আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিয়ে যাওয়া সানী - মৌসুমি জুটির আদিকথা ( সালমান ও পরিচালকদের গল্প ৩)

প্রিয় বন্ধুরা আজ নিয়ে এলাম ৯০ দশকের সালমান ও পরিচালকদের গল্পের ৩য় পর্ব। আজ এখানে সালমান -শাবনুর জুটির এর ছবির সাথে সাথে কিভাবে আরেকটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জুটির (ওমর সানী - মৌসুমি) জুটির জন্ম হলো তার গল্পটাই আপনাদের শুনাবো। গত পর্বে আপনাদের জানিয়ে ছিলাম সালমান - মৌসুমি জুটির ভাঙ্গনের খবর এবং তাঁর জায়গায় কিভাবে সালমান -শাবনুর জুটির আবির্ভাব হলো। এখন জানবেন সেই সালমান - শাবনুর জুটির বিপরীতে কিভাবে আরেকটি জুটি পরিচালকরা তৈরি করে ফেললেন তাঁর গল্প। তাহলে আসুন শুরু করি এবার............................।

দোলা ঃ 'অন্তরে অন্তরে' ছবির পর যখন সালমান - মৌসুমি ঘোষণা দিলেন যে তাঁরা আর একে অপরের সাথে জুটি বেঁধে কোন ছবি করবেন না এবং যেগুলো চুক্তি করা হয়েছে সেগুলোর বাহিরে আর কোন নতুন চুক্তিবদ্ধ ছবিতে উনারা এক সঙ্গে কাজ করবেন না ঠিক তখনই পরিচালক জহিরুল হক সালমান কে নিয়ে একটি ফ্লপ ছবি দিয়ে শুরু করা শাবনুর কে বেছে নিলেন ঠিক তখনই আরেক অভিজ্ঞ পরিচালক দিলিপ সোম মৌসুমির সাথে জুটি তৈরি করেন সুপারহিট 'চাঁদের আলো' ছবির নায়ক সানীকে অর্থাৎ ওমর সানীর সাথে। তাঁর আগে সানীর কিছু কথা জেনে নিন। সানীর অভিনয় শুরু ৯২ তে নুর হোসেন বলাইয়ের 'এই নিয়ে সংসার' ছবি দিয়ে যেখানে মুল নায়ক ছিলেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ত তারকা ইলিয়াস কাঞ্চন। কাঞ্চন মানেই তখন হিট। সাথে দিতি।

কাঞ্চন- দিতি জুটি ৯০র প্রথম অংশ জুড়ে এক আলোচিত নাম এবং দুজনেরই ক্যারিয়ার তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। প্রথম ছবিতে কাঞ্চনের ছোট ভাই পুলিশ ইন্সপেক্টর সানী তাঁর সুঠাম দেহ ও লম্বা চুলের কারনে সবার নজর কাড়েন। পরিচালক শেখ নজরুল ইসলাম অভিনেত্রী আনোয়ারার মেয়ে মুক্তিকে নিয়ে সানীর সাথে জুটি বেঁধে একটি রোমান্টিক ছবি 'চাঁদের আলো' ছবি তৈরি করেন যা ছিল মুক্তির প্রথম ও সানীর প্রথম একক নায়ক হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবির গানের জনপ্রিয়তায় ছবিটি সুপারহিট ব্যবসা করে নেয়। ফলে একক নায়ক হিসেবে নবাগত সানীকে সবাই সফল বলেই মেনে নেয়।

