৩০ শে মার্চ ১৯৮১ ওয়াশিংটন ডিসি। ৭০ বছর বয়সী রোনাল্ড রিগান (১৯১১- ২০০৪) যুক্তরাস্ট্রের ৪০ তম প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মাত্র ৬৯ দিন হল। তিনিই ছিলেন যুক্তরাস্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় সবচাইতে বয়স্ক আর অবিতর্কিত প্রেসিডেন্ট।
ঐদিন বেলা ২:৩৭ মিনিটে ওয়াশিংটন ডিসির 'ওয়াশিংটন হিলটন হোটেল' থেকে একটা বক্তৃতার পর্ব শেষ করে বেরুচ্ছেন। প্যাসেজ ওয়েটা এতই নিরাপদ যে ওটার নামই 'প্রেসিডেন্ট'স ওয়াক'।
গাড়ী থেকে কয়েক ফুট দুরে প্রেসিডেন্ট।
এমন সময় খুনী জন হিংকলে জুনিয়র প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য পর পর ছয়টা করে গুলি করেন।
'ওয়াশিংটন হিলটন হোটেল' যেখানে প্রেসিডেন্ট গুলি খাওয়ার আগে বক্তৃতা করেন।
উপরে প্রথম ছবিতে গুলি খাওয়ার আগ মুহুর্তে জনতাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান।
দ্বিতীয় ছবিতে গুলি করা হয়ে গেছে সিক্রেট সার্ভিস গার্ডরা আততায়ীকে ধরার জন্য এগোচ্ছে।
তৃতীয় ছবিতে প্রেসিডেন্ট রিগান ডানদিকের গাড়ীটার ভিতরে ঢুকে পড়েছেন, সিক্রেট সার্ভিস সক্রিয়, সবাই আততায়ীর দিকে ধাবমান।
চতুর্থ ছবিতে ওয়াশিটন ডিসির পুলিশ অফিসার থমাস ডেলাহন্টি (সবার সামনে কাল সুট পড়া) আর তার পরেই প্রেস সেক্রেটারী জেমস ব্র্যাডি (হালকা আকাশী সুট, পেছনটা দেখা যাচ্ছে) গুলি খেয়ে আহত হয়ে পড়ে আছেন। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট রবার্ট ওয়ানকো (ছাই রংএর সুট পড়া দাড়ানো) একটা উজি সাব মেশিন গান ধরে পরিস্হিতি অনুয়ায়ী ব্যাবস্হা বা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত।
নীচে আততায়ী জন হিংকলে জুনিয়র (১৯৫৫-)
গুলিতে আহত প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারী জেমস ব্র্যাডির ছবি নীচে:
গুলিতে প্রেসিডেন্ট সহ আরো তিনজন আহত হন।
প্রেসিডেন্ট রিগানের পাঁজর ছুয়ে ফুসফুস ফুটো করে বুলেট হৃৎপিন্ডের ১ ইন্চি দুরে থেমে যায়।
এছাড়া প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, প্রেসিডেন্টের শরীরের অর্ধেক রক্ত বের হয়ে যায়।
আহতদের সবাই পরে ভাল হয়ে যান শুধু প্রেস সেক্রেটারী ব্র্যাডির শরীরের বাঁদিকটা চিরতরে প্যারালাইজড হয়ে যায়।
গুলি করার কারণ: আততায়ী জন হিংকলের একটা অবসেশন ছিল হলিউডের অস্কার জয়ী নায়িকা জুডি ফস্টারকে নিয়ে। জুডি ফষ্টারের ছবি নীচে:
জুডি ফস্টার অভিনীত Taxi Driver ছবিটি হিংকলে ১৫-১৬ বার দেখেন। সেই ছবিতে নায়ক ছিল রবার্ট ডি নিরো আর সেই ছবিতে প্রেসিডেনশিয়াল কেনডিডেট সিনেটরকে খুন করার ব্যাপার ট্যাপার ছিল।
তিনি জুডি ফস্টারকে প্রেম পত্রও লিখেন যদিও জুডি তার চিঠিকে কোন পাত্তাই দেয়নি। হিংকলে মনে করলেন ছবির নায়কের মত রিগানকে খুন করলে তিনি হিরো বনে যাবেন আর জুডি ফস্টার তার প্রেমে গদ গদ হয়ে যাবে।
তিনি থাকতেন টেক্সাসে, সেখান থেকে একটা 'গ্রেহাউন্ড' বাসে করে ওয়াশিংটন ডিসিতে আসলেন।
এসে উঠলেন পার্ক সেন্ট্রাল হোটেলে। পরদিন সকালে ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাতে নাশতা সেরে ওয়াশিংটন স্টার পত্রিকাতে প্রেসিডেন্ট রিগানের ট্যুর শিডিউল পড়লেন।
