আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৃটেনের শিক্ষাব্যবস্থা - ৭ : বৃটেনের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস

ইংল্যান্ড, ওয়েল্স, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড এ চারটি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্য বা গ্রেট বৃটেন । এ চারটি রাজ্যের পার্লামেন্টই অত্যন্ত ঐতিহ্যপূর্ণ। এ রাজ্যেগুলোর পার্লামেন্টতে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক অধ্যাদেশ পাশ হয়। এসব অধ্যাদেশে প্রণীত আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠেছে আজকের বৃটেনের শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূর্ণ রূপ। অধ্যাদেশগুলোর মাধ্যমেই জানা যাবে বৃটেনের শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিকাশের দীর্ঘ ইতিহাস।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অধ্যাদেশগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ : শিক্ষা অধ্যাদেশসমূহ ১. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৪৯৬ (Education Act 1496) এটি স্কটল্যান্ডের ৪র্থ জেম্সের সময় ১৪৯৬ খৃস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাশ হয়। এই প্রথমবারের মতো স্কটল্যান্ডে অভিজাত শ্রেণীর বড় পুত্র সন্তানের শিক্ষাদানকে বাধ্যতামূলক করা হয়। সে সময় আট, নয় বছর বয়সে স্কটিশ আইন ও কলা শিখতে ল্যাটিন স্কুলে পাঠানো হতো। মূদ্রণজনিত ভুলের কারণে কোথাও কোথাও একে ‘Education Act 1496’- এর স্থলে ‘Education Act 1494’ উল্লেখ করা হয়। মূলত এটি Education Act 1496-ই হবে।

২. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৬৯৫ (Education Act 1695) ১৬৯৫ সালে আয়্যারল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাশ হয়, যার মাধ্যমে ক্যাথলিকদের সন্তানদের বিদেশে শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। ৩. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৬৯৬ (Education Act 1696) এটি স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টে পাশ হয়। যাতে প্রত্যেকটি প্যারিশ বা এক একটি চার্চভুক্ত অঞ্চলে একজন শিক্ষকের অধীন একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটি ১৮৭২ সাল পর্যন্ত স্কটল্যান্ডে বলবৎ থাকে। ৪. প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৮৭০ (Education Act 1870) এটি ১৮৭০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে পাশ হয়।

এতে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সী প্রত্যেক শিশুর স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক করা হয়। ন্যাশনাল এডুকেশন লীগ দেশব্যাপী আন্দোলন করার পর বাধ্যতামূলক সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার এই অধ্যাদেশটি পাশ হয়। তৎকালীন বিশ্ব বাণিজ্যে বৃটেনের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে একটি কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন বেশ আগ থেকে অনুভূত হচ্ছিল। এ অধ্যাদেশটি সেই অভাব অনেকটা পূরণ করে। এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৃটেনের স্কুলগুলো অঞ্চল ভিত্তিক গঠিত স্কুল বোর্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।

তারপর ১৮৭২ সালে এ অধ্যাদেশ পরিমার্জন করে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ৬টি স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীর পঠন, লিখন ও আংকিক দক্ষতা পরিমাপনের জন্য ৬টি স্ট্যান্ডার্ড বা ধাপ নির্ধারণ করা হয়। যেমন, ৬টি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে ১ম স্ট্যান্ডার্ড ছিল : পঠন দক্ষতা : স্কুলের প্রাথমিক একটি বই থেকে বানান করে কিছু পড়তে পারা, লিখন দক্ষতা : বইয়ের ১টি লাইন কপি করা এবং কিছু পরিচিত শব্দের ডিকটেশন লেখতে পারা, অংক জ্ঞান : সর্বোচ্চ ৪ সংখ্যার যোগ-বিয়োগ। আর ৬ষ্ঠ স্ট্যান্ডার্ড ছিল : পঠন দক্ষতা : দ্রুত পড়তে পারা এবং ব্যাখ্যা করতে পারা, লিখন দক্ষতা : ছোট্ট একটি বিষয়ের উপর লেখতে পারা অথবা চিঠি বা ছোট রচনা লেখতে পারা, অংক জ্ঞান : অনুপাত ও ভগ্নাংশের অংক করতে পারা। স্কুল বোর্ডের ইন্সপেক্টরগণ শিক্ষার্থীদের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের জন্য পরীক্ষা নিতেন।

৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ ধাপকে কাংখিত স্ট্যান্ডার্ড ধরা হতো। ১৮৭২ সালে স্কটল্যান্ডে অনুরূপ একটি অধ্যাদেশ সে রাজ্যের জন্য পাশ করে। ৫. ব্যালফোর শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯০২ (Balfour Education Act 1902) ১৯০২ সালে ব্যালফোর শিক্ষা অধ্যাদেশ-এর মাধ্যমে স্কুল বোর্ডগুলোকে বিলুপ্ত করা হয়। এর পরিবর্তে লোকাল এডুকেশন অথরিটি বা এল.ই.এ (খড়পধষ ঊফঁপধঃরড়হ অঁঃযড়ৎরঃু) প্রতিষ্ঠা করা হয়। সারাদেশে এ ধরনের ৩০০ এল.ই.এ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সে সময় ২৬ লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য ৫৭০০টি বোর্ড স্কুল এবং ৩ লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য ১৪০০০টি ভলেন্টারী স্কুল ছিল। এ সময় প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক শিক্ষাকে এল.ই.এ-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করা হয়। ৬. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯০৬ (Education Act 1906) ‘বিনে পয়সায় স্কুল খাবার’ (ফ্রি স্কুল মিল) প্রবর্তন করে এ অধ্যাদেশটি পাশ হয় ১৯০৬ সালে। এর পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্গারেট ম্যাকমিলান এবং ফ্রেড জুয়েট যখন ব্রেডফোর্ড এলাকার স্কুল গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন।

তখন তারা ব্রেডফোর্ডে ‘ফ্রি স্কুল মিল’ চালু করেন। কিন্তু সে সময় এটা ছিল অবৈধ এবং তহবিল তসরুপের সমতুল্য। এটি বন্ধ করার জন্য ব্রেড ফোর্ড কর্তৃপক্ষ চাপ দিতে থাকে। অন্যদিকে ম্যাক মিলান এবং জুয়েট এটা পার্লামেন্টে পাশ করানোর চেষ্টা করতে থাকেন। এ ব্যাপারে ১৮৮৯ সালে একটি রিপোর্টও প্রকাশ করেন তারা।

অবশেষে ফ্রেড জুয়েট ব্রেডফোর্ড থেকে নির্বাচিত হয়ে লেবার পার্টির এমপি হিসেবে পার্লামেন্টে যান এবং ১৯০৬ সালে School Meals Act পাস করেন। ৭. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯১৮ (Education Act 1918) এই এ্যাক্ট পাশের মাধ্যমে স্কুল ত্যাগের সর্বনিম্ন ১৪ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া এই এ্যাক্টে শিক্ষা সহায়ক আরো কিছু দিক অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন ছাত্রছাত্রীদের জন্য মেডিকেল ইন্সপেকশন, নার্সারি স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। বিশের দশকে বৃটেনের রাজনৈতিক মহলে একটি গণবিতর্ক সৃষ্টি হয় কচি শিশুরা কিভাবে উত্তম শিক্ষা পেয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

তাদের জন্য প্রকৃত শিক্ষাকাঠামো কেমন হওয়া দরকার? ফলে বৃটিশ সরকার এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা চি‎িহ্নত করে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হ্যাডোর নেতৃত্বে একটি সিরিজ কমিশন গঠন করে দেয়। হ্যাডো কমিটি ১৯২৬, ১৯৩১ ও ১৯৩৩ সালে পর পর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টগুলো প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামোতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারা শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি শিক্ষা কাঠামো প্রস্তাব করে। ৫ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ইনফেন্ট বা শিশুস্তর এবং ৭ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য জুনিয়র স্তর।

রিপোর্টগুলো শিশুকেন্দ্র তৈরি এবং সর্বোচ্চ ৩০ জন নিয়ে একটি ক্লাশের প্রস্তাব দেয়। এই রিপোর্টগুলোকে আধুনিক শিক্ষাচিন্তা প্রগতির এক মহাবিজয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ৮. বাটলার শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৪৪ (Butlar Education Act 1944) অধ্যাদেশটির ফলে ইংল্যান্ড ও ওয়াল্সের মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হয়। এতে মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীর জন্য ফ্রি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় এবং গ্রামার স্কুল, মাধ্যমিক টেকনিক্যাল স্কুল ও আধুনিক মাধ্যমিক স্কুল এ তিন ধারার স্কুলকে সুসংগঠিত ও সমন্বিত করা হয়। তাই এ অধ্যাদেশটি Tripartite System নামে পরিচিতি পায়।

৯. শিক্ষা সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৮ (Education Reform Act 1988) এ অধ্যাদেশটির মাধ্যমে ইংল্যান্ড, ওয়াল্স ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এতে ন্যাশনাল কারিকুলাম, কী-স্টেজ সিস্টেম সংযুক্ত হয়। প্রথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলকে এ সুযোগ দেয়া হয়, তারা ইচ্ছা করলে ‘লোকাল এডুকেশন অথারিটি’ থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে দিতে পারে। স্কুলগুলো থেকে সরাসরি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে তা প্রধান শিক্ষক ও স্কুলগভর্নিং বডির উপর ন্যাস্ত করা হয়। ১০. শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৯৪ (Education Act 1994) এ অধ্যাদেশটি জন মেজর সরকার ১৯৯৪ সালে পাশ করে।

এতে দুটি অংশ ছিল। একটি ছিল টিচার্স ট্রেনিং সংক্রান্ত, অপরটি ছিল শিক্ষার্থীদের যে কোন ছাত্র ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা সম্বলিত। তবে এসব ছাত্র ইউনিয়ন অবশ্যই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হতে হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক লেনদেনের হিসাব থাকতে হবে- তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.