হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আজ ২৩ জুন, পলাশী দিবস। কঠিন পুজিতান্ত্রীক বাস্তবতায় বসবাসরত আমি লজ্জ্বাজনকভাবে দিবসটা ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্য প্রায় প্রতিবছরই ভুলে যাই। প্রতিবছরই যখন আবার মনে পরে তখন ঠিক করি আগামী বছর পলাশী দিবস উদযাপনএর একটা আয়োজন করবো, নিদেনপক্ষে কিছু না কিছু লিখে উদযাপন করবো। সেটা করা হয়না।
আজ সকালে দিবসটা মনে করিয়ে দিলেন প্রিয় ব্লগার নুরুজ্জামান মানিক। তিনি তার আমরা কি পলাশির ইতিহাস থেকে আদৌ কিছু শিখছি ?View this link পোস্টটার লিংক ফেসবুকে শেয়ার করে ট্যাগ দিলেন আমাকে। পোস্টটা আগে পড়েছি, ছোট্ট কিন্তু খুবি শক্তিশালী একটা পোস্ট। ২০১০ সালের ২৩ জুন সকাল বেলা করা। পলাশীকে স্মরণ করে সমসাময়িক বাস্তবতাকে আঙুল তুলে জরুরি একটা প্রশ্ন, ‘পলাশী থেকে আমরা কি কিছু শিখেছি?” তার প্রশ্ন ছিল, “সেদিন সামনে ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী , সহযোগিতায় আমত্যবর্গ নেপথ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ , আজকেও তেল গ্যাস বন্দর প্রশ্নে সামনে বহুজাতিক কর্পোরেট , সহযোগিতায় আমলাতন্ত্র নেপথ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ।
আজকে যারা বাংলার তেল গ্যাস বন্দর বেনিয়াদের কাছে তুলে দিতে চায় তাদেরকে কি বলা যায় ?” আজ দুই বছর পর সেই সমসাময়িক বাস্তবতা বিচারে সেই প্রশ্নের গুরুত্ব আরো বেরেছে বলা যায়, এক ফোটাও কমে নাই।
তবে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দুঃখজনকভাবে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে। সেই প্রশ্নটা হলো, “পলাশী থেকে আসলেই কি আমাদের কিছু শেখার আছে?” এই প্রশ্নটা আসার কথা ছিলনা। কিন্তু এসেছে। আধুনিক বাঙালির ইতিহাস চর্চার দারীদ্র আর পার্টি রাজনীতির দেউলিয়াপনা থেকেই এসেছে।
গত বছরের ১৫ মে মালিকানাView this link নামে একটা লেখা লিখে প্রকাশ করেছিলাম সামহয়ারইন ও উন্মোচন ব্লগে। লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার করার পর অমি রহমান পিয়ালএর স্বার্থে তর্ক বাধলো। তার আপত্তি যতদুর বুঝলাম ঐ লেখার “২৩ জুন, ১৭৫৭ সাল থেকে উপনিবেশের লাঞ্ছিত মানুষ হিসাবে নিজ ভূমি আর দেহ মনের মালিকানা হারানো বাঙালীর তারপর থেকে তাবৎ মুক্তিসংগ্রাম এই মালিকানার মুক্তিসংগ্রাম, নিজ ভূমি আর সত্ত্বার মালিকানা ফেরত পাওয়ার সংগ্রাম” লাইনটাকে ঘিড়ে। ২৩জুন আমরা পরাধীন হয়েছি এইটা উনি মানতে পারলেন না, ওনার মতে আমরা শ্রেফ ভিনদেশী মুঘল/সুলতানী শাসন থেকে ভিনদেশী ইংরেজদের শাসনের অধীন হয়েছি, ২৩জুনএর আগেও আমরা পরাধীনই ছিলাম। আমার কাছে অবশ্য ওনার আপত্তির পেছনে আরো কিছু কারন ছিল বলে মনে হয়েছে।
আমার লেখায় বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ২৩ জুন ১৭৫৭ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছে এইটা উনি মনে হয় মানতে পারেন নাই। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা ৭১এর ৭মার্চএর আগে, অথবা কষ্ট করে একটু পিছনে ফিরে ৬৬সালের ৬ দফা আন্দোলনের আগে মুক্তি সংগ্রামের জন্মলগ্নের ইতিহাস টেনে নিতে চান না। কেউবা দয়া করে ৫২এর ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত যান, তাও আবার সেই আন্দোলনের সাথে জোড় জবরদস্তি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের মিথ তৈরি করে। গেলো এক বছরে শুধু অমি রহমান পিয়ালই নয়, আরো অনেকের সাথেই এই বিষয় নিয়া তর্ক হয়েছে, এদের অধিকাংশই আওয়ামী অথবা প্রো-আওয়ামী ব্লগার বা অনলাইন একটিভিস্ট। আর এই কারনেই “পলাশী থেকে আসলেই কি আমাদের কিছু শেখার আছে?” এই প্রশ্নটার উত্তর দেয়া জরুরি হয়ে পরেছে।
