পঁচা মানুষ নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত একজন চিকিৎসকের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এইচপিএসপির আওতায় প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেয়। তখন কর্মসূচিতে উল্লেখ করা হয়, প্রত্যেকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশন চালু করা হবে। এ কর্মসূচিটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কিন্তু এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত জনশক্তিরও প্রয়োজন ছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য একজন চিকিৎসক, একজন অ্যানেসথেসিয়ালজিস্ট, দুইজন নার্স, একজন বস্নাড ট্রান্সফিউশনকারীকে একবছর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। মেডিকেল কলেজগুলোতে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এজন্য অবস অ্যান্ড গাইনি সোসাইটি, অ্যানেসথেসিয়া সোসাইটির কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। তারা সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে।
জনবল তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ এবং প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশন চালুর জন্য অপারেশন থিয়েটারকে (ওটি) আধুনিকায়নকরণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার তা দেয়ার আশ্বাস দেয় বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্পের জন্য জাইকা, ইউএনএফপিএসহ বেশকয়েকটি দাতা সংস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি জোট গঠন করে।
দেখা দিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউনিসেফ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করলেও বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিলম্বিত করতে থাকে। একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ, একজন এনেসথিয়ালজিস্ট, একজন প্রজনন স্বাস্থ্যসম্পর্কিত প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার জন্য একটি তালিকা নির্ধারণ করে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর (সিএমএসডি)'র কাছে জমা দেয়া হয়। পরে তা বিশ্বব্যাংকের কাছেও পাঠানো হয়।
কিন্তু কমিটির নির্ধারিত তালিকা বার বারই ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক থেকে ফেরত পাঠানো হয়। কমিটির সদস্যরা সংশোধন করে তালিকা পাঠালেও ওই একই প্রতিউত্তর দেয় বিশ্বব্যাংক। এভাবেই চিঠি চালাচালি করে পার করে দেয়া হয় দুই বছর।
এদিকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে কাজ করতে না পেরে চিকিৎসকরা অনেকটা অলস সময় কাটাতে থাকেন। রোগী আসলেও তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে কাজ করতে পারছিলেন না।
বারবার কমিটির পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক থেকে এক সময় বলা হলো, তালিকা প্রস্তুতকারী কমিটির সদস্যরা অযোগ্য। এছাড়া যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কমিটির সুপারিশকৃত কোম্পানিকেও বিশ্বব্যাংক পছন্দ করেনি। বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয়, তাদের নির্ধারিত একটি কোম্পানিকে ওই কাজের জন্য নির্বাচিত করলে তালিকা অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। শুধু তাই নয় বিশ্বব্যাংক থেকে আরও বলা হয়, এ শর্তে রাজি হলেই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে। অথচ সরকারি টেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী যে কোম্পানি সর্বনিম্ন তাকেই কেবল টেন্ডার দিতে হবে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত কোম্পানি তালিকায় সর্বনিম্ন ছিল না। আন্তর্জাতিক বাজারে যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে কমিটিকে পুনরায় টেন্ডার জমা দেয়ার জন্যও বিশ্বব্যাংক থেকে জানানো হয়।
টেন্ডারের ভিত্তিতে কোন কোম্পানিকে কাজ দিতে হবে বিশ্বব্যাংক কোন প্রকার চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। এটা আইনগতভাবেও ঠিক নয়। কিন্তু তখন এ আইনের তোয়াক্কা করেনি বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের এ গড়িমসির কারণে উক্ত প্রকল্পের কাজ শুরুর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়তে হয়। তখন স্বাস্থ্য সচিব ছিলেন আলমগীর ফারুক। কাজ শুরু করতে দেরি দেখে স্বাস্থ্য সচিব কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি সভা ডাকলেন। উক্ত প্রকল্প চালুর কোন বিকল্প উপায় বের করা যায় কিনা এটা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। সভায় বিস্তারিতভাবে সব জানানো হলো।
তখন কমিটিতে আলোচনা হয়, প্রয়োজনীয় জনবলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পেছনে যেহেতু ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই তাদের অর্থ বিনিয়োগ করে ফেলেছে, সেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য ইউনিসেফের সহায়তা চাইলে কেমন হয়? তারা সহায়তা করলে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩২টি উপজেলায় এ সিজারিয়ান অপারেশন চালু করা সম্ভব হবে।
এ আলোচনার পর নভেম্বর মাসে স্বাস্থ্য সচিব স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অফিসে ইউনিসেফের আঞ্চলিক প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আরেকটি সভা ডাকলেন। সভায় কমিটির নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনিসেফকে ওই প্রকল্প শুরুর ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। তখন ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হলো, এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা নাই। তবে তারা বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য তিন মাসের জন্য সময় চেয়ে নেয়।
কথা অনুযায়ী মার্চ মাসেই ইউনিসেফ সহায়তার হাত বাড়ায়। তখন ইউনিসেফের সহায়তায় ৩২টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশন করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোন সাহায্যই করেনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।