কে্উ তো এক বারও বলেনি,কেউতো একবারও ভাবেনি
১৯৩৬ সনের ১৬ নভেম্বর বৃটেনের রাজা অস্টম এডোয়ার্ড বাকিংহাম প্যালেসে একান্তে বৃটেনের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলী বাডউইনকে আমন্ত্রন জানান। এ আমন্ত্রন কোন বিশেষ আমন্ত্রন ছিলনা। এর পেছনে লুকিয়ে ছিল বৃটেন এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ সম্রাজ্যের এক চরম ক্রাইসিসের সূচনা। রাজা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ইচ্ছা পোষন করেন যে তিনি মার্কিন নাগরিক ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করতে আগ্রহী। রাজা এটাও জানান তিনি সিম্পসনকে প্রচন্ড ভালোবাসেন এবং এই বিয়ে থেকে কোন ভাবেই তিনি পিছিয়ে আসতে পারবেন না।
কিন্তু সমস্যা হলো, সিম্পসন ইতিপূর্বে দুবার বিয়ে করেছেন এবং তার ব্যাক্তিগত জীবনও খুব একটা সুন্দর ছিলনা। মোটকথা রানী হিসেবে সম্মান পাবার জন্য যা যা দরকার তার অনেক কিছুরই ঘাটতি ছিল তার। ফলে প্রধানমন্ত্রী এ বিয়ের ব্যপারে দ্বিমত পোষন করেন। তিনি রাজাকে এটাও বোঝান যে এই ভদ্রমহিলা অতীতে তাদেরই বিয়ে করেছেন যাদের প্রতিপত্তি রয়েছে। তার কাছে ভালোবাসার কোন মূল্য নেই।
কেবল অর্থ এবং ক্ষমতাই এ নারীর কাছে মূখ্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কোন যুক্তিই রাজার হৃদয়কে টলাতে পারেনি সেদিন।
বিষয়টা ধীরেধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে জনসাধারনের মাঝে। যতই বলা হোক সেকুলার রাজ্য, বৃটেনের শাসনের অন্যতম বড় কলকাঠি নাড়ার কাজ আজও চার্চ অব ইংল্যান্ড করে থাকে। যেহেতু ক্রিস্টান ধর্মে ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে গ্রহনযোগ্য নয় এবং ওয়ালিস সিম্পসনের দুইবার বিয়ে হয়েছে এবং তিনি ডিভোর্সী, অতএব চার্চের পক্ষে এই বিয়ে মেনে নেয়া সম্ভব ছিলনা।
তারা স্পস্টতই এটা জানিয়ে দেয় রাজা এই বিয়ে করতে পারবে না। যতই সময় গড়াতে থাকে, বৃটেনের বাহিরে থাকা ডমিনিয়নগুলো, যেগুলোর রাজাও এডোয়ার্ড, এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে। আইরিশ ফ্রি স্টেট (পরবর্তিতে যারা রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড হয়), অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এই বিয়ের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন।
যখন রাজা দেখতে পান চারদিকে বিক্ষোভের সূচনা হতে শুরু করেছে, তখন তিনি একটি প্রস্তাব দেন যার মাধ্যমে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। রাজা পার্লামেন্টকে অনুরোধ করেন এমন কোন আইন পাশ করতে যাতে রাজা বিয়ে করলেও সিম্পসনকে রানী উপাধী গ্রহন করতে না হয়।
কিন্তু পার্লামেন্ট রাজার এই অনুরোধ প্রত্যাক্ষান করেন। ধীরেধীরে অবস্থা এমন দিকে মোড় নিতে শুরু করে যে রাজা এবং পার্লামেন্ট মুখোমুখী হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় পার্লামেন্টের বিপক্ষে গিয়ে রাজার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল, তবে সেটা দেশকে এক চরম দূরবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হতো। প্রায় চারশ বছর আগে এরকমই একটা সমস্যা (রাজা বানাম পার্লামেন্ট) ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল এবং তৎকালিন রাজা প্রথম চার্লসকে সে সময়ের পার্লামেন্ট ফাসীতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল (অন্য একদিন এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখবো, দারুন ক্লাসিক স্টোরি এটাও)। ফলে এডোয়ার্ড সে পথে আর হাটেনি।
তবে তিনি আবারও স্পস্ট করে এটা জানিয়ে দেন যে তার পক্ষে সিম্পসনকে ছাড়া সম্ভব নয়।
১৯৩৬ সনের ১০ ডিসেম্বর রাজা এডোয়ার্ড তাঁর ভালোবাসার জন্য সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেন। সেদিন তিনি ক্ষমতা থেকে নিজেই নিজেকে অপসরন করেন এবং পরদিন আইন পাশের মাধ্যমে আইরিশ ফ্রি স্টেট বাদে অন্য সব ডমিনিয়নেও তা কার্যকর করা হয়। ১২ ডিসেম্বর আইরিশ ফ্রি স্টেটও রাজার অপসারন মেনে নেয়। উল্লেখ্য যে ১১ ডিসেম্বর রাজা অস্টম এডোয়ার্ড এক দিনের জন্য ব্রিটিশ সম্রাজ্যের রাজা না থেকেও শুধু আয়ারল্যান্ডের রাজা ছিল!
পরবর্তিতে রাজার ভাই প্রিন্স এ্যালবার্ট ষষ্ঠ জর্জ হিসেবে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের ক্ষমতা গ্রহন করেন।
ক্ষমতার এই পালাবদলের ফলে নীচ থেকে হঠাৎ করে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সবার উপরে উঠে আসেন রাজা জর্জের বড় কন্যা প্রিন্স এলিজাবেথ যিনি পরবর্তিতে তাঁর মৃত্যুর পর বৃটেনের রানী হন এবং এখনও শাসন করে চলেছেন। রাজা এডোয়ার্ড যদি মিসেস সিম্পসনকে বিয়ে না করতেন, তাহলে হয়তো বৃটেনের ক্ষমতায় আজ যাদের দেখা যাচ্ছে তারা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যেতো।
ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর এডোয়ার্ড বর্তমান চেক রিপাবলিকের প্রাগে চলে যান এবং কিছুদিন পর ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করেন। তাঁরা (এডোয়ার্ডের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) পরবর্তি ৩৫ বছর সুখে শান্তিতে ঘর করেছিলেন। উল্লেখ্য যে রাজা এডোয়ার্ড ছিলেন এগারোশ বছরের ব্রিটিশ/ইংলিশ সম্রাজ্যের ইতিহাসে একমাত্র রাজা যিনি স্বেচ্ছায় রাজত্ব ত্যাগ করেছিলেন, তাও এক নারীর ভালোবাসার কারনে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।