আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মের অবমাননা পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের বিভীষিকা

পাকিস্তানের একটি সামাজিক সেবা সংস্থার উদ্যোক্তা, অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত ৮০ বছর বয়সী সমাজসেবক আখতার হামিদ খানকে ১৯৯২ সালে গ্রেপ্তার করা হয় ইসলামের অবমাননার অভিযোগে। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত হওয়া এক সাবেক কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তিনি একজন ভারতীয় সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসলামের অবমাননা করেছেন। আদালতে সে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু একই বছর আবারও গ্রেপ্তার হন। এবার তাঁর বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.)-কে অবমাননার অভিযোগে মামলা করেন মাওলানা এহতেরামুল হক থানভি নামের এক ব্যক্তি।

থানভি তাঁর অভিযোগে বলেন, খান শিশুদের জন্য একটি গল্প লিখেছেন, যেটির শিরোনাম ‘শের আউর আহমেক’। খান এক সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করে বলেন, গল্পটি তিনি লিখেছেন জেনারেল জিয়াউল হক ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিয়ে। কয়েকজন ইসলামি পণ্ডিত বিষয়টি খতিয়ে দেখে মন্তব্য করেন, খানের গল্পে কোনো ধর্মীয় অবমাননা ঘটেনি। তারপর তাঁর বিরুদ্ধে দুটো মামলাই প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট লাহোরের যুবক দিনমজুর, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী স্যামুয়েল মসিহকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

তার আগে একটি মসজিদের ইমাম ও কয়েকজন মুসল্লি স্যামুয়েলকে বেদম প্রহার করেন এই অভিযোগ তুলে যে স্যামুয়েল ওই মসজিদের দেয়ালে আবর্জনা ছুড়ে ফেলেছেন। তাঁরা স্যামুয়েলের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইন নামে পরিচিত পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় মামলা করেন। ২০০৪ সালের ২২ মে পর্যন্ত তিনি বিনা বিচারে লাহোর কারাগারে বন্দী থাকেন। যক্ষ্মারোগী স্যামুয়েলের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে লাহোরের গুলাব দেবী হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য চারজন পুলিশও পাঠানো হয় তাঁর সঙ্গে।

২৪ মে খুব ভোরে হাসপাতালে চার পুলিশ প্রহরীর উপস্থিতিতেই স্যামুয়েলের ওপর খোয়া ভাঙার হাতুড়ি নিয়ে চড়াও হন ফারিয়াদ আলী নামের অন্য এক পুলিশ কনস্টেবল, যিনি সে সময় অফ-ডিউটিতে ছিলেন। মাথায় হাতুড়ির আঘাতে গুরুতর আহত স্যামুয়েলকে লাহোর জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে চার দিন পর তিনি মারা যান। একটি তথ্যানুসন্ধানী দল ঘটনা তদন্ত করে জানতে পারে, হত্যাকারী পুলিশ কনস্টেবল ফারিয়াদ আলী পরে পুলিশকে বলেছেন, ‘ওই লোকটিকে হত্যা করে আমি আমার ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছি। আমি আত্মিকভাবে তৃপ্ত। এ জন্য যেকোনো পরিণতির মুখোমুখি হতে আমি প্রস্তুত।

’ পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা জেলার এক মসজিদের ইমাম ১৯৯৩ সালের ১১ মে কোট লাদা থানায় অভিযোগ করেন, তিন ব্যক্তি তাঁদের মসজিদের দেয়ালে মহানবী (সা.)-এর অবমাননাসূচক কথা লিখেছেন এবং একই ধরনের অবমাননাসূচক লেখাসহ এক টুকরা কাগজ মসজিদের ভেতরে ছুড়ে দিয়েছেন। তাঁরা তিনজন হলেন রেহমাত মসিহ (৪৪), মনজুর মসিহ (৩৮) ও সালামত মসিহ নামের ১১ বছরের এক বালক। তাঁরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। সালামত মসিহ ও মনজুর মসিহ একেবারেই অক্ষরজ্ঞানহীন হওয়া সত্ত্বেও রেহমাত মসিহর সঙ্গে ওই দুজনকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ তদন্ত করতে গেলে অভিযোগকারী ইমাম পুলিশকে বলেন, তিনি মসজিদের দেয়ালের লেখাগুলো মুছে দিয়েছেন।

কারণ, সেগুলো ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রতি অবমাননামূলক। নাবালক বলে সালামতকে সঙ্গে সঙ্গে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়, আর রেহমাত ও মনজুর জামিনে মুক্তি পান সাত মাস কারাভোগের পর ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে। এপ্রিলে মামলার শুনানি শেষে ওই তিন আসামি জেলা ও দায়রা আদালত থেকে বেরিয়ে এলে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হয়। গুলিতে মনজুর প্রাণ হারান, সালামত ও রেহমাত আহত হন। তবে প্রাণে বেঁচে যান তাঁরা।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সালামত ও রেহমাতের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে লাহোর হাইকোর্ট এই বলে তাঁদের বেকসুর খালাস দেন যে তাঁরা খ্রিষ্টান, আরবি জানেন না, আরবিতে কীভাবে আল্লাহর নাম লিখতে হয়, তা তাঁদের জানা নেই। মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা হত্যার হুমকি পেতে শুরু করলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সালামত ও রেহমাত মসিহকে মুক্তি দিয়েছেন লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি আরিফ ইকবাল ভাট্টি। ১৯৯৭ সালে তাঁকে তাঁর হাইকোর্টের চেম্বারে খুন করেন এক ব্যক্তি।

