বাধ ভাইঙ্গা যায় আওয়াজের ঠেলায়! প্রতিদিন রাতে শহরে কার্ফিউ নামে, রাস্তাগুলো বিরান মরুভূমির মতো নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো পথ দেখিয়ে যায় নিঃসঙ্গতাকে, সেই নিঃসঙ্গতা সঙ্গ দেয় খাদ্যের খোজে নেমে পড়া রাস্তার দুয়েকটা নেড়ী কুকুরকে।
জহিরের এ সময় পথ মাড়াতে ভালো লাগে, ভালো লাগে অলি গলি হাটাহাটি করতে। নিজের সাথে কথা বলতে, নিজের ভুল গুলোর জন্য যে দুঃখে কাঁদা আত্মাটাকে বোঝাতে। কোনো কিছুই ওর নিজের হাতে নেই, কখনো ছিলো না।
আজও হেটে চলেছে, পথ ভিজে আছে গ্রীষ্মের দুষ্প্রাপ্য বৃষ্টিফোটায়। এবার নগরবাসী বেশ ভয়ে ছিলো হয়তো এবার বৃষ্টি হবে না, হয়তো গরমে রাস্তার পীচ গলে যাবে, হয়তো সবাই তৃষ্ঞার্ত বুকে মারা যাবে। সময় এগিয়ে যায়, দেশটা জহিরের মতো পিছিয়ে আছে। মাঝে মাঝে দেশটা রাতের বেলায় জহিরের উপর ভর করে, বলে তার বেদনার কথা, তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান সন্ততির কথা। পূর্নিমার আলোতে ড্রেনের কালো পানিগুলো চক চক করে।
নিজের চেহারা সেখানে দেখা যায় না। চাদের আলো ঢেকে গিয়ে নিজের কালো রূপ দেখা যায়।
হঠাৎ বাশীর শব্দে জহিরকে দাড়াতে হয়। টহল পুলিশ দাড় করিয়ে পুরো শরীর চেক করে, কখনো কখনো থানায় নিয়ে যায়। আজ রাতেও দাড় করালো।
: কই যান এত রাইতে?
: ঘুম আসছে না, বাসায় কারেন্ট নাই। গরমে ঘুমাতে পারি না।
: আপনার নাক দিয়া দেখি রক্ত পড়তাছে। ওষুখ আছে নাকি?
: তা আছে!
: (পুলিশ ভদ্রলোকের গলাটা কেমন যেনো নরম হলো) আগুন আছে?
জহির পকেট থেকে লাইটার বের করে দিলো, পুলিশ পকেট থেকে একটা বেনসন সিগারেট বের করে আগুনে ফু দিলো। একটা বড় টান দিয়ে উপরে ধোয়া ছেড়ে শাহেদের দিকে এগিয়ে দিলো।
জহিরের সিগারেট টানা দেখতে দেখতে পুলিশ সাহেব জিজ্ঞেস করলো,"ডাক্তার কত দিনের সময় দিছে?"
জহির একটু মাথা নীচু করলো, হঠাৎ কি যেনো ভাবনায় অন্য কোথায় চলে গেলো ওর মন। কেমন যেনো একটা তোলপাড়...কিছু পুরোনো সুখ স্মৃতি...মুখের কোনে ঝুলে পড়ে একটু হাসি।
পুলিশ জহিরের কাধে হাত রেখে বললো,"এভাবে রাতের বেলা বাইর হইয়েন না। বাসায় যান। দিন কাল ভালা না!"
সিগারেট টা পুলিশকে ফেরত দেবার জন্য হাত বাড়াতে গেলে পুলিশ আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে লাইটার ফেরত দিয়ে বললো,"বাসায় চইলা যান ভাই।
দিন কাল ভালা না!"
