সাত চল্লিশে ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকার এ ভূখন্ড স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো বলেই চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত এ অঞ্চলের ৪ কোটি ভাগ্যাহত ভুখা-নাঙ্গা মুসলমান একটি স্বাধীন জাতির মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলো। নির্জীব, পতিত জেলা শহর ঢাকা দু’শ বছর পর আবার রাজধানী হিসেবে তার হারানো গৌরব ফিরে পায়। সে সাথে শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য উন্মোচিত হলো এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার; তারা কথিত বর্ণহিন্দু জমিদারদের বল্গাহীন শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তির আলো দেখতে পায়; তাদের জন্য সৃষ্টি হয় নিজস¦ ভাগ্যকে গড়ে তোলা তথা এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুনভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার এক সুবর্ণ সুযোগ। দেশে গড়ে উঠলো নানাবিধ শিল্প ও কলকারখানা, ব্যাংক, বীমা; ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেও শুরু হলো মুসলমান ছেলে-মেয়েদের অবাধ ও দৃপ্ত পদচারণা। অথচ ‘একাত্তর-পরবর্তী সময়ে, সে কথা ভুলিয়ে দিয়ে রটনা করা হলো ৪৭-এর স¦াধীনতা ভুল ছিলো।
মুসলমান নামধারী কতিপয় বুদ্ধিজীবী উচ্চকণ্ঠে প্রচার করছে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিলো বলেই পাকিস্তান টেকেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মনের কোণে প্রশ্ন জাগে- তাহলে ভারত টিকে আছে কিসের ভিত্তিতে? উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ ও রাজপুতদের সাথে পশ্চিম ভারতের মারাঠাদের এবং দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের সাথে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মুখের ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির কোনোই মিল না থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় বন্ধনের ভিত্তিতেই তারা একই রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় বসবাস করছে কেমন করে?’ (হায়দারাবাদ ট্র্যাজেডি ও আজকের বাংলাদেশ’, আরিফুল হক, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ : মে ২০০১)
আর কেউ যদি সত্যিই মনে করে, সাতচল্লিশের পার্টিশন ভুল ছিলো, তবে তার কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার। কারণ ১৯৪৭ সালের পার্টিশনে অবিশ্বাসীরা অখ- ভারতে বিশ্বাসী, তারা আমাদের স্বাধীনতার দুশমন।
পলাশী প্রান্তরে নবাবের পতনের পর ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন বিজয়ীর বেশে নৌদস্যু সর্দার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ এলো মুর্শিদাবাদে। সাথে ছিলো দু’শ গোরা সিপাহী আর পাঁচশ’ কালো সিপাহী।
মুর্শিদাবাদের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মুর্শিদাবাদবাসী সোল্লাসে শুভাগমন জানাল ইংরেজ নৌদস্যু সর্দার রবার্ট ক্লাইভকে। সেদিন রাজপথে যে বিরাট জনতার সমাবেশ হয়েছিলো তারা যদি শুধু লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল নিয়ে এগিয়ে আসতো তাহলেও ক্ষুদ্র ইংরেজ সেনাদের বিনাশ করতে সক্ষম হতো। কিন্তু সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি। মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিন্দুদের বিদ্বেষই এর অন্যতম কারণ। তৎকালীন হিন্দুরা মনে করতো দেশের স্বাধীনতা মানেই মুসলমানদের স্বাধীনতা।
মুসলিম শাসনামলে হিন্দুদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা এবং প্রাপ্তি সুযোগ ঘটলেও দেশে মুসলিম শক্তির বিপর্যয়ই ছিলো তাদের কাম্য। আর তাই এদেশে ইংরেজ শক্তির অভ্যুদয় তাদের নিকট ছিলো শুধু প্রভু বদলের পালা।
পলাশীর যুদ্ধ ছিলো এক সুপরিকিল্পত গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করার নামে এসেই পাঁয়তারা করতে থাকে কিভাবে এদেশে তাদের রাজত্ব কায়িম করা যায়। ক্রুসেডের কুখ্যাত মুসলিমবিদ্বেষী ইংরেজ দস্যুরা তাই পলাশী যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই নবাব দরবারের হিন্দু অমাত্যদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে মুসলিম শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে উস্কানি দিতে থাকে।
এ কাজে তারা সহযোগী হিসেবে পেয়ে যায় নবাব দরবারের উচ্চপদে সমাসীন জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ নামক কতিপয় নরঘাতক হিন্দু অমাত্যদের। সমগ্র মুসলিম শাসনামলেই প্রশাসনে উচ্চপদে নিয়োগ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদাভেদ ছিলো না। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারেও জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, রাজবল্লভব, রায়দুর্লভদের উচ্চ পদে সমাসীন থাকা থেকে বোঝা যায়, এ ব্যাপারে নবাব কতটা উদার ছিলেন। কিন্তু জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ প্রমুখ ঘাতক হিন্দু অমাত্যরা নবাবের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেনি। তারা ভেতরে ভেতরে ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চক্রান্তে যোগ দিয়ে কিভাবে এদেশে মুসলিম শাসনের পতন ঘটানো যায়- সে কাজে তৎপরতা চালাতে থাকে।
ঐতিহাসিকদের মতে, এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলো ৩টি শক্তি- প্রথমত, সিরাজউদ্দৌলার নবাব হওয়ার বিরোধিতা করে তার আত্মীয়-স¦জনের একটি অংশ। নবাব হওয়ার পরও তারা নবাবের সঙ্গে অসদ্ভাব অব্যাহত রাখে। দ্বিতীয়ত, নবাবের সভাসদদের একটি অংশ ছিলো নবাবের বিরুদ্ধে। অল্প বয়সী একজন নবাবের কর্তৃত্ব মানতে তারা রাজি ছিলো না। এই গ্রুপটি পরিচালিত হতো জগৎশেঠ, মাহাতাব চাঁদ, রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র, দুর্লভ রায় প্রমুখ হিন্দুপ্রধান ও বিত্তবানদের দ্বারা।
নবাব হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা হিন্দুপ্রধান ও বিত্তবানদের ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যায়-অপকর্ম, লুণ্ঠন ইত্যাদি প্রতিরোধের উদ্যোগে নিয়েছিলেন। ফলে এরা তার উপর অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তৃতীয়ত, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দস্তকের অপব্যবহার করে অনেকদিন ধরে রাজস¦ ফাঁকি দিচ্ছিলো। তিনি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সিরাজউদ্দৌলা নবাব থাকলে ব্যবসার নামে লুটপাট যে আর চলবে না এটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝে ফেলে।
এই পর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায় ঘাতক জগৎশেঠদের ও পতন হয় নবাবের।
আমরা ক’জন এই বিশ্বাসঘাতকদের কথা মনে রেখেছি? মনে রাখিনি, ভূলে গিয়েছি সবাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।