পলাশী হতে পিলখানা ও বাংলাদেশ
ড. কালাম এ. মীর
পিলখানা। বিডিআর সদরদপ্তর। ২৫-২৬শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক নির্মম অধ্যায় রচিত হচ্ছে। কী আকুল আবেদন জানিয়ে ছিলেন অবরুদ্ধ সেনাদল! ‘আমরা মৃত্যুমুখে, আমরা নিরস্ত্র, আমাদের রক্ষা করো!’ তাঁদের আকুতি আকাশে বাতাসে অনুরনিত হয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ ভারি করে ছিল।
ফিসফাস্ আলাপচারিতায় হলো কালাতিপাত। তবে নিখুঁত পান্ডুলিপি ধরে কি এক ভয়ংকর নাটক অভিনীত হলো। নাট্যজন আর পার্শ্বজনদের কী সুললিত অক্লেশ আসা-যাওয়া! সংলাপ ছিল প্রগাঢ় অনুশীলনে সাবলীল। নাটকের শক্তিমান, অসাধারণ, মেধাবী ও সাহসী প্রযোজক-পরিচালকরা ছিলেন ‘অজানা’ অশরীরী। আপন কৃতিত্ব জাহিরে এত লজ্জা তাদের! কিন্তু, অবাক সেলুকাস! অভিনয়ের মাঝখানেই যে নট-নটীরা পেয়ে গেলো ‘ঝটিকা’ একাডেমী পুরষ্কার! ‘তোদের কারো হাতে নর-মুন্ডু কারো হাতে পা, রাত-আঁধারে টেনে-হিঁছড়ে সবকটাকে খা’ পুরস্কার সনদে তাজা রক্তের লেখা বাণী।
আর যায় কোথায়, প্রেত-পেত্নি উল্লসিত চরণে দিবস-রাতি নেচে গেল উন্মত্ত শবনৃত্য। বিমূঢ় আহত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলেন সেনাদল - তাদেরি রক্তে খেলছে পিশাচ হোলিখেলা। অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা - ‘সাহায্য আসছে’। এই বুঝি সহযোদ্ধারা রণহুঁণ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়লো পিশাচদের উপর। কিন্তু, কেহ আসে না! আপন হাতের ঘড়ির ঋজুতম কাঁটাটিও যেন এক অসহনীয় ভারে স্থবির হয়ে অছে, নড়ছে না।
- তবু, কেউ আসে নি! একে একে নিভে গেল তাঁদের প্রাণ-প্রদীপ। আক্রান্ত মা-বোনের আকুল-আর্তনাদে কেঁপে ছিল পিলখানার নিলাজ গুমোট বাতাস, মাটি। ঘাতক-শ্রীল-শব্দে পদ্মা-মেঘনার অতল পানিতে রূপালী ইলিশের সন্তরণেও বুঝি লেগেছিল ভীরু চঞ্চলতা। কিন্তু, তখনো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে - আমাদের সেনাপতি!
প্রেত-পেত্নির ঠাঠা হাসি এখনো বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস বিদ্রূপবিষে জর্জরিত করছে। কাটা ঘায়ে নুনের মত - কে ঐ চৈতী হাওয়ায় ঢাললো আরো মাতাল মদ! পিলখানাযুদ্ধে যারা শোনালো শান্তির সুর, তাদেরি সামনে এদেশের বিদ্যালয় হচ্ছে রণক্ষেত্র! আগুন লাগছে অট্টালিকায় বিনা বজ্রপাতে।
ক্লুহীন! পাগল, রক্ষক যদি তোর ভক্ষক হয় বাঁচাবে আর কে? কি কুষ্ঠে ধরলো তোকে মা, পঁচে-গলে পড়ছে খসে গা! নিভে যাচ্ছে একে একে তোর সব আলোর দেউটি। আঁধার বুঝি এলো ঘনিয়ে আবার। পিলখানা-পিশাচের চোখ আশার আলোয় চিক্চিক্ করছে। বাংলাদেশের আকাশে ধীরে ধীরে আঁধার আসিছে নামি। আইন-আদালত পড়ছে ধ্বসে, ধরছে যে কেউ গলায় ছুরি! তবু ‘দুর্গামাতা’ প্রসাদ পেয়ে হাসছে হিহি ডাইনি বুড়ি।
মন্ত্র জপছে ডাইনি, ‘কিসের আলো, কিসের আইন! আমিই ভাল, আমিই ডাইন!’। সেই তালে নাচে সকল চেলা-চামুন্ডা - তা তা থৈ! আপনার মধুর বাণী আরেকটু ছাড়েন, মাইজী! আমরা উজ্জীবিত হই! এই নির্লজ্জ মোসাহেবির নাই কোন প্রতিবাদ। ভাবলেও মনটা ব্যাথায় হতাশায় মুষড়ে উঠে। আর কত পানি উঠলে, ওগো কান্ডারি, তুমি বলবে, ‘এবার তবে সেচার পালা’। এখনো তুমি নিশ্চুপ, হে ‘সেনাপতি’।
কী অমোঘ আনুগত্য তোমার! ওগো, বাংলাদেশের মাটি তুমি দ্বিধা হও, আমি আমার ল্জ্জা ঢাকি!
