বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ অবিভক্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রে বাংলার অবস্থান। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) বাংলার ‘ইলিয়াস শাহী’ বংশের প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। বংশটি বাংলায় ১৩৪২ থেকে ১৪১৪ সাল অবধি শাসন করে।
আরব ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ছিলেন পারস্যের (বর্তমান ইরান) সিজিস্তানের অধিবাসী। তিনি চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে পারস্য থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। আমরা দেখেছি ইলিয়াস শাহর প্রতি ভাগ্য সদয় হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি বাংলার সুলতান হয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, অসম সাহসী ইলিয়াস শাহই প্রথম দিল্লির নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা করেছিলেন।
এই কারণে দিল্লির বেতনভোগী ঐতিহাসিকগণ তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছিল। তারা বলেছিল ‘ইলিয়াস ভাঙারা’ অর্থাৎ ইলিয়াস শাহ নাকি রাতদিন ভাঙ খেয়ে পড়ে থাকেন। আমরা বুঝতে পারি যে দিল্লির ভাড়াটে ঐতিহাসিকদের এমন অপবাদ রটানোর কারণ সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা করে দুশো বছরের জন্য স্বাধীন সুলতানী বাংলার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ইলিয়াসের দাপট ক্ষুন্ন করার জন্য দিল্লির তরফ থেকে একাধিকবার বাংলায় আক্রমন হয়েছিল। তবে বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পরিকল্পিত সমরকৌশল বাংলার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রেখেছিল।
নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সনে বাংলার ক্ষমতায় আরোহণ করেন। বাংলার রাজধানী তিনি লক্ষণাবতী (গৌড়) থেকে পান্ডুয়ায় সরিয়ে নেন। পান্ডুয়ার অবস্থান ছিল গৌড়ের ৩২ কিলোমিটার উত্তরে। তারপর থেকে পান্ডুয়া একটি গুরুত্বপূর্ন নগর হিসেবে গড়ে ওঠে।
পান্ডুয়ার বর্তমান অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় ।
এবং নগরটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন বাংলার আরেক সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-২২)। যে কারণে পান্ডুয়া ফিরোজাবাদ নামেও পরিচিত। পান্ডুয়ার অন্য নাম হজরত পান্ডুয়া
উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিনা মসজিদটি পান্ডুয়ায় অবস্থিত। আদিনা মসজিদের অভ্যন্তরভাগ।
সে যা হোক।
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ যখন বাংলার সিংহাসনে বসলেন তখন দিল্লিতে তুঘলক বংশের শাসন চলছিল। তুঘলক বংশটি ১৩২০ সাল থেকে ১৪১৪ সাল অবধি দিল্লির ক্ষমতায় টিকে ছিল। তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক (১৩২০-২৫); ইনি বাংলায় দিল্লির আধিপত্য কায়েম করেছিলেন এবং বাংলাকে তিনটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। (ক) লক্ষ্মণাবতী; (খ) সাতগাঁও বা সপ্তগ্রাম; (গ) সোনারগাঁও। এই তিন প্রদেশের রাজধানীও ছিল আলাদা এবং শাসনকর্তা ছিলেন তিনজন।
এরা ছিলেন দিল্লির অধিনস্ত এবং এই তিনজন শাসনকর্তার মধ্যে বিরোধ অব্যাহত ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এই সুযোগটি গ্রহন করলেন। এবং বাংলার তিনটি প্রদেশ জয় করে বাংলাকে একীভূত করে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ উপাধি গ্রহন করলেন। বাংলার ইতিহাসে বাংলা এই প্রথম ‘বাঙ্গলা’ নামে পরিচিত হল। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সন্দেহ নেই।