যার পরবর্তীতে নুর মোহাম্মদ মনির ' প্রেম প্রতিশোধ' (অরুনার বিপরীতে) বক্স অফিস মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর পরেই আবারো নুর হোসেন বলাই এর 'মহৎ' (ইলিয়াস কাঞ্চন, নবাগতা শাহনাজ, ওমর সানী ও রাজীব) এর ব্যবসাসফলতা সানীকে এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয় যার ফলশ্রুতিতে নাদিম মাহমুদ এর 'আখেরি হামলা' নামক সম্পূর্ণ অ্যাকশন ছবিতে নবাগতা নিশি কে নিয়ে আরও একটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন যেখানে সানীই ছিলেন প্রধান নায়ক। 'চাঁদের আলো' পর একটি ফ্লপ ও দুটি সুপারহিট ছবি দিয়ে যখন সানী নিজেকে প্রমান করতে মরিয়া ঠিক তখনই সেই শেখ নজরুল ইসলাম এবার নির্মাণ করেন 'চাঁদের হাসি' যা ব্যবসায়িক ভাবে এভারেজ মানের ছবি যা 'চাঁদের আলো' ছবির ব্যবসার ধারে কাছেও নেই। ইতিমধ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' নিয়ে সালমান মৌসুমি ঝড় চলছিল যার কারনে সানী তখনও উত্থান - পতনে ব্যস্ত। সানীর চেয়ে বরং প্রবীণ নায়ক জসীম, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না ও রুবেল এবং ৯০র শুরুতে আসা নাইম পরিচালকদের কাছে বেশী আস্থাশীল।

এমনই এক টিকে থাকার লড়াইয়ের সময় পরিচালক দিলিপ বিশ্বাস ৯৪ তে দুটি সুপারহিট ছবির নায়িকা মৌসুমির সাথে ওমর সানীকে নিয়ে 'দোলা' ছবি তৈরি করে এক অর্থে 'জুয়া' খেললেন। যেখানে মৌসুমির চরিত্রের নামটিই ছিল 'দোলা' । সেই অর্থে একে নারীপ্রধান ছবি কেউ ভাবলে ভাবতেও পারেন। কিন্তু আসলে সেটি নারী প্রধান ছবি নয়, এটি সম্পূর্ণ রকমের একটি বিয়োগাত্মক প্রেমের ছবি যেখানে নায়ক নায়িকার দুজনেরই করুন মৃত্যু হয়। যাই হোক ছবির মুক্তির আগেই প্রতিভাবান আজাদ মিন্টুর সুরের ও সালমা জাহান এর কণ্ঠের গানগুলি রেডিওতে প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

আর সেই গানের সুরে সুরে সবাই হলে ভিড় জমাতে থাকেন আরও একটি প্রেম কাহিনী দেখার জন্য যার ফলে 'দোলা' ছবির ব্যাবসায়িক ফলাফল একটি সুপারহিট ছবি। 'দোলা' ছবি দেখতে বেশী ভিড় জমায় স্কুল -কলেজ পড়ুয়া কিশোর তরুন ও মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলা দর্শকরা। দিলিপ সোম একটি সাধারন কাহিনীকে খুব সহজ সরল ভাবে ফুটিয়ে তুলেন শক্তিশালী চিত্রনাট্য দিয়ে যার পরিসমাপ্তি দুজন দুই ধর্মের প্রেমিক -প্রেমিকার নির্মম মৃত্যু যারা ভালোবেসে জীবন দিয়ে যায়। ঠিক একই রকম কাহিনী নিয়ে পরবর্তীতে অন্যরা চেষ্টা করলে সেটা সফল হয়নি। 'দোলা'র সাফল্যর পেছনে বলতে হবে আজাদ মিন্টুর সুরের গানগুলো যেগুলো গতানুগতিক এর একটু বাহিরে আধুনিক গানের ধাঁচের, ওমর সানী, মৌসুমি ও হুমায়ুন ফরিদির চমৎকার অভিনয় এবং ছবিতে কোন ধরনের অযথা মারদাঙ্গা ও অশ্লীল কোন নাচগানের ব্যবহার না করার কারন।

