যে কোনো বিষয়ের তত্ত্ব, তাত্পর্য কিংবা সত্যকে অনুসন্ধান ও অনুধাবন করা পরিশ্রমের কাজ। এই পরিশ্রমটুকু স্বীকার না করে যে কোনো বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য প্রদান করা দায়িত্বহীনতার আলামত ছাড়া আর কিছু নয়। এ আলামত এ দেশে বরাবরই প্রদর্শিত হয়ে আসছে। দায়িত্বহীনতার এসব আলামত দেখে অবাক কিংবা ক্ষুব্ধ হওয়ার—অতএব—কিছুই নেই। দায়িত্বশীলতাই কেবল এ পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে।
অন্য অনেক বিষয়ের মতো বাংলার মরমী সাধক ও বাউল সাধকদের নিয়েও নানারকম বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রচার হয়ে আসছে। বাউল-সাধনা ও মরমী-সাধনাকে গুলিয়ে ফেলার মতো দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্ত অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তিও সৃষ্টি করে গেছেন। ফলে নতুন প্রজন্মের সামনে এটা একটা তালগোল পাকানো ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম বাউল সাধনা ও মরমী সাধনার মধ্যকার বিশাল ফারাকটুকু অনুমানও করতে পারছে না। তবে এর পেছনে কেবল দায়িত্বহীনতা নয়, মাঝে মাঝে ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধও নাকে এসে লাগে।
বাউল সাধনা ও মরমী সাধনা সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি পথে। বাউল সাধক ও মরমী সাধক কখনও একই পথে হাঁটেন না। তাদের গন্তব্যও এক নয়। ফলে তাদের জীবনধারা ও ভাবকল্পনা সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা যেমন আউল বাউলের দেশ; তেমনি মরমী ফকিরের দেশও।
বাউলের আছে ‘আখড়া’, ফকিরের আছে ‘আস্তানা’। বাংলার দু’টি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে রয়েছে এদের নাড়ির সম্পর্ক। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক মরমী সাধকদের; আর হিন্দু ধর্মের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক বাউল সাধকদের। বাউল সাধক ও মরমী সাধকদের জীবনধারা অবলোকন করলেই এ সত্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপরও যখন অনেক মরমী সাধকের নামের সঙ্গে কেউ কেউ ‘বাউল সাধক’ প্রতিস্থাপন করেন; অথচ বাউল সাধকের নামের সঙ্গে কখনও ‘মরমী সাধক’ প্রতিস্থাপন করতে দেখা যায় না, তখন ষড়যন্ত্রের আঁচটাও খুব সহজে টের পাওয়া যায়।
বাউল সাধক ও মরমী সাধকের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাংলায় উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণাকর্ম হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। উভয় সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ হলেও পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিশেষ কোনো কাজ হয়নি। এসব কাজ যারা করতে পারতেন তারাই বরং বিষয়টিকে অনেক বেশি গুলিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ আছেন তেলের সঙ্গে জল মেশানোর কাজে। তারা তেল আর জল একাকার করতে পারছেন না, তবুও সাধনা চালিয়েই যাচ্ছেন।
‘লোকায়ত’ শব্দের আড়ালে এ ব্যর্থ সাধনা চলছেই। যেহেতু ‘লোকায়ত’ শব্দ দ্বারা সবাইকে এক কাতারে টেনে আনা যায়, সে কারণেই এ শব্দের বর্ম জড়িয়ে তেল আর জলকে একাকার করার সাধনায় একদল মানুষ লিপ্ত আছেন। এরা কখনোই নিজেরা নিজেদের অতিক্রম করতে পারেন না। ফলে সংস্কারগ্রস্ত হয়ে লোকায়ত বিদ্যায় হাবুডুবু খান।
লোকায়ত বিদ্যাধারীদের চোখে আঙুল দিয়ে প্রকৃত সত্য কেউ কেউ দেখিয়ে দিলেও তারা তাদের অন্ধত্বের কারণে তা দেখতে পান না।
গ্রামবাংলার সেই প্রবাদ বাক্যের মতো তারা দাদার নির্দেশে ‘ওদা’ ধান ভানতেই থাকেন। প্রবাদটি খুবই চমত্কার—‘দাদায় কইছে ভাইনতে ধান/ভাইনতে আছি ওদা ধান’। ‘ওদা’ মানে ভেজা কিংবা শুষ্ক নয় এমন। ওরকম ধান কিছুতেই ঢেঁকিতে ভানা যায় না। কিন্তু দাদা যেহেতু নির্দেশ করেছেন ধান ভানতে, অতএব ধান ভানার কাজে লেগে গেছি; অথচ ধান যে ‘ওদা’ সেদিকে নজরই দিচ্ছি না।
