সাহেব নিজেও জানেন তিনি দেখতে বোকার মতে হলেও তিনি মোটেও তা না। ক্লার্ক হিসাবে চাকুরী জীবন শুরু করে তিনি আজ এখানে। বিত্ত বৈভব কি নাই তার। এদিক সেদিক করে হাতে টাকা হলো ভাবলেন সম্মান দরকার,নির্বাচন করলেন,এম.পি হলেন,তারপর মন্ত্রী। ঢেকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভাঙ্গে,বাবুল সাহেব মন্ত্রী হয়েও তার পুরোনো টাকা বানানোর অভ্যাসটা ছাড়তে পারলেন না।

গোপন ব্যাবসার কাজে বিদেশে গিয়ে মন্ত্রীত্ব হারাতে হয়েছিল প্রথমবার। তিনি হাল ছাড়েননি। প্রায়শ্চিত্ত্ব করেছেন। নেত্রীর রাগ ভাঙ্গাতে দামী বুলেট প্রুফ গাড়ি উপহার দিয়েছেন। ভাগ্যও সাথে ছিল।

আর এই গাড়ির জন্যই কিনা নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেন। তার মনে হলো, একবার নেত্রী ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন, দৌড়ে জিতলেই মন্ত্রীত্ব। তিনি ফার্স্ট হয়েছিলেন। সবাই হাসছিল। তিনি কিন্তু ভাবছিলেন হাসুক সবাই, নেত্রীর কথা,তার উপর মন্ত্রীত্বের টিকিট,সবার উপর টাকার হাতছানি।

এমন সুযোগতো আর বার বার আসে না। আর এমন দৌড়ে ফার্স্ট হবেন না তো অলম্পিকে হবেন!নেত্রী কথা রেখেছিলেন। দেশের মানুষের,আর তার স্বপ্ন এক সেতুতে এসে মিশেছিল। সব ঠিক মতোই চলছিল। বাধ সাধল কানাডিয়ান স্পেশাল পুলিশ।

তার বাড়া ভাতেই ছাই দিতে হবে! অনেক চেষ্টা করলেন,ছ্যাচড়ামো করলেন। সরকারী চ্যানেলে সেতুর অ্যানিমেশন দেখিয়ে “আমাদের সেতু আমরাই গড়বো” মার্কা রক্ত গরম করা স্লোগানও প্রচার হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। বাবুল সাহেব আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। যাক হতাশ হলে চলবে না।

তিনি জানেন এ দেশের রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোন কথা নেই। এদেশের মানুষ গুলো নিতান্তই বোকা,তারা সহজেই সব ভুলে যায়। তারা তাকে আবার ভোট দিবে,তিনি আবার মন্ত্রী হবেন। একটু কবছর অপেক্ষা, এই যা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.