যার ফলে মহিলা দর্শকরা পুরো ছবিটি খুব স্বস্তি নিয়ে দেখতে পারেন। এমন কি ছবিতে নায়ক নায়িকার কোন রোমান্টিক গানেও পরিচালক কোন ধরনের অমার্জিত ও অস্বস্তিকর দৃশ্য জুড়ে দেননি। একদিকে সালমান মৌসুমিকে ছাড়াই প্রথমবারেই শাবনুর এর সাথে জুটি বেঁধেই 'তুমি আমার' সুপারহিট ছবি উপহার দিয়ে সফল হোন ঠিক তাঁর সাথে সাথে মৌসুমিও প্রথমবারের মতো সালমান কে ছাড়াই ওমর সানীকে নিয়ে সুপারহিট 'দোলা' নামক রোমান্টিক ছবি উপহার দিয়ে সফল হোন। এরফলে ইন্ডাস্ট্রিতে স্পষ্টত জন্ম নেয় আরেকটি নতুন জুটি 'সানী - মৌসুমি' যার প্রভাব পড়তে থাকে ইন্ডাস্ট্রিতে আর দর্শকরা পেতে শুরু করে একটি অলিখিত সেরা হওয়ার যুদ্ধের সুবাতাস যা এতদিন বাংলা চলচিত্রের দর্শকরা আশা মনে মনে চাচ্ছিলেন। ফলে শুরু হয়ে গেলো একটি নতুন অধ্যায়ের যার নাম সালমান -শাবনুর বনাম সানী -মৌসুমি ।

এই দুটি জুটিকে নিয়ে শুরু হয় সব নবীন -প্রবীণ পরিচালকদের মধ্য ছবি নিয়ে যুদ্ধ। যেখানে সামিল হোন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, দেলোয়ার জাহান ঝনটু, মালেক আফসারি, এ জে মিন্টু, মনোয়ার খোকন, ওয়াকিল আহমেদ, জীবন রহমান, নুর হোসেন বলাই, রায়হান মুজিব, হাফিজউদ্দিন, শাহ আলম কিরন, শওকত জামিল, মমতাজুর রহমান আকবর, নাদিম মাহমুদ,মতিন রহমান, এম এম সরকার, দিলিপ সোম, শিবলি সাদিক, আজিজুর রহমান এর মতো সব বাঘা বাঘা পরিচালকরা যার সাথে পরবর্তীতে নবীন উত্তম আকাশ,বাদল খন্দকার এর মতো নবীন পরিচালকরাও যুক্ত হোন। আত্ম অহংকার ঃ 'দোলা'র মতো সুপারহিট একটি নিখাদ রোমান্টিক ছবি উপহার দিতে না দিতেই আবারো সানী-মৌসুমিকে পর্দায় হাজির করান রায়হান মুজিব 'আত্ম অহংকার' নামক রোমান্টিক ও পারিবারিক অ্যাকশন নির্ভর ছবির মাধ্যমে। যেভাবে সালমান -শাবনুর এর সুপারহিট 'তুমি আমার' এর পাল্টা জবাব দিয়ে দিলো সানী-মৌসুমির 'দোলা' ঠিক তেমন করেই সালমান -শাবনুরের সুপারহিট 'বিক্ষোভ' এর পাল্টা জবাব নিয়ে এলো এই রায়হান মুজিবের 'আত্ম অহংকার' ছবিটি। জামান আখতার এর কাহিনী সংলাপ ও চিত্রনাট্য ছবিটি পরিচালনা করেন রায়হান মুজিব।

'দোলা' ছিল দুই ভিন্ন ধর্মের তরুন তরুণীর ব্যর্থ প্রেম কাহিনী কিন্তু 'আত্ন অহংকার' ছবিটি হলো ধনী (জমিদার এর মেয়ে) ও গরীবের প্রেম কাহিনী সাথে ছিল জমিদারের এক অতি বিশ্বস্ত চাকর সম্পত (হুমায়ুন ফরিদির ) এর মায়ের হত্যার প্রতিশোধ এর অতি চমৎকার কাহিনী যার পরিসমাপ্তি হয় মিলনের মধ্য দিয়ে। ছবিটি ছিল সব শ্রেণীর দর্শকদের জন্য একটি পরিপূর্ণ খাঁটি সুস্থ বিনোদন। এই ছবিতে হুমায়ুন ফরিদির অভিনয় একটি বিশেষ আকর্ষণ যা চিরদিন সবার মনে থাকবে। আহমেদ ইমতিয়াজ এর সুর ও সঙ্গীতে ছবির ১ম, ২য় ও ৪র্থ গানগুলো ছিল সেই সময়ের সুপারহিট। সবমিলিয়ে ছবিটি 'বিক্ষোভ' এর চেয়েও বেশী ব্যবসা করে যা সানী-মৌসুমি জুটিকে ইন্ডাস্ট্রিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দেয় এবং সানী-মৌসুমি জুটি পরিচালক ও দর্শক দুই দলেই গ্রহণযোগ্যতা পায়।

