আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার দার্শনিক উত্তরাধিকার কিংবা বাংলার বাউল গান যে কারণে এত গভীর তত্ত্বদর্শী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ নারীর ওই সিন্ধুমাঝে /ভানুর এক কিরণসাজে/ তাহার মধ্যে প্রেমের বাঁচা রে/ মামুন নদীয়া বলে /চল সখী গহীন জলে / শুদ্ধপ্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী অধ্যাপক আহমদ শরীফ মনে করতেন: বাংলার বাউলমতে উদ্ভব ষোড়শ শতকে। অবশ্য বাউল দর্শনের শিকড়টি আরও সুপ্রাচীন কালে প্রোথিত । বাউল দর্শনের ভিতে আমরা সুপ্রাচীন সাংখ্যদর্শন-এর ছায়া দেখতে পাই।

প্রাচীন ভারতে ৬টি দার্শনিক মত ছিল। সাংখ্য, যোগ, মীমাংশা, বেদান্ত, ন্যায়, এবং বৈশেষিক। এই দার্শনিক মতগুলির মধ্যে সবচে প্রাচীন মত হল সাংখ্য দর্শন । সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা কপিল। জার্মান ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক Richard Garbe তাঁর Die Sāmkhya-Philosophie বইতে কপিলের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতক বলে নির্ধারণ করেছেন।

প্রাচীন বাংলার তত্ত্বজিজ্ঞাসু মানুষ সাংখ্যদর্শনের সঙ্গে পরিচিত ছিল। সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা কপিল সম্ভবত প্রাচীন বাংলার অধিবাসী ছিলেন। অনুমান করি, কপিলের জন্ম প্রাচীন বাংলায় হলেও পরে তিনি উত্তর ভারতে তাঁর দার্শনিক মতবাদটি প্রচার করেন। কিন্তু, সাংখ্য বলতে কি বুঝায়? সাংখ্য বলতে বোঝায় বিশুদ্ধ জ্ঞান। এ প্রসঙ্গে একজন ভারতীয় পন্ডিত লিখেছেন: The word Samkhya is based upon the Sanskrit word samkhya which means ‘number’. The school specifies the number and nature of the ultimate constituents of the universe and thereby imparts knowledge of reality. In fact, the term Samkhya also means perfect knowledge. Hence it is a system of perfect knowledge. আসলে সাংখ্য দর্শন হল দ্বৈতবাদী বাস্তবতা।

সাংখ্য দুটি চরম বাস্তবতার কথা বলে। (ক) প্রকৃতি (বস্তু) এবং (খ) পুরুষ (সত্তা)। সাংখ্য দর্শন এ দুটি বাস্তবতাকে সমান সত্য বা বাস্তব বলে মনে করে। সাংখ্যদর্শন আবার বহুত্ববাদী। যেমন পুরুষ এক নয়- বহু।

জৈনরা দাবি করে বিশ্ব পরমাণু দ্বারা গঠিত। এর বিরোধীতা করে কপিল বলছিলেন, না, তা সম্ভব নয়। কারণ সব সময় কার্যের চেয়ে সূক্ষ্ম। কপিল আরও বললেন, How can so gross atoms of matter can be the cause of such subtle and fine objects as mind and intellect? বরং কপিল বললেন: some finest and subtlest stuff or principle underlies all physical existence. কপিল names it as Prakriti. Prakriti is the primordial substance behind the world. It is the material cause of the world. Prakriti is the first and ultimate cause of all gross and subtle objects. ( প্রাচীন বাংলায় কপিলের মতো চিন্তাবিদ বেঁচে ছিলেন ভাবলে বিস্মিত হতেই হয়। ) ...যাই হোক।

কপিল মনে করতেন, প্রকৃতি হল অ-সত্তা। এর চেতনা নেই। এবং প্রকৃতি হল অবোধগম্য। একে, অর্থাৎ প্রকৃতিকে পুরুষ গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পুরুষের নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতি প্রকাশিত হয়।