খুব বেশি বিস্তারিত বা বিশ্লেষনধর্মী আলোচনায় যাবোনা। কিছু সহজ সরল যুক্তি উপস্থাপন করবো। তাছাড়া সবার অংশগ্রহনে ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত এবং বিশ্লেষনধর্মী আলোচনার জায়গা উন্মুক্ত রাখতে চাইছি।
যাদের সাথে তর্ক হয়েছে তাদের সবাইকেই একটা কথা বারবার বলেছিযে, সুলতানী শাসন আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনএর ফারাক বুঝতে হবে। কিছু বাস্তব কারনেই এই ফারাকটা যেমন করতে হবে তেমনি ঔপনিবেশিক শাসনকে এর স্বরূপে চিনতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তবে তার ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর আত্মঘাতি।
‘পরাধীনতা’ অথবা ‘স্বাধীনতা’ শব্দের অর্থ সবকালে এক না, এই বিষয়ে মানুষএর বোধও সবসময় সমান না। ব্রিঠিশদের যেই বিখ্যাত রাজপরিবার সারা দুনিয়া জোড়া সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল এবং এখনো খাতা কলমে ব্রিটেনের শাসক, সেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম দ্যা কঙ্কুয়েরার ছিলেন একজন ফ্রেঞ্চ জমিদার, ফ্রান্স থেকে এসে তিনি ব্রিটিশ সিংহাসন দখল করেছিলেন। উইলিয়ামএর ভাষাও ছিল ফ্রেঞ্চ, তার শুরুর দিকের বংশধররাও ফ্রেঞ্চ ভাষা ও ঐতিহ্য লালন করেছেন। সেই হিসাবে কেউ চাইলে ব্রিটিশদের গেলো ১০০০ বছরের রাজ শাসনকেও পরাধীনতা গন্য করতে পারে, তবে সেইটা বাস্তবসম্মত হবেনা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বে বাঙলায় প্রায় ৭০০ বছর মুসলিম সুলতানী শাসন ছিল।
এই ৭০০ বছরএর কিছু বিচ্ছিন্ন পর্ব বাদে মুসলিম সুলতানরা দিল্লীর কোন সম্রাটের অধিনতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে বাঙলা শাসন করেছেন। অধিকাংশ বাঙালি ঐতিহাসিক এই সময়টাতে বাঙালিদের স্বাধীন বলেই গন্য করেছেন। সেটা গন্য করার বাস্তবসম্মত কারণ আছে। এটা সত্য যে অধিকাংশ সুলতানই অবাঙালি ছিলেন, বেশিরভাগেরই মাতৃভাষা বাঙলা ছিলনা। কিন্তু এই সুলতানরা বাঙলাকে অন্যকোন রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের উপনিবেশ হিসাবে গন্য করেন নাই, বরং নিজ রাজ্য বা নিজ দেশ গন্য করে এখানে বসবাস করেছেন, চেষ্টা করেছেন এই দেশের মানুষ হয়ে যেতে, সেটা তারা পেরেছেনও।
বহিঃশত্রুর হামলা হলে এদেশীয় মানুষএর রক্ষক হিসাবে তারা যুদ্ধ করেছেন। ভুলে গেলে চলবেনা যে মধ্যযুগীয় বাঙলা ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের মূল পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন মুসলিম সুলতানরা। কর্নাটকএর অধিবাসী সেন রাজারা যেখানে রাজদরবারের ভাষা সংস্কৃতের প্রসারের জন্যে বাঙলা ভাষার উপর খরগহস্ত ছিলেন সেখানে মুসলিম সুলতানরা বাঙলা ভাষার প্রসারে ছিলেন যত্নবান, এমনকি খোদ দরবারেও তারা বাঙলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় সহযোগিতা করেছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে ‘বাঙলা’ শব্দের রাষ্ট্র পরিচয়এর জন্মই হয়েছে সুলতানী আমলে। বঙ, বঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি আদী নামে বাঙালার রাষ্ট্রিয় ইতিহাস সূপ্রাচীন।