পলাশী হতে পিলখানা, আর কত দূরে যাবে মীরজাফর,
এখানেই দিলাম তোমাকে - তোমার নিজের হাতের কবর।
বন্ধু সাবধান! ভেবো না ঘাতক চুপে এসে চুপে চলে গেছে,
এক রং ধরে এই দেশের পরিবেশে হাসিমুখে মিশে আছে।
আবার আসিবে আঘাত ওরে, আবার আসিবে ‘ভয়াল মার্চ’
বাংলাদেশের মানুষ হও হুঁশিয়ার, ঘরে ঘরে কর আত্ম-সার্চ।
নিবিড় বৃক্ষরাজি ছায়াঘন, ধান-পাট-শস্য-সবুজ বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে বর্গি-বৃটিশ-হিন্দু অত্যাচার-অনাচারে অতিষ্ঠ পূর্ব বাংলার মুসলমান জনপদ স্বাধীনতার জন্য ছিল উন্মুখ।
বর্ণহিন্দুদের কাছে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থান কোন পর্যায়ে তার ব্যাপ্তি পরিমাপ করার সুযোগ এই স্বল্পপরিসরে নাই। সমাজের নিম্নতম স্তরেও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের একটা লিখনচিত্র পাই সাম্যবাদী লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ কুবের কন্যা গোপীর আচরণে। হোসেন মিঞা সচেতন ‘আলগোছে’ পানি পান করে ঘটি রেখে দিলেও গোপী বৃষ্টিজলে সেই ঘটিটি বার বার ধুয়ে ‘শুদ্ধ’ করে নিয়ে ছিল। পদ্মাতীরের জেলে পাড়ার এই ‘কুবের-গোপী’ বর্ণবাদী হিন্দু সমাজে বঞ্চিত-অবহেলিতদের করুণ প্রতিচ্ছবি। এই শোষিতদের কাছেও যদি মুসলমানদের অবস্থান ‘শুদ্ধ’ না হয়, তবে বর্ণহিন্দুদের কাছে মুসলমানদের অবস্থান কোথায়? তার পরেও উক্ত ‘কুবের-গোপী’ আর ‘হোসেন মিঞা’-র হিন্দু-মুসলমান সমাজ যুগ যুগ ধরে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বাস করেছে এই বাংলাদেশে।
যে সংঘাত-বিবাদ হয়েছে তা মূলতঃ হীন রাজনৈতিক এবং বৈষয়িক কারণে, ধর্মীয় নয়। প্রসঙ্গতঃ মানিকের ‘হোসেনমিঞা’-ই কি বাস্তবের শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-মুজিব-জিয়াদের মিছিল? হয়তো মানিক বন্দোপাধ্যায়ই জানেন এ কথা! প্রশ্ন করলে, হয়তো তিনি আমাদেরকে বলতেও পারেন। কিন্তু যা বলছিলাম, পাকিস্তানী আমলে হিন্দু সহপাঠীর হাত ধরে হেঁটে গিয়ে বসে গেছি আশ্রমের উঠানে কলাপাতায় দেয়া ভোজ আর পায়েসের জন্য। আরো বড় হয়ে সেই আশ্রমের শান্ত পরিবেশে অংক কষেছি, রাতে থেকেছি, দিনের পর দিন - কখনো বুঝি নি আমি অনাকাঙ্খিত। আমার ‘মাষ্টার মশাই’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকের অধ্যাপক পরিতোষ চন্দ্র রায়, তাঁর ছাত্রজীবনে আমাদের বাসায় পড়াতে এলে আম্মা যখন তাঁকে স্নেহ করে এক কাপ দুধ পাঠাতেন এবং যে আনন্দচিত্তে তিনি তা পান করতেন, এ সকল দেখে কখনো মনে হয় নি এই বাংলাদেশে ‘হিন্দু সংস্কার’ আর ‘মুসলমান উন্মাসিকতা’ আমাদের স্বাভাবিক জীবন-প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে।
