জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ খান জবানবন্দিতে বলেছেন, একাত্তরে তিনি মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ফটকের সামনে কাদের মোল্লাকে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। কাদের মোল্লার অতীত অত্যন্ত শিহরিত করার মতো। এরা এখন রাজনীতির সাথে যুক্ত। জামায়াত শিবির তরুণ প্রজন্মের কাছে এইসব ইতিহাস গোপণ রাখছেন। এইসব নরপশু নেতার কাছে আজ তরুণ সমাজকে নতিশিকার করানো হচ্ছে মোটা অর্থের বিনিময়ে।
এখন সময় এসেছে এদের বিচার করার। আসুন জেনে নিই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার অতীত:
জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকার স্থানীয় বাঙালীদের কাছে কসাই নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। স্বাধীনতার পর পরই মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি গণকবরের সন্ধান মেলে। এই গণকবর এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শিয়ালবাড়ি ও রূপনগরসহ সারা মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালী হত্যার প্রধান নায়ক ছিল এই কাদের মোল্লা।
'৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যখন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখনই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালী নিধন শুরু হয়। ৭ মার্চের জনসভা সফল করতে ৬ মার্চ মিরপুরে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে কাদের মোল্লা আক্রমণ চালায়। কাদের মোল্লাই পাক হায়েনাদের আগে বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর বর্বর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই কসাইয়ের সশস্ত্রবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস শিয়ালবাড়ি, রূপনগর, বালুঘাটসহ নানা স্থানে ধরে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে অগণিত মানুষ হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে বৃহত্তর মিরপুরে বাঙালী নিধনের কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
কাদের মোল্লা এক সময় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদেও ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর, রায়ের বাজার, কেরাণীগঞ্জ, সাভারসহ ঢাকার বিভিন্নস্থানে নৃশংসতা চালিয়েছে এই কসাই। এই সময়ে এর নেতৃত্বে হাজারখানেক অপরাধ করা হয় মুক্তিকামী বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে।
কাদের মোল্লার হাতে সন্তান হারানো এক পিতার বক্তব্য(রাজধানীর মিরপুরের এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা আফাজউদ্দিন সরকার)-
তুমি কোন্ কাদের মোল্লার কথা বলছ? যে কাদের মোল্লা অনেক মায়ের বুক খালি করে এখনও বহাল তবিয়তে আছে। রাজনীতি করছে।
রাষ্ট্রমতার অংশীদারিত্বও পেয়েছিল। তুমি কি সেই কাদের মোল্লার কথা বলছ যার গড়ন ছোটখাটো, কিন্তু কাজকর্ম বীভৎস। পোশাকে আশাকে ধর্মীয় লেবাস ধারণ করলেও কার্যত সে ও তার সহযোগীরা ধর্মের সবচেয়ে বড় শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেও আজ সে উপায়ান্ত না পেয়ে, পিঠ বাঁচাতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে বেড়ায়। আমি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি; কিন্তু কিছুই বলব না। অনেক বলেছি কিছুই হয়নি, ওরা মাফ পেয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন - মহান '৭১-এ কাদের মোলার জুলুমবাজি থেকে মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা রা পাননি। তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কাদের মোল্লার হাতে। প্রাণ দেয়ার আগে হয়ত তাঁকে শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। তিনি আরও বলেন, কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে এমন অনেককে এখনও খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।
এককথায় তিনি কাদের মোল্লাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মিরপুরে অগণিত গণহত্যার জন্য 'কসাই' হিসেবে অভিহিত করেন।
এই আফাজ উদ্দিন সাহেবের তাঁর প্রিয় সন্তান । আলাউদ্দিন ছিল আওয়ামী লীগের এক তরুণ কর্মী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ফলে স্থানীয়ভাবে যারা পাক হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে দেশে থেকেই প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের দলেই যোগ দেন আলাউদ্দিন। '৭১-এর আগস্টে পাক হায়েনারা আলাউদ্দিন ও তাঁর ৭ বন্ধুকে হত্যা করে। মিরপুরের বহুল আলোচিত শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে তাঁদের প্রথমে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে হাত ও চোখ বেঁধে গুলি করা হয়।
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা :
১।
মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকের তালতলার বাসিন্দা ফজর আলী (বাবা হানিফ সরদার) জানান, তাঁর ছোট ভাই মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র শহীদ পল্লবকে (টুনটুনি) কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। সে বছরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দালালরা রাজধানীর নবাবপুর থেকে পল্লবকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে আসে। পরে কাদের মোল্লার নির্দেশে তাঁর সহযোগীরা পল্লবকে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশন শাহ আলী মাজার পর্যন্ত হাতে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। পরে একইভাবে সেখান থেকে মিরপুর ১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর সেকশনের ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে দুই দিন ঝুলিয়ে রাখা হয় পল্লবকে।
