আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকারের ফাঁদে বিএনপি! আলোচনায় গৃহপালিত বিরোধী দল। ঘরে বাইরে নানা কথা বিভিন্ন মহলে কৌতূহল

বিএনপি কি শেষ পর্যন্ত গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে? চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির মনোভাব ও আন্দোলনের গতিপথ দেখে এ ধারণাই পোষণ করছে রাজনৈতিক মহল। খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী কৌতুহল। সূত্র জানায়, কিছুদিন আগেও বিএনপি নেতারা বলতেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু হঠাৎ করেই সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন বিএনপি। নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস ইস্যুতে আন্দোলন করতে গিয়ে একপর্যায়ে নিজেদের কৌশলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি।

রাজপথের তুমুল আন্দোলন থেকে সরে এসে এখন নমনীয় অবস্থান নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। অন্যের ওপর চাপানো তত্ত্ব এবার ভর করেছে নিজেদের ওপর। এরশাদের সময় গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের দলকে বোঝানো হয়। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলেও আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ তাতে অংশ নেয়। পরে চতুর্থ জাতীয় সংসদে আ স ম আব্দুর রব বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন।

সে সময় তাকে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলা হতো। কিন্তু এবার খোদ বিএনপিই গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে 'ধরা' খেয়ে সমঝোতার পথে চলতে শুরু করেছে তারা। প্রকাশ্যে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনার কথা বলে ভেতরে 'মামলায় জর্জরিত নেতৃত্বকে রক্ষা করতে' সমঝোতার পথে হাঁটছে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী আন্দোলনকে সীমিত রাখছেন তারা।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভেতরে আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পানি ঢালছেন সে আগুনে। বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা যায়যায়দিনের সঙ্গে আলাপকালে দলের এ মনোভাবকে 'নেতৃত্বের হিপোক্রেসি' বলে মন্তব্য করেছেন। তার ধারণা- ওয়ান ইলেভেনের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধস পরাজয় ঘটলেও তুলনামূলক ভালো ছিল দলের অবস্থান। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পরিবর্তন হয় সে অবস্থানের। সরকারের উপর্যুপরি একতরফা সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান পাল্টায় বিএনপি।

একটি গণতান্ত্রিক সরকারের মাত্র এক বছরের মাথায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলে দলটি। বিরোধী দলের এই ভুল চালের সদ্ব্যবহার করে সরকার। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বিলুপ্ত ও ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিধান যোগ করে। তখন বেকায়দায় পড়ে বিরোধী দল। কারণ এ সংশোধনের ফলে মধ্যবর্তী নির্বাচন করতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই করতে হবে।

এ অবস্থায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি থেকে সরে আসে বিরোধী দল। দলের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়- মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলেও তা একটি নেতিবাচক নজির তৈরি করবে। যার সূত্র ধরে আওয়ামী লীগ পরবর্তী সময়ে দৃঢ় সাংগঠনিক শক্তিতে আন্দোলন করে বিএনপিকে অল্প সময়েই ক্ষমতাচ্যুত করবে। এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এ ইস্যুতে সারাদেশে রোডমার্চ ও জনসমাবেশ করেন খোদ বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া।

সে আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও দিন দিন বাড়তে থাকে। সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে ১২ মার্চ ঢাকা মহাসমাবেশে অংশ নেয় লাখ-লাখ মানুষ। আর তখনই দ্বিতীয় রাজনৈতিক ভুল করে বসে দলটি। একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ দুই বছর বাকি থাকতেই তিন মাসের আল্টিমেটাম দেয় বিএনপি। বিরোধী দলের জনসমর্থন ও রাজনৈতিক ভুল চালের সুযোগ নিয়ে হার্ডলাইনে যায় সরকার।

এ পর্যায়ে হঠাৎ নিখোঁজ হন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। তখন আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে রাজপথে টানা হরতালসহ নৈরাজ্যময় কর্মসূচিতে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। কিন্তু বিরোধী দলের আন্দোলনের উত্তাপ কমাতে কিছু সময় নিয়েই পুরনো রূপে ফিরে আসে সরকার। হরতালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানো ও সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের দুটি মামলায় আসামি করা হয় ১৮ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় ৩৩ নেতাকে। তাদের কারাগারে পাঠিয়ে আন্দোলনের উত্তাপে পানি ঢেলে দেয় সরকার।