প্রকৃতিতে রয়েছে তিনটি গুণ। স্বতঃ রজঃ এবং তমোঃ। স্বতঃ হল সুখ। রজঃ হল গতিময়তা এবং তমোঃ হল অজ্ঞতা ও নিষ্ক্রিয়তা। সাংখ্যদর্শন নিরেশ্ববাদী এবং বেদ বিরোধী হওয়ায় আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কপিলের বিরোধীতা করেছে এবং কপিলের মূল রচনাবলী নষ্ট করে ফেলেছে।

তাহলে আমরা কি ভাবে সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে জানতে পারলাম? প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক মহলের একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে-কোনও মত খন্ডন করার আগে সেই মতের পূর্ণ উল্লেখ করা। কাজেই কপিলের মতবাদ খন্ডন করার আগে আর্যপন্ডিতেরা কপিল-এর সাংখ্যদর্শনের পূর্ণাঙ্গরূপে উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া খ্রিষ্টীয় ২০০ শতকে ইশ্বরকৃষ্ণ নামে একজন পন্ডিত সাংখ্যদর্শনের ওপর ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে একটি গ্রন্থরচনা করেছিলেন। ওই গ্রন্থটি সাংখ্যদর্শনের ওপর একটি মূল্যবান তথ্যের উৎস। কপিল প্রাচীন বাংলার প্রথম শিক্ষাগুরু।

প্রাচীন বাংলার মেধাবী সন্তান কপিল ছিলেন স্বাধীন মতবাদে বিশ্বাসী। বাংলা আজও তাঁকে মনে রেখেছে। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন: আমার তো কপিলে বিশ্বাস / প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ ... ( সোনলি কাবিন) ... (অর্থাৎ, দার্শনিক কপিলের মতো স্বাধীন মতবাদে আমি বিশ্বাসী ... আমার প্রেমকে টিকিয়ে রাখতে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় মঠের (বা সংঘের) প্রয়োজন নেই। ) কিন্তু, সত্যিই কি কপিলের জন্ম প্রাচীন বাংলায় হয়েছিল? আমাদের সেরকমই বিশ্বাস। কেননা, প্রাচীন বাংলার মানুষ সাংখ্যদর্শন গ্রহন করেছিল বলে প্রাচীন বাংলার প্রতি উত্তর ভারতের আর্যসমাজের ক্ষোভ ছিল।

তারা বলত প্রাচীন বাংলার লোকেরা পাখির ভাষায় (কাক-চেটকসদৃশ) কথা বলে। আর্য শাস্ত্রকার বৌধায়ন তাঁর ‘ধর্মশাস্ত্রে’ উল্লেখ করেছেন, বাংলায় গেলে প্রায়শ্চিত করতে হবে! প্রাচীন বাংলার দ্বিতীয় শিক্ষাগুরু গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধ অবশ্য প্রথম জীবনে সাংখ্যমত গ্রহন করেছিলেন। বুদ্ধের অনেক আগেই কপিল বলেছিলেন: মানুষ যেসব দুঃখ ভোগ করে, সেইসব দুঃখকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: ক. আধ্যাত্বিক। খ. আদিভৌতিক।

এবং গ. আধিদৈবিক। কপিলের মতে, দুঃখকে এড়ানোর পথ হল দর্শনের চর্চা। বুদ্ধও বললেন, জগৎ দুঃখময়। কতগুলি নীতি (ধম্ম?) মেনে চললে দুঃখের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কপিল অহিংসমত মত প্রচার না করলেও বুদ্ধ অহিংস মত প্রচার করেছেন।

বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর অহিংস মত গ্রহন করে প্রাচীন বাংলা। এ কারণেই প্রাচীন বাংলার দ্বিতীয় শিক্ষাগুরু গৌতম বুদ্ধ। একাদশ শতকে সেন রাজাদের শাসন অবধি বৌদ্ধধর্ম বাংলায় অব্যাহত ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধধর্মকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। (কপিলের প্রতিও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করেছিল তারা)।