জহির উল্টো পথ ধরে। ও বাসায় যাবে না। ইদানিং ও অনুভব করে ওর রক্ত কনিকাগুলো কিভাবে মরে যাচ্ছে। ও অনুভব করে দিনে দিনে শক্তি হীন হয়ে পড়ছে। কেমো দিয়ে কাজ হবে না, কাজ হলেও সেটা নেবার মতো টাকা ওর নেই।
আর কত সময় আছে ওর? নাহ, ও এটা ভাবতে চায় না।
ও চলার পথ পাল্টায়, অলি গলি, রাস্তার পাশে থাকা উন্মুক্ত ড্রেন, মোড়ে দাড়িয়ে থাকা চকচকে শাড়ি, লাল লিপস্টিকের দুয়েকটা পতিতা। আধার গলিতে ফাদ দিয়ে বসে থাকা দুয়েকটা দালাল, মুখে তাদের চকচকের ছোড়ার মতো ঝিলিক দেয়া হাসি, হাসি শেষে হারিয়ে যাওয়া এক কৃষ্ঞগহ্বর।
একটা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে, ৪ তলা বিল্ডিং। ৪ তলার বা পাশের জানালায় এখনো চার্জার জ্বলছে।
পর্দাটা খোলা। জহির পকেট থেকে একটা খালি ক্যান বের করলো। ক্যানটা সজোরে রাস্তায় আছড়ে ফেলে দিলো।
ক্যানের শব্দে চারিদিক গম গম করতে লাগলো। আশেপাশের সব বিল্ডিং অন্ধকার।
সবাই ঘুমে। এই ক্যানের শব্দে ক্লান্ত ন গরবাসীর ঘুম ভাংবে এরকম ভাবার কোনো কারন নেই। হঠাৎ ঐ চারতলা জানালায় কেউ একজন দাড়িয়ে পরে। জহিরের মুখে হাসি, একটু পিছিয়ে থেকে দেখার চেষ্টা। ভরা পূর্নিমা শুধু একটু চেহারা দেখা।
একটা কাগজের ঢেলা উড়ে এসে পরে ওর পায়ের সামনে। জহিরের মুখে হাসি ফোটে। কাগজেরা ঢেলা হাতে নিয়ে ভিতরের ঢেলাটা ফেলে দেয়। ইদানিং ওর নাকে গন্ধ নামক জিনিসটা খুব একটা লাগে না। যখন মাঝে মাঝে মাথা প্রচন্ড ব্যাথা হয় তখন ও দুর্গন্ধ পায়, কিন্তু সুগন্ধ আর পায় না।
চিঠিটা খুলে উপরে দেখে ঐ মানুষটি আর জানালায় নেই, বাতী নিভে গেছে! জ্যোৎস্নার আলোয় চিঠি পড়তে পড়তে জহির এগিয়ে যায়।
জহু
আজ ফার্মগেট থেকে অনেকগুলো বেলীফুলের মালা কিনেছি। মালাগুলো আমার চিঠির প্যাডের সাথে রেখেছিলাম। তুমি কি গন্ধ পাও?
যদি গন্ধ পাও তাহলে চলো কাল আমরা ঘুরে আসি, আশুলিয়া যাবে? কাল আমার টিউশনি নেই।
যদি গন্ধ না পাও, তাহলে প্লিজ কাল বের হবা না।
আমি ঔষুধ নিয়ে আসবো। তুমি কি দেখা করবে আমার সাথে?
ইতি
তোমার মৌ
জহির ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। আর তিন ঘন্টা পর গাবতলী থেলে গাড়ি ছেড়ে যাবে। কুয়াকাটা যাবার ইচ্ছে অনেকদিন। কেনো যেনো মনে হয় কক্সবাজারকে প্রকৃতি বিশালতা দিলে কুয়াকাটার মতো নিঃসর্গ বন্যতা তাকে দেয়া হয়নি।
বন্যতা ওর ভালো লাগে, ভালো লাগে বুনো সৌন্দর্য্যে হারিয়ে যেতে! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।