ইলিয়াস ইস্যুতে বিরোধী দল দমনে সরকারের মামলা কৌশলটি প্রধান ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যে রয়েছে কিছু কারণ। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সংলাপের মূলো ঝুলিয়ে বিএনপিকে আন্দোলনের ট্র্যাক থেকে সরিয়ে দেয় সরকার। সরকারের সংলাপের পরোক্ষ প্রস্তাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন বিএনপি নেতারা। এমনকি এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে একপর্যায়ে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রের কথাও ওঠে। এ সময় বিরোধী দল পুরো নমনীয় অবস্থান নিয়ে ঘোষণা দেয়- সরকার সংসদ বা সংসদের বাইরে যেখানেই চায় সেখানেই সংলাপে রাজি তারা।

কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েও শেষপর্যন্ত সংলাপের উদ্যোগ নেয়নি সরকার। দলীয় সূত্রে জানা যায়, তিন মাস আল্টিমেটামের পর কড়া কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেছিলেন বিএনপি নেতারা। সে অনুযায়ী অবরোধ ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জেলা সফরের কর্মসূচিও প্রণয়ন করেছিল বিএনপি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরকারের তরফে আপত্তি আসে খালেদা জিয়ার কাছে। পরে নানাদিক বিবেচনায় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী ১১ জুনের সমাবেশ থেকে কড়া কোনো কর্মসূচিই দেয়নি বিরোধী দল।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের কর্মসূচিগুলোতে স্পট নিয়েও সরকারের ইচ্ছাই মেনে নেয় বিরোধী দল। সরকারের ইচ্ছায় নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সীমাবদ্ধ থাকছে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম। এছাড়া বিরোধী জোটের ৩৩ কেন্দ্রীয় নেতার জামিন নিয়েও এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে নানা কথাবার্তা। কারাবন্দি নেতারা একসঙ্গে জামিন আবেদনের কথা থাকলেও সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সংসদ সদস্য, অসুস্থ ও অন্যান্য তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আলাদাভাবেই জামিন চান বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীরা। আলোচনা রয়েছে- নেতৃত্বের ঐক্য নষ্ট করতে এ প্রক্রিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

সরকার যখন যাকে ইচ্ছা জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠাতে পারবে। অন্যদিকে জামিনে মুক্তি পেলেও সরকারের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে ১১ জুনের পর মুক্তি পেয়েছেন বিরোধী নেতারা। যে যুক্তিতে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল সেটা আগেই জানতেন বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীরা। কিন্তু সরকারের কথা মতো তারা সেটা মেনে নিয়েছেন। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল ও দ্রব্যমূল্যসহ নানা ইস্যুতে চলতি বছর দুটি গণমিছিল কর্মসূচি দেয় ১৮ দলীয় জোট।

প্রথম গণমিছিলটি নয়া পল্টন থেকে বাংলামটর পর্যন্ত ঘোষণা করা হলেও সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে মগবাজারেই তা শেষ করা হয়। ইলিয়াসের সন্ধান দাবিতে দেয়া সমপ্রতি একটি গণমিছিল কর্মসূচি পরিণত করা হয় বিক্ষোভ সমাবেশে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতারা সমঝোতা করে গণমিছিল বাদ দেন। এভাবেই একের পর এক ইস্যুতে সরকারের কৌশলের কাছে পরাজিত বিএনপি এখন অস্তিত্বের প্রশ্নে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, সরকার বিরোধী দলের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দিতে চায় না।

এ জন্য কখনো তাদের চাওয়ার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে হয়। বিশৃঙ্খলা এড়াতে এ কৌশল অবলম্বন করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলন আগ-পিছ করা রাজনীতির একটা কৌশল। এক্ষেত্রে কারো কাছে নতিস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। আর দেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের চরম সঙ্কট।

এ অবস্থায় যে কোনো উপয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করা বিরোধী দলের একটা গুরুদায়িত্ব বলেও তিনি মনে করেন। দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, এখানে গৃহপালিত বিরোধী দল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। তাই সরকারকে সুযোগ দিতে চায়। দেশের স্বার্থে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না।

তার মানে রাজনীতির এ কৌশলকে গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে দেখলে চলবে না। কর্মসূচিতে পিছুটান প্রসঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী ১১ জুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। একে সরকারের অনেকে পিছুটান বলছেন; এটা ঠিক নয়। হরতালের মতো কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার সংস্কৃতি চালু করতে চান বলে সরকার একে দুর্বলতা মনে করছে। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর থেকে চলমান আন্দোলনে সরকার বিরোধী দলের ১২ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।

হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে আটক করে রেখেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হতে পারে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.