বাংলা বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় দিয়েছিল। দীর্ঘ চার শতাব্দী ধরে বাংলায় পাল রাজাদের শাসন অব্যাহত ছিল। এ সময়ে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশলাভ করেছিল। তান্ত্রিক বৌদ্ধ কবিদের লেখা চর্যাপদের কথা আমরা জানি। চর্যার সে রকম একটি পদ এ রকম: তো বিনু তরুনি নিরন্তর ণেহে/ বোধি কি লভ ভই প্রণ বি দেঁহে।

অর্থাৎ, হে তরুণি তোমার নিরন্তর স্নেহ ছাড়া কি ভাবে এই দেহে বোধিলাভ হয়? জ্ঞানের জন্য নারীর সান্নিধ্যলাভ-এ যেন তন্ত্রের পথ খুলে যাচ্ছে। প্রাচীন বাংলার মেধাবী ভাবুকগন কেবল সাংখ্য ও বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়ে থাকেনি। তাঁদের বিদগ্ধ মননের ফলে প্রাচীন বাংলায় তন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল। তন্ত্রের একটি প্রধান সিদ্ধান্ত হল: “যা নাই দেহভান্ডে তা নাই ব্রহ্মান্ডে। ” অর্থাৎ সবই এই দেহে বিরাজমান।

তন্ত্রের এই শরীরবাদী উক্তিটি দেহপ্রধান বাউলদর্শনের প্রতিও ইঙ্গিত করে। কেননা বাউলের বিশ্বাস ‘মনের মানুষ’ বাউলের দেহেই বাস করেন। তন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর নারীপ্রাধান্য। বাউলধর্মেও নারীপ্রাধান্যের কথা আমরা জানি। স্বয়ং লালন বলেছেন, নারী হও।

নারী ভজ। লালন এর একজন গুরু গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের পথিকৃৎ শ্রীচৈতন্যদেব বলেছেন: আমার হৃদয়ে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ। এই দুই মহাত্মার ওপর কিছুমাত্র হলেও তন্ত্রের প্রভাব পড়েছিল। শুধু তাই নয় তন্ত্রের প্রভাবে বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম দুটিও তান্ত্রিক হয়ে ওঠে। বাংলাপিডিয়ায় দুলাল ভৌমিক লিখেছেন:‘তন্ত্রের উদ্ভব বাংলায়।

এবং তা পরে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ’ এবং তন্ত্রের কারণেই দূর্গাপূজা বাংলার বাইরে ভারতবর্ষের অন্যত্র অনুষ্ঠিত হয় না। এবং দেবী দূর্গা হলেন আদ্যশক্তি। ‘মাটির ময়না’ ছবির সেই গানটি (যদি আল্লার সন্ধান চাও গো / প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর) স্মরণ করুণ। যেখানে বৃদ্ধ গাইছে ... নারী হইল আদিবস্তু সৃষ্টি যারে দিয়া ...যাই হোক।

‘ভারতীয় তন্ত্র’ (আসলে বাংলার তন্ত্র) নিয়ে পশ্চিমে কৌতূহলের অন্ত নেই। পাঠ করুন: David Gordon White লিখেছেন: its (অর্থাৎ তন্ত্রের) key principle is that the universe we experience is the concrete manifestation of the divine energy that creates and maintains it: Tantric practice seeks to contact and channel that energy within the human microcosm by means of ritual in order to achieve creativity and freedom (Wikipedia) আমি মনে করি, বাংলায় তন্ত্রের বিকাশ হয়েছিল কপিলের সাংখ্য দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই। (যেভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার নৈতিকতা বিকাশ লাভ করেছিল বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে। ) কপিলের একটি বহুবিখ্যাত উক্তি হল: ‘প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মক চঞ্চলা, পুরুষ অপ্রধান। ’ ‘প্রকৃতি’কে নারী ধরে নিলে কপিলের উক্তিটির এক বিশেষ অর্থ দাঁড়ায়।

সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে উত্তর ভারতের ব্যাখ্যা অবশ্য আলাদা। সে সম্বন্ধে প্রথমেই উল্লেখ করেছি। বাংলা নিজস্ব ভাবধারা অনুযায়ী সাংখ্যদর্শন ব্যাখ্যা করছে। সে রকমই অবশ্য হওয়ার কথা। সাংখ্যের লীলাভূমি বাংলার রয়েছে সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।