তিনি ভাবলেন সময় হয়েছে একশনে যাবার। একই সাথে ভাবলেন তিনি আর জীবিত আসতে পারবেন কিনা জানা নেই তাই জুডিকে একটা চিঠি লিখলেন, অবশ্য তা আর কোনদিন পোষ্ট করা হয়নি। তিনি লিখলেন যদি জুডি তার প্রেমে সাড়া দেন তাহলে তিনি রিগানকে আর ২য় বার খুন করার চেষ্টা করবেননা।
প্রেসিডেন্টকে খুন করবার ভয়ংকর চেষ্টা: ৩০শে মার্চ ১৯৮১ হোটেল ওয়াশিংটন হিলটন এ AFL-CIO এর প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে লেকচার পর্ব শেষ করে বেরুবেন। এই হোটেলটাকে ওয়াশিংটনের সবচাইতে নিরাপদ হোটেল বলে ধরা হয়।
এটার প্যাসেজ ওয়ে বানানো হয় ১৯৬৩ সনে, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি খুন হওয়ার পর। প্যাসেজ ওয়ে'টাকে 'প্রেসিডেন্ট ওয়াক' বলা হত। তাছাড়া সেখান থেকে প্রেসিডেন্টের লিমোজিনের দুরত্ব মাত্র ৩০ ফুট, সবাই সেটাকে নিরাপদ বলেই ধরে।
বেলা ১:৪৫ এ প্রেসিডেন্ট ঢুকেছিলেন হোটেলে, সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে। সেদিন তিনি কোন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়েননি আর সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরাও তেমন গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাকে কারণ প্রেসিডেন্টের এক্সপোজারের সময়টা খুব কম।
বেলা ২: ২৭ মিনিটে প্রেসিডেন্ট রিগান বেরিয়ে আসছেন প্রেসিডেন্ট ওয়াক দিয়ে। অপেক্ষমান জনতার মাঝে বেশ কিছু অংশ ছিল যারা নিরাপত্তা চেক এর মাঝে দিয়ে আসেনি বা আনস্ক্রীনড। তাদের মাঝেই অপেক্ষমান ছিল আততায়ী জন হিংকলে জুনিয়র। তাকে কেউ খেয়াল করেনি।
সিক্রেট সার্ভিস ভিতরের জনতা আর প্রেসিডেন্টের মাঝে একটা নিরাপত্তা দেয়াল সৃস্টি করে রেখেছিল কিন্তু বাইরে বেরিয়ে তারা একটা মারাত্মক ভুল করল।
জনতাকে তারা প্রেসিডেন্টের ১৫- ২০ ফুটের মধ্যে আসতে দিল। জনতার একটা অংশ একটা দড়ির ঘেরাওর মধ্যে প্রেসিডেন্টের চলার পথের খুব কাছে চলে আসল।
জনতার মাঝে আততায়ী হিংকলেও ছিলেন-- অপেক্ষমান।
অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেসিডেন্ট রিগান আততায়ী হিংকলের সামনে দিয়েই এগোচ্ছিলেন।
হিংকলে একটা .২২ ক্যালিবারের RHM_RG-14 রিভলবার দিয়ে ১.৭ সেকেন্ডে ৬ টা গুলি করে।
সৌভাগ্যবশত একটা গুলিও প্রেসিডেন্টের গায়ে লাগেনি। আগেই বলা হয়েছে বুলেটগুলো ছিল বিশেষ ধরনের ডিভাস্টেটিং বুলেট যা বস্তুতে আঘাত করার পর বিষ্ফোরিত হত, এতে আঘাতটা মারাত্মক হতো। রিভলবারটার আর গুলির ছবি দেখুন নীচে:
প্রথম বুলেটটা প্রেস সেক্রেটারী জেমস ব্র্যাডির মাথায় লাগে। সেটা সম্ভবত মাথায় আঘাতের পর বিষ্ফোরিত হয় যার জন্য তার আঘাতটা একটু মারাত্মক ছিল আর এই গুলিতে তার শরীরের বাঁ দিকটা চিরদিনের জন্য অবশ হয়ে যায়, তিনি চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যান।
দ্বিতীয় বুলেটটা ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ অফিসার থমাস ডেলাহন্টির ঘারের পেছনে লাগে।
পেছনে লাগার কারণ গুলি শুরুর সাথে সাথে তিনি ঘুরে প্রেসিডেন্টকে আড়াল করে রাখেন। দুজন পড়ে যাওয়াতে হিংকলের সামনে ছিল ফাকা, কোন বাধা নেই।
কিন্তু তৃতীয় গুলিটা উঁচু হয়ে সামনের ভবনের জানালাতে লাগে। ততক্ষনে সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট জেরি পার প্রেসিডেন্টকে দ্রুত গাড়ীতে তুলে দিয়েছেন।