কেননা, এর আগে বাংলা প্রাচীন কাল থেকে গৌড়, পুন্ড্র, বঙ্গ এসব জনপদে বিভক্ত ছিল। সে যাই হোক। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহস্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব করতে লাগলেন।
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহই সর্বপ্রথম বাংলা থেকে নেপালে মুসলিম সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন । নেপাল অভিযানের সময়কাল: ১৩৪৯-৫৯;
বাঙালি ঐতিহাসিকদের মতে ইলিয়াস শাহর নেপাল অভিযান বাংলার ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তবে নেপাল অভিযানের আসল কারণ জানা যায় নি। মানে, ঠিক কী কারণে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দূর্গম পার্বত্য পথে অগ্রসর হলেন তা জানা যায় নি। সে যাই হোক। সমকালীন ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নেপালে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। তবে এর পক্ষে তেমন জোরালো প্রমাণ নেই বলে অনেক বাঙালি ঐতিহাসিক মনে করেন।
সে যাই হোক। এরপর তিনি সোনারগাঁও জয় করেন। (তিনি আগেই সাতগাঁও জয় করেছিলেন। ) এভাবে বাংলাকে প্রথমবারের মতো একটি একীভূত শাসণের অধীন নিয়ে এলেন। এ কারণেই হয়তো সুলতানের আকাঙ্খা-উদ্দীপনা বেড়ে যায়।
এবং তাঁকে আমরা উড়িষ্যা অভিমুখে অগ্রসর হতে দেখি। তিনি উড়িষ্যার চিলকা হ্রদ অবধি অগ্রসর হলেন। এরপর তিনি উত্তর বিহার (তিরহুত) এবং কামরূপ অভিমুখে সসৈন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। মোটকথা, ১৩৪২ সালে সিংহাসনে বসার পর ইলিয়াস শাহ ধীরে ধীরে আসাম থেকে বিহার এবং উড়িষ্যা পর্যন্ত পূর্বভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করেন। এসব এলাকা ছিল কেন্দ্র (দিল্লি) শাসিত তুঘলক সাম্রাজ্যের অধীন।
রাজধানী দিল্লি থেকে অনেক দূরে ছিল বলে অঞ্চলগুলি দখল করা তেমন কঠিন হয়নি। তুঘলক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল আক্রমন থেকে বাংলার এই সুলতানের বীরত্ব সাহস এবং উচ্চাকাঙ্খারও প্রমান পাওয়া যায়। এও ভাবা যায় তুঘলকশাসিক অঞ্চল আক্রমন করে ইলিয়াস শাহ কি দিল্লীর সুলতানকে বাংলায় টেনে আনতে চাইছিলেন? কেননা, অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ‘কিন্তু ইলিয়াস শাহের এ সমস্ত বিজয়ের গৌরবও ম্লান হয়ে যায়, যখন দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের কথা স্মরণ করি। ’
এবার আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।
১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক এক দুর্ঘটনায় মারা যান।
তাঁর পুত্র জুনা খান ওই বছরই মুহম্মদ বিন তুঘলক উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। মুহম্মদ বিন তুঘলক- এর চরিত্রে বৈপরীত্যের সংমিশ্রন ছিল; তিনি ছিলেন উচ্চভিলাষী। তিনি নানা রকম প্রশাসনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সে যাই হোক। ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে মুহম্মদ বিন তুঘলক মারা যান।
এর পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে দিল্লির সৈন্যবাহিনীতে এক অরাজক পরিস্থিতি উদ্ভব হয়। এই অবস্থায় অভিজাতবর্গের অনুরোধে ৪৬ বছর বয়েসে ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ।
ফিরোজ শাহ তুঘলক। ইনি ছিলেন তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক এর ছোট ভাই রজব এর ছেলে। ফিরোজ শাহয়ের মা ছিলেন রাজপুত।