কিন্তু এই ভুখন্ডের মানুষ প্রথম রাষ্ট্রীয় ভাবে ‘বাঙলা’র অধিবাসী হয়ে ওঠে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ(১৩৩৯-১৩৫৮)এর আমলে। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুরো বাঙলাকে এক রাজ্যের অধিনে আনেন এবং নিজে ‘শাহ ই বাঙাল’ এবং ‘সুলতান ই বাঙালা’ উপাধি গ্রহণ করেন। সেই থেকে বাঙলা শব্দ একটা রাজনৈতিক ভুখন্ড, একটি রাষ্ট্রের পরিচয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহএর শাসন আমলেই সূদীর্ঘকাল পর বাঙলা সাহিত্যের চর্চা আবার নতুন প্রাণ লাভ করে যা পরবর্তিতে অব্যাহত থাকে।
সুলতানি শাসনএর সাথে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পরাধীনতাকে তাই গুলিয়ে ফেলার অবকাশ নাই।
এবং সেইসাথে ব্রিটিশ উপনিবেশকেও এতো হালকাভাবে নিলে তা আমাদের জন্যে আত্মঘাতি হবে। নানা তর্কে অনেকেই যেই প্রসঙ্গ টানেন তা হলো অর্থনীতি। তাদের বক্তব্য হলো যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি কৃষকরা সুলতানী আমলেও শোষিত ছিল, ব্রিটিশ আমলেও ছিল, তাদের জন্যে এই শাসক শ্রেণীর পরিবর্তন কোন বিশেষ গুরুত্ব বহণ করেনা। অনেকেই এই উদাহরণ টানেন যে পলাশীর ময়দানে যুদ্ধ দেখতে যেই পরিমান সাধারণ জনগণ উপস্থিত হয়েছিল তারা যদি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামতো তাইলে ব্রিটিশরা সেইদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। এই উদাহরণটা একটা সত্য নির্দেশ করে, কিন্তু সেই সত্য এই না যে বাঙালি কৃষকএর কাছে সুলতানি শাসন আর ব্রিটিশ উপনিবেশএর ফারাক ছিলনা।
সত্যটা কি, তা নিয়া পরে আলাপ করছি। তার আগে এই তুলনামূলক শোষন সম্বন্ধে কিছু কথা বলা দরকার। আদতে সুলতানী শাসনের অর্থনীতি আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনএর অর্থনীতির মধ্যে তুলনা করা নেহায়েতই অনৈতিহাসিক বালখিল্যতা। এই দুইয়ের প্রক্রিয়া এবং শোষনএর পরিমানেও আছে রাত দিন ফারাক। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয়েছে সুলতানের সৈন্যবাহিনীর সাথে, তাতে সমাজের অন্য কোন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিলনা।
কিন্তু ১৭৬৪সালের বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমএর সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়ছিল ফকির সন্যাসীরা। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম পরাজিত হলেও এর পরে ফকির সন্যাসীরা শুরু করে বিখ্যাত ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ, এই পর্যায়ে গিয়ে আমরা দেখিযে ফকির সন্যাসীদের সাথে সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়েছে। জায়গায় জায়গায় বিদ্রোহ হচ্ছে, ফকির সন্যাসী এবং স্থানীয় কিছু সম্মানী ব্যক্তির নেতৃত্বে সাধারণ কৃষকরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, জীবন দিচ্ছে। ১৭৭৩ থেকে শুরু করে প্রায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে একের পর এক দাবানলের মতো বিদ্রোহ। পলাশীর ময়দানে যারা ছিল দর্শক, তার অল্পকিছুদিন পরেই তারা কেনো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠল, এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের বুঝা দরকার।