এরকম একটি দৃষ্টান্ত শাহ আবদুল করিম। খুব বেশিদিন হয়নি তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের আগে ও পরে সমানে তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ বলে অভিহিত করছে এদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম ও লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীরা। কেউ একজন তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ বলল, তো সবাই তাঁকে এক বাক্যে ‘বাউল সম্রাট’ নামে ডাকা শুরু করল—যদিও তিনি কোনো অবস্থাতেই লালন, হাসন, এমনকি জালালউদ্দীনের স্তরেও উঠতে পারেননি। তদুপরি তিনি সম্রাট, বাউল তো বটেই।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। দেখা যাক বাউল সাধক ও মরমী সাধকের প্রকৃতি। বাউলদের কাছে সংসার এবং সমাজ উভয়টাই পরিত্যাজ্য। জীবনের জৈবিক প্রয়োজনে তারা সাধনসঙ্গী সন্ধান করে; আর মানুষের দেয় ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে—‘তাহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই।
তবে সমাজ তাহাদের ছাড়িয়ে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন—আমরা পাগল, আমাদের ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই। বাউলের অর্থ বায়ুগ্রস্ত পাগল। ’ [বাংলাদেশে বাউল চর্চা ও আমরা/আরিফুল হক]
এবার একটু জানা যাক বাউলদের আচার সম্পর্কে। বাউল গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ‘বাংলার বাউল’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—‘বাউল সম্পর্কে দ্বিতীয় যে চিন্তা-ভাবনা বহু মানুষের মনে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল অথবা বিদ্বেষ টেনে এনেছে সেটা চারিচন্দ্র ভেদ। অর্থাত্ মল-মূত্র, রজঃবীর্য পান।
’ [কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ, বাউল বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা, ৪ঠা মাঘ ১৩৯৮]
বাউলদের এই প্রকৃতি ও আচারের সঙ্গে কোনো মরমী সাধকের প্রকৃতি ও আচারের কোনো মিল আছে বলে কেউ দেখাতে পারবেন না। মরমী সাধকরা সব সময় ইসলামের মূল শিক্ষার অনুকূলে তাদের বয়ান রচনা করেছেন। কেউ কেউ বলতে পারেন বা দেখাতে পারেন যে মরমী সাধকরা সংসারবিরাগী ছিলেন, কিন্তু এ বিষয়টিও তারা প্রমাণ করতে পারবেন না। মরমী সাধকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা হতে মুক্ত থেকে ভোগ-বিলাসকে প্রত্যাখ্যান করায় আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে সংসারবিরাগী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ভোগবাদের প্রতিকূলে তারা সব সময় সংসারেরই অনুরাগী এবং তাদের বয়ান কিংবা গীত্ সব সময় সংসারকে কেন্দ্র করেই। তারা ইহকাল ও পরকালকে মিলিয়ে এক বৃহত্ সংসারের আকাঙ্ক্ষা করতে পারেন বলেই তারা মরমী।
তাদের কাছে জগতের সঠিক মর্ম ধরা দেয় বলেই তারা মরমী। তাদেরকে ফকিরও বলা হয়, যা কিনা ‘ফকিহ’ শব্দ থেকে এসেছে। আর ‘ফকিহ’ হচ্ছেন ‘ফিকাহ’ সম্পর্কে উচ্চজ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি। এখানে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে—সব মরমী ফকির যেমন সত্যিকার মরমী ফকির নন, তেমনি সব বাউল সাধকও সত্যিকার বাউল সাধক নন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণেও অনেকে ফকির কিংবা বাউল সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন অথবা তাদের বেশ ধারণ করেন।
বাংলাদেশের মরমী সাধকদের মধ্যে ফকির লালন শাহ, ফকির দুদু শাহ, ফকির পাঞ্জু শাহ, হাসন রাজা, জালালউদ্দীন, উকিল মুন্সি, শাহ আবদুল করিম কিংবা আবদুর রহমান বয়াতীর মতো মরমী সাধক, শিল্পী, কবিদের সঙ্গে বাউল সম্প্রদায়ের আদৌ কি কোনো মিল আছে? বাউলদের বয়ানের সঙ্গে এসব মরমী সাধকের বয়ানেরও কি আদৌ কোনো মিল আছে? এ বিষয়টিই একবার পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রীকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী হাসন রাজাকে ‘বাউল’ বলে উল্লেখ করায় হাসন রাজারই পৌত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের বিষয়, সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী হাছন রাজাকে বাউল শিল্পী বলে দাবী করেছেন। তার এ দাবীর মূলে ভাবপ্রবণতা ছাড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। ... ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর হয়তো জানা নেই যে, হাসনরাজা যৌবনেই সৈয়দ মাহমুদ আলী নামক এক পাঞ্জাবী দরবেশের হাতে মুরীদ হন। এই মাহমুদ আলী সাহেব ছিলেন চিশতিয়া তরীকার পীর।