সে যা হোক। বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি দমন করবার জন্য দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। সময়টা ১৩৫৩ সাল। আসলে মিথ্যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমন করেছিলেন। আমরা আগেই বলেছি, ১৩৪২ সালে সিংহাসনে বসার পর ইলিয়াস শাহ ধীরে ধীরে আসাম থেকে বিহার এবং উড়িষ্যা পর্যন্ত পূর্বভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করেন।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর কানে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য পৌঁছেছিল যে তুঘলকদের অধিকৃত অঞ্চলে বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহ নাকি অধিকৃত অঞ্চলে নারী-শিশুদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছেন। এই তথ্যটি আড়াগোড়া মিথ্যে। আসলে বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় প্রচুর সংগ্রাম করে বাংলার সুলতান হয়েছেন। এ ধরনের মানুষ সাধারণ সুশাসকই হয়ে থাকেন, অহেতুক অত্যাচার করে না, নারী-শিশুদের ওপর তো নয়ই। ইলিয়াস শাহও তাই সুশাসকই ছিলেন।
বাঙালি ঐতিহাসিকরাও তাই মনে করেন। তাছাড়া ড. আহমদ শরীফ দেখিয়েছেন যে, বাংলার মুসলিম শাসকদের মধ্যে সেরকম অত্যাচারী ছিলেন মাত্র পাঁচজন। এদের মোট রাজত্বকাল পঁচিশ বছর। এই তালিকায় ইলিয়াস শাহের নাম নেই। ( দ্র: বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব; পৃষ্ঠা; ১০২)
ইলিয়াস শাহ কেবল সুশাসকই ছিলেন না, ছিলেন একজন অত্যন্ত কুশরী সমর পরিকল্পনাবিদও।
তিনি জানতে সম্মুখ সমরে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকএর নেতৃত্বাধীন দিল্লির বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। সুতরাং অন্য কোনও কৌশল অবলম্বন করে ফিরোজ শাহ তুঘলক কে বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে হবে। প্রথম কৌশল হিসেবে ইলিয়াস শাহ অগ্রসরমান ফিরোজ শাহ তুঘলক এর পথে কোনও প্রতিরোধ গড়ে না তুলে ফিরোজ শাহ তুঘলককে বাংলার ভিতরে অনেকটা প্রবেশ করতে দেন। (এই কৌশলের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোফেস স্টালিনের সমর কৌশলের সাদৃশ্য রয়েছে। ) দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে ইলিয়াস শাহ আশ্রয় নেন একডালা (ইকদালা) নামে একটি দূর্গে ।
দুর্ভেদ্য ওই দূর্গটির অবস্থান ছিল রাজধানী পান্ডুয়ার নিকটে। তবে ঐতিহাসিকগণ একডালা দূর্গের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেননি। (দ্র: পাদটীকা। এ. কে.এম আবদুল আলীম; ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস। পৃষ্ঠা;৮৭)
একডালা দূর্গের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে না পরলেও এই দূর্গের ছবি দেখে একডালা দূর্গের দুর্ভেদ্যতার বিষয়টি অনুমান করা যায়।
তবে অনুমান করা যায় একডালা দূর্গটির অবস্থা ছিল বর্তমান রাজশাহীতে
সে যাই হোক। ইলিয়াস শাহ জানতেন যে বর্ষাকাল আগত প্রায়। এই সময়ে বরেন্দ্রর নীচু ভূমি প্লাবিত হয়। একডালার চারপাশের জমি নীচু, প্লাবণে তলিয়ে যাবে; তখন দিল্লির সৈন্যরা টিকতে পারবে না এবং যুদ্ধের ঘোড়াগুলি জলা অঞ্চলের মশার উপদ্রপ সহ্য করতে পারবে না । ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনীর লেখা ‘তারিখ ই ফিরোজ শাহী’ বইতেও একডালা দূর্গের এই বর্ণনার সমর্থন মেলে।
বারনী লিখেছেন: ‘একডালা দূর্গটির একদিকে জল (জলরাশি?) অন্যদিকে জঙ্গল। ’
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনী আরও লিখেছেন:
ওদিকে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজধানী ফিরোজাবাদ (পান্ডুয়া) পৌঁছলেন। ফিরোজ শাহ ফরমান জারী করে আদেশ দিলেন যাতে দিল্লির সৈন্যরা বেসামরিক লোকদের হত্যা না করে। দিল্লির সৈন্যরা অবশ্য ইলিয়াসের সৈন্যদের হত্যা করল এবং সুলতানের পরিত্যক্ত ঘোড়াগুলি হস্তগত করেন। এরপর দিল্লির সৈন্যরা একডালা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