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধ করেছিলেন শ্রেফ একটা পক্ষের বিরুদ্ধে না, একটা কাল, একটা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়াই বাঙলায় একিসাথে ঔপনিবেশিক এবং পুজিবাদী যুগের সুচনা হয়। সিরাজ উদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মরণপন যুদ্ধ ছিল বানিজ্য কর্তৃত্ব কেন্দ্র করে। পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মিরজাফরের কাছ থেকে যাবতিয় বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা এবং বিপূল পরিমান টাকা উপহার এবং কোলকাতা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে বাগিয়ে নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোলকাতা যুদ্ধের ক্ষতিপুরণের পরিমান জানা যায় ১৭ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা।
এতসব অন্যায় বানিজ্য সুবিধা নিয়ে বাঙলার শাসন ক্ষমতা দখল করতে সময় লাগেনাই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, ১৭৬৪তে পেয়ে যায় বাঙলার দেওয়ানী। কর দেওয়া না, বরং এবার তাদের কর তুলে নেয়ার পালা। ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্রই লুটেরা, কম সময়ে অধিক লাভ তুলে নেয়ার ব্যাবসাই এই শাসনের আসল লক্ষ্য। প্রায় ৫ গুন কর বারিয়ে আর ধানের জমিতে জোর করে কৃষকদের দিয়ে আফিম চাষ করিয়ে ৭৬এর মন্বন্তর তৈরি করেছিল আধুনিক পশ্চিমের প্রতিনিধী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাঙলার ১ কোটি জনগণ সেই দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মৃত্যুবরণ করেছিল, যা ছিল পুরো বাঙলার মোট জনসংখ্যার ৩ ভাগের ১ ভাগ।
(বিস্তারিত) ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের স্বার্থে অথবা সাম্রাজ্য বিস্তারের বা রক্ষার যুদ্ধের অর্থযোগান করতে এইরকম কৃত্তিম দুর্ভিক্ষের জন্ম দিয়েছে ব্রিটিশরা বাঙলায় পরের দুইশ বছরের আরো বহুবার। ধানের জমিতে তারা কখনো নীল, কখনো আফিম চাষ করিয়ে বানিজ্য করেছে, আর না খেয়ে মরেছে বাঙলার সাধারণ জনগণ। পলাশীর ময়দানের দর্শকদের মুক্তিযোদ্ধা হতে তাই খুব বেশি দেড়ি লাগেনাই। সুলতানি আমলএর অর্থনীতি আর শোষনএর সাথে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্বের শোষন আর অর্থব্যবস্থার সাথে তাই কোনই তুলনা চলেনা। সুলতানি আমলে আর দশটা ফিউডাল স্যোসাইটির মতোই শোষনএর শিকার হয়েছে বাঙলার সাধারণ জনগণ, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন এই জনগণকে বানিয়েছে অথর্ব, শক্তিহীন, নিজভুমে পরবাসী গোলাম, যারা আজো ঠিকমতো মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখে নাই।
ফারাকটা আরো ভালোভাবে বুঝতে আমার বিভিন্ন লেখায় বারবার তুলে ধরা ঔপনিবেশিক শাসনএর তিনটা বৈশিষ্ট আবারো তুলে ধরছি নিচে-
১। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে কাঁচামাল।
২। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে সস্তা শ্রম।
৩।
উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশক পেয়েছে নিজেদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার।
আর এর উপরে ভর করেই উপনিবেশ বিকোষিত হয়েছে, ফুলে ফেপে মোটা হয়ে পশ্চিমে জন্ম দিয়েছে শিল্প বিপ্লব, বিলাশী ভোগবাদী আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা। ‘বাঙালির রক্ত চুষে ব্রিটিশ শিল্পবিপ্লব ঘটেছে’ এইটা কোন মিথ অথবা বারিয়ে বলা কথা না, পুরোদোস্তুর কঠিন বাস্তবতা।
উপনিবেশের এই তিন বৈশিষ্টের দিকে চোখ রাখলেই আমরা বুঝবো যে খাতা কলমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও আমরা এখনো ঔপনিবেশিক শাসন এবং শোষনের অধিন। এখনো আমরা কাঁচামাল আর স্বস্তা শ্রম বিক্রি করছি পশ্চিমা প্রভুদের কাছে, কখনো কখনো নিজেদের সম্পদ একেবারে মাগনা তুলে দিচ্ছি তাদের হাতে।