যা আজও বহমান। বাউলগানে এবং বাংলার লোকায়ত ধর্মমতে। আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘লালনের গানে এই মীনরূপ সাঁইকে ধরার প্রয়োজন ও কৌশল বর্ণিত হয়েছে: সময় বুঝে বাঁধাল বাঁধলে না। জল শুকাবে মীন পালাবে পস্তাবি রে মন-কানা। মাস-অন্তে মহাযোগ হয় নীরস হতে রস ভেসে যায় করিয়ে সে যোগের নির্নয় মীনরূপে খেল দেখলে না।

পুরুষ ও প্রকৃতির একটি বিশেষ পক্রিয়ার মিলনধারায় এই মীনরূপ সাঁইকে ধরতে হয়। ’ (লালন সাঁইয়ের সন্ধানে। পৃষ্ঠা:৩৮) বাংলার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট হল তার লৌকিক ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, বাংলায় প্রতিমুহূর্তে লোকধর্ম সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

(স্মৃতি থেকে লিখছি বলে রবীন্দ্রনাথের অবিকল উক্তিটি স্মরণ করতে পারছি না। ) তবে বাংলার লৌকিক ধর্মের অস্তিত্ব অনুভব করা অত সহজ না। কারণ বাংলার ধর্ম বলতে আমরা মূলত হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মই বুঝি-এর বাইরে আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব থাকতে পারে তা যেন আমাদের বিশ্বাস হয় না। তবুও যুগযুগ ধরে বাংলায় লৌকিক ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। এবং এটাই সত্য।

বাংলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকর্ধম হল: কর্তাভজা, কিশোরীভজন, জগোমোহিনী, ন্যাড়া, বলাহাড়ি, বাউল, মতুয়া, সাহেবধনী। এসব লোকধর্মের সাধনপদ্ধতির অন্যতম হল সংগীত। এসব লোকধর্মের ওপর সাংখ্য বৌদ্ধ ও তন্ত্রের স্পস্ট প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলার লোকধর্মের প্রবক্তাগণ সমাজে উচ্চশ্রেণি কর্তৃক কোণঠাসা বলেই বৈশিষ্ট্যে বাংলার লোকধর্মসমূহ জাতপাতবিরোধী। সেই সঙ্গে তন্ত্রের প্রভাবে লোকধর্মমতগুলি হয়ে উঠেছে নারীবাদী ।

বাউল মামুন নদীয়ার একটি গানে রয়েছে ... নারীর ওই সিন্ধুমাঝে ভানুর এক কিরণসাজে তাহার মধ্যে প্রেমের বাঁচা রে মামুন নদীয়া বলে চল সখী গহীন জলে শুদ্ধপ্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী এর সঙ্গে তুলনীয় একটি চর্যাপদ (তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কবিতা) তো বিনু তরুনি নিরন্তর ণেহে বোধি কি লভ ভই প্রণ বি দেঁহে। বাংলার অন্যতম একজন লোকধর্মগুরু হলেন বরিশালের মীননাথ । ইনি ছিলেন নাথধর্মের প্রবক্তা। মীননাথ-এর সময়কাল ১০ম থেকে ১২শ শতক। (দেখুন: বাঙালির ইতিহাস।

নীহাররঞ্জন রায় পৃষ্ঠা: ৫৩১) মীননাথের জন্ম হয়েছিল চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল)। পেশায় ছিলেন জেলে। মীননাথের শিষ্যদের বলা হয় নাথযোগী। বাংলার বাইরে দক্ষিণ ও পশ্চিশ ভারত অবধি নাথধর্মের বিস্তার ছিল। পূর্বে একবার উল্লেখ করেছি যে বাংলায় তন্ত্রের প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম তান্ত্রিক হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর তেমনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ছিলেন । বাংলায় বৌদ্ধধর্ম কীভাবে তান্ত্রিক হয়ে উঠল? বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় কিছু দার্শনিক প্রশ্ন সম্বন্ধে নীরব ছিলেন। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ দার্শনিকগন সেসব দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেন। একটি অন্যতম দার্শনিক প্রশ্ন হল: সবকিছু উৎপত্তি হল কিভাবে? উত্তর ভারেতের বৌদ্ধদার্শনিকেরা উত্তর দিলেন সব কিছুর উৎপত্তি ‘শূন্য’ থেকে। এর বিরোধীতা করে বিক্রমপুরের মেধাবী বাঙালি তান্ত্রিকবৌদ্ধ দার্শনিকেরা বললেন, সবকিছুর উদ্ভব ‘বজ্র’ থেকে।