দূর্গের কাছাকাছি পৌঁছনোর পর ফিরোজ শাহ তুঘলক ফরমান জারী করে আদেশ দিলেন যাতে সৈন্যরা ছোট ছোট পাথর ফেলে ছাউনী ফেলার উপযুক্ত স্থান তৈরি করে এবং সেতু ও বাঁধ তৈরি করে নদী পাড় হওয়ার চেষ্টা করে।
মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল রচিত আইনই আকবরী গ্রন্থের এই ছবিটি বলে দেয় দূর্গ দখলে মুঘল সৈন্যরা কীরকম তৎপর ছিল।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনী অবশ্য লিখেছেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ একডালা দূর্গ থেকে ভাঙের নেশায় সৈন্য সামন্ত নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত হয়েছেন (?)। এরকম হাস্যকর কথা লেখায় ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনীর প্রতি পরবর্তীকালে বাঙালি ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন-যে সুলতান ভাঙ খেয়ে চব্বিশ ঘন্টা পড়ে থাকেন তিনি এমন অসাধারণ রণকৌশলের অধিকারী হন কি করে? দিল্লির ভাড়াটে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনী লিখেছেন: ‘বিকালের মধ্যে দিল্লীর বাহিনী জয়লাভ করল, লুটের মাল হস্তগত করল এবং বাংলার সৈন্যের মৃতদেহে জায়গাটা ভরে গেল। দিল্লীর সৈন্যদের মাথার একটি চুলও নষ্ট হল না।
’
একেই বলে বেতনভুক ঐতিহাসিকের প্রলাপ! এরকম সত্যের অপলাপ এসব ভাড়াটে ইতিহাসে-লেখকেরা আরও করেছেন। যেমন: সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলায় আসার আগে দিল্লিতে চাকরি করতেন। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এইসব ভাড়াটে লেখক লিখেছে, ইলিয়াস শাহ ‘অপকর্ম’ করে দিল্লি থেকে বাংলায় পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, কি অপকর্ম করেছিলেন? সে বিষয়ে এসব ভাড়াটে লেখকগণ একেবারেই নিশ্চুপ।
সে যাই হোক।
জিয়াউদ্দীন বারনীর আগের মন্তব্য পড়ে মনে হয় যেন সুলতান ইলিয়াস শাহ স্বয়ং একডালা দূর্গ থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু বারানী তো লিখেননি যে ...সেই যুদ্ধে বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহ যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তাহলে ‘বিকালের মধ্যে দিল্লীর বাহিনী জয়লাভ করে’ কেমন করে? যুদ্ধে এক পক্ষের সুলতান নিহত না-হলে অন্য পক্ষ যুদ্ধে জেতে কি ভাবে? আসলে ইলিয়াস শাহ একডালা দূর্গেই অবস্থান করছিলেন। কিছু হাতিসহ কিছু সৈন্য দূর্গের বাইরে পাঠিয়ে তাদের দিল্লির বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ করিয়ে ফিরোজ শাহ তুঘলককে বিভ্রান্ত করেছিলেন। এই পদক্ষেপটিও তাঁর রণকৌশলের অন্তর্গত বলে মনে হয়।
ফিরোজ শাহ তুঘলক হাতি পেয়ে বলেছিলেন, ‘এ হাতি আমরা দিল্লি নিয়ে যাব। যার তার কাছে এত বড় হাতি থাকা ঠিক না। আর আমরা তো এ যুদ্ধে জিতেই গেছি। ’ (তারিখ ই ফিরোজ শাহী)
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনী লিখেছেন: ‘দ্বিতীয় দিন তাঁর বাহিনীর (অর্থাৎ ফিরোজ শাহ তুঘলক- এর) সমস্ত লোক একডালা ধ্বংস করার জন্য এবং ইলিয়াসকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ফিরোজ শাহের অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু সুলতান এতে অনুমতি দিলেন না।
তিনি বলেন যে, বিরোধীদের অনেকে মারা পড়েছে, এখন আমাদের উচিত মুসলমান এবং আমাদের সৈন্যরা যারা নিরাপদে আছে তারা যাতে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে তার ব্যবস্থা করা। জয়ের পরে আর বেশি কিছু আশা করা উচিত নয়। অতঃপর সুলতানের আদেশে দিল্লী বাহিনী দিল্লীর দিকে রওয়ানা হল। ’
এখন প্রশ্ন হল দিল্লি যাওয়ার আগে তিনি পান্ডুয়ায় কাকে দিল্লির গর্ভনর নিযুক্ত করে গেলেন?