আবার তাদের তৈরি প্রক্রিয়াজাত পন্যের জন্যে বাজার খুলে দিচ্ছি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি বিদেশী বিনিয়োগ, পশ্চিমা কর্পোরেশনএর কাছে বাজার খুলে দেয়া, নিজেদের শিল্প উন্নয়ন নয়। এমনকি নিজেদের জ্বালানী সম্পদও ‘আমরা পারবোনা’ বলে নানান পিএসসি চুক্তির ছলে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে পশ্চিমা প্রভুদের দালাল শ্রেণী, নিজেদের জ্বালানী সম্পদ আমাদেরই কিনতে হচ্ছে বেশিদামে। নানান প্রক্রিয়ায় এই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে কায়েম রেখেছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভুরা। এইসব প্রক্রিয়া নিয়া আমি বিভিন্ন লেখায় বিস্তারিত বলেছি, আগ্রহীরা আশা করি পড়ে দেখবেন।
পলাশী থেকে আমাদের আসলেই কিছু শেখার আছে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে হয়তো এখন সবাই একমত হবেন যে, অবশ্যই আছে। কিন্তু কি শেখার আছে? তার আগে এই লেখার মাঝখানে যেই প্রশ্নটা করেছিলাম সেই প্রশ্নে ফিরে যাই, ‘পলাশীর ময়দানে যারা দর্শক, বক্সারের যুদ্ধে অথবা ফকির সন্যাসী বিদ্রোহে তারা কেনো মুক্তিযোদ্ধা হলো?’ ঔপনিবেশিক শাসনএর যে নিদারুন বাস্তবতা তাতে মুক্তিযোদ্ধা কেনো হলো সেই উত্তরটা আমাদের কাছে আছে কিন্তু পলাশীর ময়দানে তারা দর্শক কেনো ছিল সেই প্রশ্নের উত্তরও আমাদের দরকার। একটা বিষয় পরিস্কার যে সিরাজ উদ্দৌলা সেই পরিমানে গণসম্পৃক্ত ছিলেন না যাতে জনগণ নিজ আগ্রহে তাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবে। তার দরবারে ব্রিটিশদের চর এবং বিশ্বাসঘাতকরা তাকে শুধু জনগণই না বরং নিজের সেনাবাহিনীর ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত করেছিল সেটাও আমরা জানি। আর উপনিবেশ কি জিনিস সেইটা আগেভাগেই এই দেশের সাধারণ জনতা বুঝতে পারেনাই, আর যখন বুঝেছে তখন বিদ্রোহ করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে।
এই ব্যর্থতার পেছনেও ভুমিকা রেখেছে সেই দালাল শ্রেণী। ফকির, সন্যাসী, কৃষকরা যেখানে বিদ্রোহ করছে সেইখানে হিন্দু জমিদার, নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব শ্রেনী, ব্রাক্ষ্মন্যবাদী সাম্প্রদায়িক শিবির তখন আবির্ভুত হয়েছে ব্রিটিশদের সহায়ক শক্তি হিসাবে।
মিরজাফর ছিলেন, গোলাম আজম ছিলেন, এদের আমরা চিনে গেছি। কিন্তু আজকে আমাদের খনিজ সম্পদ নয়া উপনিবেশের প্রভুদের হাতে কে বা কারা তুলে দিচ্ছেন তা যদি আমরা চিহ্নিত করতে না পারি তাইলে পলাশী থেকে আমাদের কোন শিক্ষা নেয়া হবেনা। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা নিতে হবে পলাশীর ময়দানে যারা দর্শক ছিলেন তাদের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের বুকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন নিয়া হাজির হয়েছে মার্কিন, রাশিয়ান, চীনা এবং ভারতিয় ঔপনিবেশিক শক্তি। এই অবস্থায় আমরা দর্শকের ভুমিকা নিতে পারি এবং ভবিষ্যতে এই দেশের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে আবারো মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে পারি। তবে সেটা পলাশী থেকে শিক্ষা নেয়া হবেনা।
আসেন পলাশী দিবসে আমরা আজ পলাশী থেকে শিক্ষা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।