এরপর ঘাতকরা তাঁর হাতের আঙুল কেটে ফেলে। পরে কাদের মোল্লা তাঁর সহযোগী আখতার গুণ্ডা ও অন্যদের পল্লবকে গুলি করে মারার নির্দেশ দেন। এমনকি প্রতিটি গুলির জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। পরে ৫ এপ্রিল ঘাতক আখতার গাছে ঝোলানো পল্লবের বুকে পর পর পাঁচটি গুলি করে। আবদুল কাদের মোল্লা এতটাই বর্বর ছিলেন যে পল্লবকে গুলি করে হত্যার পর লাশ দুই দিন গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল কেবল মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে।
এরপর ঘাতকরা পল্লবের মরদেহ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরো সাতজনের সঙ্গে মাটিচাপা দেয়।
২। ৬ মার্চ ১৯৭১,স্বাধীনতার দাবিতে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে পাক হায়েনাদের প্রতিরোধ করতে হবে। অবাঙালীরা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে যে বাঙালী ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
আর এ কাজে প্রতিবেশী ভারত শেখ মুজিবুর রহমানকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এদিন দেশের বিভিন্ন এলাকার মতো পল্লবীর সিরামিক শিল্প কারখানা এলাকায় স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সমাবেশ। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করেই সিরামিক শিল্প কারখানা এলাকায় স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের সভা। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের জয়বাংলা স্লোগানে সভা প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে।
তখন কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একদল পাষণ্ড ওই সভায় হামলা চালায়। এ সময় তাদের হাতে ছিল দেশীয় সব অস্ত্র। হামলার মাধ্যমে কাদের মোল্লার বাহিনী নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামীদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে সম হয়। পাকবাহিনীর আগে কাদের মোল্লা এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরম্নর আগেই স্বাধীনতাকামী বাঙালীর মনোভাব বুঝেই কাদের মোল্লা মিরপুরের মনিপুর, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, কাজীপাড়া, চিড়িয়াখানার ঢাল, মাজার রোড, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, লালমাটিয়া, কালাপানি ও পল্লবী এলাকায় বসবাসকারী পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালী ও বৃহত্তর মিরপুরে বসবাসকারী বিহারীদের সশস্ত্রবাহিনী গঠন করে।
৩। একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মিরপুর ১২ নম্বরে কালাপানির ৫ নম্বর লাইনের ২১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা হজরত আলী লস্কর দৌড়ে নিজ বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। স্ত্রীকে তিনি বলেন, কাদের মোল্লা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে তাঁকে ধাওয়া করেছেন এবং বাড়ির দিকে আসছেন। তিনি ঘরের ট্রাংকের পেছনে ও চৌকির নিচে চার মেয়ের মধ্যে দুজনকে লুকিয়ে রাখেন। কিছুক্ষণ পর কাদের মোল্লা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন এবং দরজা না খুললে বোমা মারার হুমকি দেন।
এর পরও দরজা না খোলায় তারা বোমা ও লাথি মেরে দরজা খোলে। কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা লস্করকে গুলি করে। পরে সেনারা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে জবাই করে এবং দুই বছরের ছেলেকে মাটিতে আছড়ে হত্যা করে। এ দৃশ্য দেখে ট্রাংকের পেছনে লুকিয়ে থাকা দ্বিতীয় মেয়ে চিৎকার করলে তাকে বের করে এনে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করা হয়। শুধু চৌকির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বড় মেয়েকে সেনারা খুঁজে না পাওয়ায় সে বেঁচে যায়।
কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ড দেখে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
৪। একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে আরামবাগ থেকে খন্দকার আবু তালেব নামের এক ব্যক্তি মিরপুরে তাঁর পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখতে যান। বাড়ি দেখা শেষে তিনি আরামবাগ ফেরার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসস্ট্যান্ডে গেলে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা তাঁকে ধরে জল্লাদখানা পাম্প হাউসে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে জবাই করে হত্যা করা হয়।
৫। অক্টোবরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা কবি মেহেরুন্নিসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে কাদের মোল্লার সহযোগীরা।
৬। ২৪ এপ্রিল মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যার সঙ্গে কাদের মোল্লা জড়িত ছিলেন। গণহত্যার দিন ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার গ্রামের পূর্ব দিকে নামে।
কাদের মোল্লা অর্ধশতাধিক অবাঙালি ও রাজাকার নিয়ে গ্রামের পশ্চিম দিক থেকে ঢোকেন ও এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যায়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন মোল্লা বলেন- ঘর থেকে বের করে লাইনে দাঁড়িয়ে ৬৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারা সবাই আমার আত্মীয়স্বজন। এছাড়া বোরো ধান কাটতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ২৮০ কৃষককে গ্রামে ওই রাতে হত্যা করা হয়।
আমি বাবার সঙ্গে আলোকদী গ্রামের দক্ষিণ দিকে একটি খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণরক্ষা করি' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।