বজ্র কি? বজ্র হল নারীর এক বিশেষ গুণ। অপরদিকে ‘শূন্যতা’ হল বিমূর্ত ধারণ মাত্র । (মনে থাকার কথা সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে উত্তর ভারতের ব্যাখ্যা আলাদা। ) নারীকে প্রাধান্য দিয়ে এভাবেই বাংলার বৌদ্ধধর্ম হয়ে উঠল তান্ত্রিক। দার্শনিক বিশ্বাসে নারীপ্রাধান্যের কারণে আমরা বাংলাকে বলি: মাতৃতান্ত্রিক বাংলা।

অতীত দীপঙ্করের জন্মস্থান বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামটি আজও বৌদ্ধধর্মের নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক হয়ে ওঠার স্মৃতি বহন করছে। বৌদ্ধ ও তন্ত্রের পাশাপাশি বৈদিক আর্যদের ধর্ম ও দর্শন বাংলায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাংলায় আর্যধর্ম প্রকট হয়ে ওঠে একাদশ শতকে সেন আমলে। এ সময়ে বৌদ্ধদের দেবদেবী শিবের পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. আর এম দেবনাথ তাঁর “সিন্ধু থেকে হিন্দু” বইতে লিখেছেন, “বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের সময় এদের (অর্থাৎ লোকায়ত দেবদেবী) শিবের পক্ষভুক্ত করা ছাড়া বিকল্প ছিল না।

” ( পৃষ্ঠা ৯৬) তবে তা সহজে হয়নি। দীর্ঘকালীন এক সংঘাত চলেছিল। “বেহুলা লখিনদরের’ উপাখ্যানটি সেই দ্বন্দেরই প্রতিফলন। চাঁদ সওদাগর শিবের পূজারী। অন্যদিকে মনসা লোকায়ত দেবী।

চাঁদ সওদাগর মনসাকে ভজনা করবে না। শেষে মনসাকে শিবের স্ত্রীরূপে দেখিয়ে আপোষরফা হল। সে যাই হোক। সেন আমলে বিষ্ণু ও শিবের উপাসনার পাশাপাশি বেদান্ত তথা উপনিষদের বিশুদ্ধ ভাববাদী দর্শন বাংলার শিক্ষিতসমাজে আলোচিত হতে থাকে। দার্শনিক আলোচানা ছাড়াও বাংলার সমাজে পুরাণ ও বৈদিক পূজাপদ্ধতির চর্চা আরম্ভ হয়।

তবে আর্যদের বলিপ্রথা সেভাবে গ্রহনীয় হয়নি অহিংস বাংলায়। বলির বদলে তীর্থদর্শন ও পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাংলায়। তবে সেন আমলে বাংলার সমাজজীবনে জাতপাতের প্রাবল্য সমাজটিকে এতই ভঙ্গুর করে তুলেছিল যে- দ্বাদশ শতকে বহিরাগত সভ্যতার অভিঘাত সহ্য করতে পারেনি। বাংলায় জাতধর্মের বিরোধী সাম্যবাদী ইসলাম এল । যার ফলে মধ্যযুগীয় বাংলার সমাজটি কেঁপে উঠল তীব্রভাবে।