আসলে ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলায় পরাজিতই হয়েছিলেন। এবং বাংলার স্বাধীনতা যে অক্ষুন্ন রইল, সে জন্য সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর সমরকৌশল অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছিল।
বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর পরিকল্পনা মোতাবেক বন্যার পানিতে দিল্লির সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতি হয় । নইলে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক E.Thomas তাঁর Chronicles of the Pathan Kings of Delhi বইতে কেনই-বা লিখবেন ... The invasion only resulted in the confession of weakness, conveniently attribuied to the periodical flooding of the country.
বিশ্ব-ইতিহাসেও আমরা অনুরূপ সার্থক রক্ষণাত্বক সমরকৌশল অবলম্বন করার ঘটনা লক্ষ্য করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিটলার নিয়ন্ত্রিত জার্মানির নাৎসী বাহিনী ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের উদ্দেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। এই অভিযানের কোড নেইম ছিল: 'অপারেশন বারবারোসা’। অপারেশন বারবোসার সর্বমোট সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ লক্ষ (৩.৯ মিলিয়ন!); ওই অভিযানে মোটরযান ছিল ৬০০০,০০০ এবং ঘোড়া ছিল ৭৫০,০০০! জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ড থেকে মূল কমিউনিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব ছিল ১ হাজার ৮০০ মাইল!
অপারেশন বারবোসাই মানবইতিহাসের সর্ববৃহৎ আগ্রাসন বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
অপারেশন বারবোসা সর্ম্পকে বলা হয়েছে: The ambitious operation, driven by Adolf Hitler's persistent desire to conquer the Russian territories, marked the beginning of the pivotal phase in deciding the victors of the war. The German invasion of the Soviet Union ultimately resulted in 95% of all German Army casualties from 1941 to 1944 and 65% of all Allied military casualties accumulated throughout the war. (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া) কিন্তু, অপারেশন বারবোসার এই ব্যর্থতার কি কারণ?
কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিন- এর পরিকল্পিত সমরকৌশল। স্তালিন ছিলেন একজন সমরকুশলী নেতা। তিনি নাৎসী বাহিনীকে প্রাকৃতি দুর্যোগের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাশিয়ার ভয়ানক শীত।
রাশিয়ার তীব্র শীতে সৈন্য চলাচল ব্যহত হয়েছিল।
স্তালিন পশ্চিমাঞ্চলের সোভিয়েত জনগনকে মাঠের ফসল এবং শষ্যভান্ডার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পুবের লেলিনগ্রাডের (ভুতপূর্ব সেন্ট পিটার্সবার্গ) দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিলেন। জোসেফ স্তালিন এর এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। কেননা, 27 November 1941, General Eduard Wagner, Quartermaster General of the German Army, reported "We are at the end of our resources in both personnel and material. We are about to be confronted with the dangers of deep winter. (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া) চতুদর্শ শতকে বাংলার এক সুলতান বাংলার বর্ষাকে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন আর বিংশ শতকের মাঝামাঝি সোভিয়েত প্রিমিয়ার স্তালিন সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষার্থে কাজে লাগালেন রাশিয়ার শীত।
সে যাই হোক। দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলায় পরাজিত হওয়ার অপমান সহজে ভুলতে পারেননি।
যে কারণে তিনি ১৩৫৯ সালে দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমন করেন। ততদিনে অবশ্য সুলতান ইলিয়াস শাহ মারা গিয়েছেন। এবং বাংলার সুলতান তখন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সেকান্দর শাহ (১৩৫১-৯৩)। ইনিও ছিলেন পিতার ন্যায় বীর এবং সাহসী। দিল্লির অধীনতা মানেন নি।
সুলতান সেকান্দর শাহ দ্বিতীয়বার দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক কে বাংলা থেকে হটিয়ে দেন। সেকান্দর শাহও একডালা দূর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক দীর্ঘকাল একডালা দূর্গ অবরোধ করে রাখেন। পরে দুপক্ষের সন্ধি হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলক ৮০০০০ টাকা মূল্যের একটি মুকুট এবং ৫০টি আরবি এবং তুর্কি ঘোড়া সুলতান সেকান্দর শাহ কে উপহার দেন।
সুলতান সেকান্দর শাহ বিনাবাধায় বাংলার ৩২ বছর শাসন করেন। বাংলার কোনও সুলতান এত দীর্ঘদিন শাসন করেননি। আর বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকার আনন্দঘন সাফল্যের স্মরণে বাংলার পেল ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এক অলঙ্কৃত এবং গঠনশৈলীর দিক থেকে এক অতুলীয় আদিনা মসজিদ। (লাহোরের বাদশাহী মসজিদটিই উপমহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ। ) পাঠ করুন: Adina Mosque was built in 1373 by Sultan Sikandar Shah, the second sultan of the Ilyas dynasty, the Adina mosque is one of the largest mosques to be built in the subcontinent and the only hypostyle mosque in Bengal. Located twenty kilometres North of the town of Malda and along a major road leading to north Bengal, the sultan probably built it as a visual proclamation of his victory over the Delhi ruler, Firuz Shah Tughluq. The mosque is mostly in ruins today following the damages sustained during the earthquakes in the 19th and early 20th centuries.
পান্ডুয়ায় আদিনা মসজিদটির অভ্যন্তরভাগ।
সুলতান সেকান্দর শাহর নির্দেশে নির্মিত এই মসজিদটির নির্মানকাল ১৩৭৪ থেকে ১৩৮৪ সাল। আদিনার মসজিদই বাংলার পাহাড়পুরের মতন বিশালাকৃতির বৌদ্ধ বিহারগুলির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপনা।
সুলতান ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক আবদুল করিম- এর একটি যথার্থ মন্তব্য দিয়ে এ লেখা শেষ করব। ঐতিহাসিক আবদুল করিম লিখেছেন, 'যেভাবে ইলিয়াস ফিরোজ শাহ তুঘলকের আক্রমন প্রতিহত করে স্বীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখেন তাতে তাঁর সমর নীতি জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। একডালা দূর্গে আশ্রয় নিয়ে তিনি এমন এক নীতি গ্রহন করেন যার ফলে ফিরোজ শাহকে বাংলাদেশ জয় না করে ফিরে যেতে হয়।
তিনি জানতেন যে বাংলাদেশের প্রতিকূল আবহাওয়ায় দিল্লীর সৈন্যদের পক্ষে বেশি দিন বাংলাদেশে থাকা সম্ভব নয়। '
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান; বাংলার ইতিহাস: ১২০৪-১৭৬৫; (অষ্টম পরিচ্ছেদ : ইলিয়াস শাহী বংশ)
এ. কে.এম আবদুল আলীম; ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস। (পঞ্চম অধ্যায়: তুঘলক বংশ)
গোলাম মুরশিদ; হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি (দ্বিতীয় অধ্যায়: ইন্দো-মুসলিম আমলের সংস্কৃতির রূপান্তর। )
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Adina_Mosque
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।