সে খুনের অভিযোগে পুলিশ ১৯৯৮ সালে শের খান নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ওই ব্যক্তি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, বিচারপতি ভাট্টিকে তিনি হত্যা করেছেন। কারণ, তিনি সালামত ও রেহমাতকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। তারপর শের খান পুলিশ হেফাজত থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ১৯৯৪ সালে হাফিজ ফারুকি সাজ্জাদ নামের এক মুসলমানের বাড়িতে আগুন লেগে কোরআন পুড়ে যায়।

স্থানীয় মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়, একজন খ্রিষ্টান কোরআন পুড়িয়েছেন। ক্রুদ্ধ লোকজন সাজ্জাদের বাড়ি ঘেরাও করে, তাঁকে গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। ক্রুদ্ধ লোকজন থানা ঘেরাও করে, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং শেষে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, থানার সব পুলিশ পালিয়ে যায়। সাজ্জাদ পুড়ে মারা যান। ২০১২ সালে বাহাওয়ালপুরে এক মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ক্রুদ্ধ জনতা থানা-পুলিশের হেফাজত থেকে বের করে এনে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলে।

গুজব রটানো হয়েছিল যে ওই ব্যক্তি কোরআন পুড়িয়েছেন। একই বছর ৩৫ বছর বয়সী আরেক ব্যক্তিকে কোরআনে আগুন ধরানোর অভিযোগে ক্রুদ্ধ লোকজন পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। তারপর হাজার খানেক লোক থানা ঘেরাও করে লোকটিকে পিটিয়ে হত্যা করে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০০৯ সালে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের দুই বৃদ্ধ লোক কোরআনের অবমাননা করেছেন—এমন অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে ক্রুদ্ধ মুসলমান জনতা খ্রিষ্টানদের ৭৫টি বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে সাতজন খ্রিষ্টান পুড়ে মারা যান।

পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন অপব্যবহারের রোমহর্ষক ঘটনার যেন শেষ নেই। দেশটিতে কেউ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তোলামাত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবনে বিপন্ন দশা উপস্থিত হয়; অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই পর্যন্ত যেতে হয় না। অনেক ব্লাসফেমি মামলার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু তাতে ওই ব্যক্তিদের জীবনে স্বাভাবিক নিরাপত্তা, স্বস্তি, সামাজিক মর্যাদা আর ফিরে আসেনি। অনেকে আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে খুন হয়েছেন, অথবা সামাজিক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হত্যার হুমকি সইতে না পেরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনেকে স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

ব্লাসফেমির অভিযোগে মামলার শিকার না হয়েও কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে অনেক মানুষ ঘৃণা-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানে যাঁরা ব্লাসফেমি আইনের সমর্থক, তাঁদের একটা যুক্তি হচ্ছে, ধর্মীয় কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়া ঠেকাতে এই আইন ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু সেটা যে হয়নি, তা পাকিস্তানের মানুষ মর্মান্তিকভাবে উপলব্ধি করছে। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো অজুহাতে এই আইনের অপব্যবহারের বলি হতে পারেন—এই মারাত্মক ঝুঁকি সত্ত্বেও আইনটি বাতিল বা সংশোধনের উদ্যোগ নিতে কোনো সরকার সাহস পাচ্ছে না চরম উগ্রপন্থী ইসলামি কয়েকটি গোষ্ঠীর কারণে। তা ছাড়া সাধারণ মুসলমানদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, নিজে ব্লাসফেমি আইনের শিকার হওয়ার আগে পর্যন্ত, ভাবছে যে এই আইনটি দরকারি।

বাংলাদেশেও এই চিন্তাধারার কিছু মানুষ আছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু যে সমাজের মানুষ চাঁদের বুকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখচ্ছবি দেখার সুপরিকল্পিতভাবে প্রচারিত গুজব বিশ্বাস করে ওই রকম দৃষ্টি-বিভ্রমের শিকার হন, যে সমাজে মসজিদের মাইকে গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো সম্ভব, সেখানে ব্লাসফেমি আইন ভীষণ বিপজ্জনক হতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকে এটা হবে আরও বেশি গুরুতর: বিরুদ্ধ মতের, প্রতিপক্ষ দলের যেকোনো নেতা-কর্মী বা সমর্থকের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে মামলা করে তাঁর জীবন বিপন্ন করা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠবে। এখনো ব্লাসফেমি আইন ছাড়াই, যাকে ইচ্ছা তাকে কথায় কথায় নাস্তিক বলা হচ্ছে। এমনকি লেখক, কবি, সাংবাদিক, অধ্যাপক, মানবাধিকারকর্মী, তরুণ নাগরিক সমাজের নেতাদের নাস্তিক বলে প্রচার করে তাঁদের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের উসকানি সৃষ্টির প্রবণতাও সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে।

পাকিস্তান যে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চাইছে, বাংলাদেশ কেন সেই বিপদে প্রবেশ করবে? পৃথিবীর সব সমাজ এগিয়ে চলে সামনের দিকে। কোনো সমাজ এগোয় দ্রুতগতিতে, কোনোটা ধীরে। কিন্তু অগ্রসরের গতিমুখটা সামনের দিকেই; পেছনের দিকে নয়, মধ্যযুগের দিকে নয়। [এই লেখা তৈরি করা হয়েছে পাকিস্তানের ডন, দ্য ডেইলি টাইমস, দ্য নেশন, দ্য হেরাল্ড, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ইত্যাদি ইংরেজি দৈনিকের বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অব পাকিস্তান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ক্রিশ্চিয়ান সলিডারিটি ওয়াল্ডওয়াইড ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। ] ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.