তিনি শেষ বয়সে সিলেট সদরের নিকটবর্তী বনকেলিতে স্থায়ীভাবে বাস করেন এবং এখানেই ইন্তেকাল করেন’ [মাসিক মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬২] হাসন রাজা যেমন মাহমুদ আলীর কাছে বাইয়্যাত নিয়েছিলেন, ফকির লালন শাহ তেমনি বাইয়্যাত নিয়েছিলেন সিরাজ সাঁইর কাছে। দুদু শাহ্ পাঞ্জু শাহ তো ছিলেন লালনেরই মুরিদ। এমনকি হাল-আমলে হুমায়ূন আহমেদ যে উকিল মুন্সির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, এই উকিল মুন্সি নিজেই ছিলেন মসজিদের ইমাম। বাংলায় জারি, সারি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, মারফতি, ভাটিয়ালি গানের ধারা সূচনা ও ঋদ্ধ করেছেন ইসলামী আধ্যাত্মিক ধারার এসব মরমী সাধকরা। এরা যে সবাই সব সময় শুদ্ধ, লোকাতীত ইসলামী ধারার চর্চা করেছেন এমন নয়, তবে ইসলামের মৌল-বিশ্বাস দ্বারাই জারিত ছিল এদের ভাবনার জগত।
ফলে বাউলদের মতো এরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। তাদের বয়ানে জগত্-সংসারে মানবসৃষ্ট সঙ্কট সম্পর্কে যেমন আমরা ধারণা লাভ করতে পারি, তেমনি উত্তরণের উপায় সম্পর্কেও লাভ করতে পারি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। আরিফুল হক তার ‘বাংলাদেশে বাউল চর্চা ও আমরা’ শীর্ষক রচনায় এদেরকে আউলিয়া-দরবেশদের ধারাবাহী বলে উল্লেখ করেছেন। আরিফুল হকের এ বক্তব্যকে কোনোভাবেই প্রত্যাখ্যান করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
আরেকটি বিষয় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়।
সেটি হচ্ছে ক্ষ্যাপা বাউল আর ক্ষ্যাপী বাউলের বিষয়। মুসলিম মরমী সাধকদের আস্তানায় আমরা নারীদের দেখি না। তাদের অবস্থান আস্তানার পাশেই অন্দর মহলে কিংবা তাদের নিজ নিজ গৃহে। অন্যদিকে ক্ষ্যাপী আর ক্ষ্যাপারা একসঙ্গেই তাদের আখড়ায় সময় যাপন করে, সাধনা করে। ধর্মের নামে তাদের বিকৃত ভোগের পথকে নির্বিঘ্ন করার জন্যই তারা নিজেদের অসামাজিক মানুষে পরিণত করে।
অন্যদিকে মুসলিম নারীরা অনুসরণ করে রাবেয়া বসরীকে, যিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচুদরের একজন মরমী কবি।
যদিও বাউল সাধক এবং মরমী সাধকদের মধ্যে একটি জায়গায় খুব মিল পাওয়া যায়; তবুও সেটি উভয়ের বাহন মাত্র। মরমী সাধকরা জীবনসাধনার অংশ হিসেবে সঙ্গীতকে বা গানকে গ্রহণ করেন, সৃষ্টি করেন, ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বাউল সাধকদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গান। এক্ষেত্রে গানই তাদের জীবনসাধনা।
অথচ মরমী সাধকদের মূল সাধনা হচ্ছে মরমে পৌঁছার সাধনা। সেই সাধনারই স্বতঃস্ফূর্ত উত্সারণ ঘটে তাদের গানে।
এখন এ প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই ওঠে—তাহলে কেন মরমী সাধককে ‘বাউল’ বলা হবে? কেন মরমী ধারার শিল্পী-সাধকদের সমবেত করে বলা হবে ‘বাউল উত্সব’? আর যদি সেটা সত্যি সত্যিই ‘বাউল উত্সব’ হয়, তাহলে এ বিকৃতাচার মানবসমাজের কোন্ কল্যাণ ডেকে আনবে? শুনেছি মহামতি প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবি-শিল্পীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে একটি শর্তে তাদের পুনর্বাসন করতে রাজি হয়েছেন। শর্ত হচ্ছে, তারা নগর রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। ‘বাউল’ যদি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কাজে না লাগে তাহলে কেন আমরা তাদের মর্যাদা দেব? তাদের ‘বিকৃত জীবন’ আর ‘ভাবের গান’ আমাদের কোন্ কাজে লাগবে? মানবজাতির না হোক সৃষ্টিজগতের অন্য কারও (প্রকৃতি ও প্রাণীজগত) মঙ্গলও কি তাদের দ্বারা সাধিত হতে পারে? হ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।