বাংলার সমাজের জাতপাতের বলি অচ্ছুতেরা এখন শুনল যে জাতপাতের উর্ধে উঠে একেশ্বর ভজনা (আল্লাহর এবাদত) সম্ভব। শূদ্র এখন কোরণ শ্রবণ করলে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দেওয়া হবে না, বরং তার অশেষ নেকি হাসিল হবে। কাজেই সমাজের কোণঠাসা অচ্ছুত জনমানুষের ঢল ছুটল পারসিক কিংবা ইয়েমেনি পিরের খানকায় (আস্তানায়)। দীর্ঘদেহি পিরের নূরানী চেহারায় সে মুগ্ধ। উচ্ছ্বসিত।

সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহঃ) কে নিয়ে বিদিত লাল দাশ-এর একটি উচ্ছ্বসিত লোকগানের বাণী এরকম: সিলেট প্রথম আজান-ধ্বনি বাবায় দিয়াছে বাংলার নব্য মুসলিমসমাজে একদিকে শরিয়তের দীক্ষা। অন্যদিকে ইসলামী মরমিবাদ বা এলম আল তাসাউস (সুফিবাদ)-এর বিচিত্র ব্যাখ্যাবয়ান প্রচারিত হতে থাকে। এর পাশাপাশি পিরের মাজারের আঙ্গিনায় প্রতীকবাদী হুঁশহীন সুফি গান বাঙালির হৃদয়কে আকর্ষন করতে থাকে। আর সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এককালে এদেরই পূর্বপুরুষ যে কপিল ও বুদ্ধের মতবাদে আকর্ষন বোধ করেছিল।

এখন নতুন যুগের নতুন বয়ান। শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি আলীপন্থি সুফিবাদ বাংলায় বিকাশ লাভ করেছিল। একটি গানে সে গূঢ়কথা এভাবে প্রকাশিত: আমার বাবা আলহাজ আলী যার কাছে মারফতের কলি ... এভাবেই বাংলার সুফি ও বাউলগানে সুপ্রাচীন সাংখ্য দর্শন থেকে বৈষ্ণব ও সুফিবাদের প্রভাব পড়েছে। এ কারণে বাউল গান এত গভীর এত তত্ত্বদর্শী হয়ে উঠেছে। বাংলার সমৃদ্ধ দার্শনিক উত্তরাধিকার বাংলার বাউল গানকে সমৃদ্ধ করেছে।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার কৃষিসমাজের সমাজের মানুষ ছিল চিন্তাশীল । তারা উচ্চতর চিন্তাকে প্রাধ্যান্য দিত। উচ্চতর চিন্তাকে লালন করত। বাংলার বিস্ময়কর প্রকৃতিই বিশাল বিশাল সব নদী বাংলার মানুষকে ভাবুক করে তুলেছে। যে কারণে বলা হয় বাংলাদেশ কবির দেশ।

এদেশে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছে। এ দেশে এক কালে কপিলেরও জন্ম হয়েছে। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর লেখা The Discovery of India বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখি, জার্মান ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে লিখেছেন, `In Kapila’s doctrine, for the first time in the history of the world, the complete independence and freedom of the human mind, its full confidence in its own powers were exhibited. ( P.184) এ লেখার প্রারম্ভে উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক Richard Garbe তাঁর উরব Die Sāmkhya-Philosophie বইতে কপিলের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতক বলে নির্ধারণ করেছেন। ইউরোপীয় পন্ডিতগন গ্রিক দার্শনিক থালেসকে দর্শনের জনক মনে করেন। থালেস এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৬২৪-৫৪৬।

দেখা যাচ্ছে থালেস- এর অনেক আগেই কপিল তাঁর দার্শনিক মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। তাহলে কি দর্শনের উদ্ভব প্রাচীন গ্রিসে নয়, প্রাচীন বাংলায় হয়েছিল? নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) আবুল আহসান চৌধুরী : লালন সাঁইয়ের সন্ধ্যানে ড. আর এম দেবনাথ: সিন্ধু থেকে হিন্দু http://www.srds.co.uk/begin/samkhya.htm http://indianphilosophy.50webs.com/samkhya.htm মামুন নদীয়ার গানটির ডাউনলোড লিঙ্ক Click This Link O Dhaka/Maarefoter Potaka/05 - Maqsood O Dhaka - Fokiri (Extelligence Explained) (music.com.bd).mp3.html ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.