সানী- মৌসুমির প্রথম ছবি 'দোলা' যদি হয় প্রথম পরীক্ষা যে পরীক্ষায় সফল হোন এই জুটি তাহলে 'আত্ম অহংকার' ছবিটি হলো এই জুটির জোর স্বীকৃতি আদায়ের সফল পদক্ষেপ। যা সানী- মৌসুমিকে এনে দেয় পরিচালকদের নির্ভরযোগ্য জুটি হিসেবে একটি নির্ভরতার প্রতীক। 'দোলা' ও আত্মঅহংকার' এর মাধ্যমে ওমরসানীর নতুন করে ভক্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। এতদিন সবাই যে ওমরসানীকে মনে করতো শুধু ছবির ২য় নায়ক তাঁরাও এককভাবে সানীকে নতুন ক্রেজ হিসেবে মেনে নেয় । ফলে দর্শকরা হয়ে যায় ২ ভাগে বিভক্ত।

একদল সালমান শাহ এর ভক্ত অন্যদল ওমর সানীর ভক্ত। তবে দুটো দলেই দুই নায়কের ছবি দেখতে ভিড় করতো। এতে দুই শিবিরে ছবি নিয়ে তর্কযুদ্ধ হতো কে সেরা? সালমান না ওমরসানী? তবে একদিক দিয়ে সানীকে সবাই এগিয়ে রাখতো যে সালমান এর ছবিগুলো প্রায় সবই প্রেম কাহিনী নির্ভর বা রোমান্টিক ছবি কিন্তু সানী শুধু রোমান্টিক ছবিতে সফল ছিলেন না একাধারে সামাজিক অ্যাকশন নির্ভর ছবিতেও সানী ছিলেন সমান পারদর্শী ও নির্ভরতার প্রতীক। সালমান - সানী যুদ্ধ এর মাধ্যমে ৯৪-৯৬ পর্যন্ত আমরা প্রচুর ছবি উপভোগ করেছিলাম যা আজো স্মৃতির পটে জ্বলজ্বল করে উঠে। সেই সময়ের আমাদের যেন বাংলা সিনেমা দেখা একটা নেশাতে পরিনত হয়।

সবশেষে একটি তথ্য জানিয়ে শেষ করছি যা আপনাদের সালমান- সানী যুদ্ধের হিসেব মেলাতে সহযোগিতা করবে। 'তুমি আমার' ছবির পরিচালক জহিরুল হক সালমান কে নিয়ে দুটি ছবি করেন যার আরেকটি নাম 'সুজন সখী'। অবশ্য ২য় ছবিটি শুরু করেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন যার কারনে বোঝা যায়নি তিনি বেঁচে থাকলে সানীকে নিয়ে ছবি বানাতেন কিনা। তবে এদিকে ওমরসানীতে সাফল্য পাওয়া 'দোলা' ছবির পরিচালক দিলিপ সোম পরবর্তীতে সালমান- শাবনুর কে নিয়েও ছবি তৈরি করে সফল হোন যার নাম ছিল 'মহামিলন'। আবার 'বিক্ষোভ' ছবির পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান সালমান এর ক্যারিয়ারে আর কোন ছবি যোগ করতে পারেননি এমনকি তিনি সানীকে নিয়েও কোন কাজ করেননি।

ঠিক একই রকম 'আত্ম অহংকার' ছবির পরিচালক রায়হান মুজিব সানিতে সন্তুষ্ট হলেও পরবর্তীতে সানীকে নিয়ে কোন ছবি করেননি এমনকি সালমানকে নিয়েও কোন ছবি তৈরি করেনি। কি বুঝলেন???? যুদ্ধটার শুরু তো এখানে........সামনে আরও পাবেন। সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ। বাংলাদেশের সব হারিয়ে যাওয়া সেরা সম্পদ পেতে ক্লিক করুন- একটি শিক্ষিত রেডিও  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.