চতুর্থ গুলিটা লাগে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট টিমথি ম্যাকার্থির তলপেটে, তিনি প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে নিজেকে ছড়িয়ে টার্গেট বানিয়ে দিয়েছিলেন।
পন্চম গুলিটা গাড়ীর বুলেটপ্রুফ কাঁচে লাগে।
ষষ্ঠ আর শেষ বুলেটটা গাড়ীর আরমার সাইডে লেগে দিকভ্রস্ট হয়ে (রিকোশে) প্রেসিডেন্টের বাঁ বগলের নীচে দিয়ে ঢুকে পাজর ঘেষে ফুসফুস ফুটো করে হৃৎপিন্ডের ঠিক ১ ইন্চি দুরে থামে। গাড়ীতে ঢোকাতে অফিসার জেরী পার আর এক সেকেন্ডের চার ভাগের একভাগ দেরী করলে গুলিটা প্রেসিডেন্টের মাথায় লাগত। তাতে তিনি বাঁচতেন কিনা সন্দেহ।
গোলাগুলি থামার পর আলফ্রেড আন্তোনুসি নামে একজন লোক ঘুষি মেরে আততায়ী হিংকলেকে মাটিতে ফেলে দিলেন সাথে সাথে অন্য অফিসাররা তাকে মাটিত রেখেই আটকান আর গনপিটুনি থেকে রক্ষা করে।
এজেন্ট রবার্ট ওয়ানকো একটা উজি সাব মেশিন গান ব্রিফ কেস থেকে বের করে ধরে পরিস্হিতি সামাল দেন। এফবিআই আর সিক্রেট সার্ভিস দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসের বদলে 'জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে' নিয়ে যান মাত্র চার মিনিট সময়ের মধ্যে।
রিভলবারটা উদ্ধার করে পরেরদিনই পাঠানো হয় ATF (Bureau of Alcohol, Tobacco, Firearms and Explosives) এর কাছে। তারা মাত্র ১৬ মিনিটে বের করে ফেলেন যে অস্ত্রটা টেক্সাসের ডালাসের একটা Rockey's Pawn Shop থেকে কেনা হয়েছে।
এর কারট্রিজগুলো এলুমিনিয়াম আর লেড এযাইড দিয়ে তৈরী যেগুলি আঘাত (ইমপ্যাকট) করার পর বিষ্ফোরিত হয়।
এতে টার্গেটের ক্ষতি বেশী হয়।
হাসপাতালে ১০৫ মিনিটের একটা মাঝারি অপারেশনের মাধ্যমে সেই ডিভাস্টেটিং বুলেটটা বের করা হয়। যদিও ডাক্তাররা বুলেটটার ব্যাপারে জানতেননা, তাহলে হয়ত বোমাপ্রুফ পোষাক পড়েই অপারেশন করতেন।
অক্সিজেন মাস্ক খুলেই কৌতুক করে রিগান ডাক্তার আর নার্সদের বলেন ' আশা করি আপনারা সবাই রিপাবলিকান' (রিগান রিপাবলিকান ছিলেন)। ডাক্তাররা সহ গিয়োর্দানো নামক একজন সহকারী বললেন ' আজকের জন্য আমরা সবাই রিপাবলিকান'।
১৩ দিনের মাথায় রিগান হাসপাতাল ছাড়েন, এক মাসের মধ্যেই তিনি ওভাল অফিসে কাজে যোগ দেন।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এপ্রিলের ১১ তারিখে প্রসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান স্ত্রী ন্যান্সি রিগানকে নিয়ে হোয়াইট হাউসের বারান্দায় জনতাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তাঁর লাল সোয়েটারের নীচে একটা বুলেটপ্রুফ ভেষ্ট রয়েছে।
আততায়ী জন হিংকলে জুনিয়রের বিচার হয় আর বিচারের রায়ে তিনি মস্তিষ্কের অসুস্হতার (Insanity) জন্য 'নির্দোষ' বলে সাব্যস্ত হন। পরে এই 'মস্তিষ্কে অসুস্হতা'র জন্য নির্দোষ রায় নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়।
অবশ্য অসুস্হতার জন্য হিংকলেকে সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নজরবন্দী রাখা হয়। ধীরে ধীরে তাকে বাইরে বেরুতে দেয়া হয়। ২০০০ সনের দিকে আততায়ী জন হিংকলে জুনিয়রকে প্রায় পুরোপুরিই ছেড়ে দেয়া হয়।
সুত্র: ইন্টারনেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।