বৃটিশ আমলে অনিবার্য কারণেই সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য অবিভক্ত বাংলার বাঙালি মুসলমানরা মরিয়া হয়ে ছিল। বাঙালি মুসলমানরা বর্ণহিন্দুদের প্রভুত্ব আর তাদের অন্যায়-অবিচার-অনাচার হতে মুক্তি চায়। এই আকাঙ্খার এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৪৭-এ। সমসাময়িক অবাঙালি ভারতীয় মুসলমানদের ছিল একই দাবী। তখনকার সময় ও রাজনৈতিক ঘটনাক্রমে কেবল ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলাম।
সব কিছু ছাড়িয়ে যা ছিল উজ্জ্বল স্থির নক্ষত্রের মত ভাস্বর তা হলো, ‘স্বাধীনতা’। এই বাংলার মুসলিম জনপদের স্বাধীনতা। আমাদের এই আকাঙ্খায়, স্বদেশী বা বিদেশী, কারো যদি সন্দেহ থাকে তবে তিনি বা তারা ভুলের মহাসাগরে ভাসছেন। বাংলার মুসলিম জনপদকে তারা বিভ্রান্তির ঘুর্নিপাকে ছিন্ন-ভিন্ন করতে পারেন, নির্লজ্জ মীরজাফরীতে মর্মাহত করতে পারেন, আনবিক শক্তিতে বাষ্পায়িত করতে পারেন, ঘটনার বিভৎসতায় স্তম্ভিত করতে পারেন, কিন্তু, এই জনপদের মুসলমানদের স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে পরাজিত করতে পারবেন না। ১৯৭১-এ পাকিস্তানীরা চেয়েছিল, পারে নি।
কিন্তু, একটি স্বাধীন জনপদ কি শুধু এই বিভ্রান্তকারি আর মীরজাফরদের মোকাবিলা করেই যাবে? তাহলে কখন পাবে তারা স্বাধীনতার স্বাদ?
সাতচল্লিশে পাকিস্তানী রাজনীতিকরা কৌশলে ‘অপহরণ’ করেছিল আমাদের স্বাধীনতা। ইসলাম ছিল তাদের মুখের বুলি, অন্তরে লোভ। তাদের অন্তরে পূর্ব পাকিস্তান ছিল একটি উত্তম উপনিবেশ, যত দিন রাখা যায় শোষণের নিগঢ়ে বেঁধে! বুঝতে আমাদের দেরি হয় নি। ঘৃনা আর ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন। লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো দূরাগত হানাদারমুক্ত এই বাংলাদেশ।
কিন্তু, কী দুর্ভাগ্য আমাদের! একাত্তরে হলো সাতচল্লিশের পুনরাবৃত্তি! এবারের অপহরণকারী আর কেহ নয়, আমাদেরি সজাতি এবং স্বদেশী, কিন্তু অতীব স্বার্থপর ও চরিত্রহীন রাজনীতিক গোষ্ঠী। মহান মুক্তিযুদ্ধের একক কৃতিত্বের দাবিদার, স্বার্থান্ধ ও কোন্দললিপ্ত কিছু রাজনৈতিক দল; এদের প্রধান কর্মকান্ড ও লক্ষ্য হলো লুন্ঠন-শোষণের জমিদারি-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। এদের অশেষ শোষণ, লুন্ঠন ও নিষ্ঠুরতা দূরাগত হানাদারকেও লজ্জিত করবে। বড়ই পরিতাপ! এই মুসলমান জনপদ কেবলি ‘কড়াই থেকে চুলা, আবার চুলা থেকে কড়াই’- এই পরিনামের আগুনে জ্বলছে পুড়ছে। এর শেষ কবে হবে? আরেকটা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কি আছি? আমরা অপেক্ষা করেই থাকবো?
ইসলাম ধর্মের উদারতায় আস্থাশীল হয়ে আমরা পাকিস্তানীদের সাথে রাখিবন্ধন করেছিলাম ৪৭-এ।
কিন্তু, ইসলাম পাকিস্তানীদের কতটুকু উদার করতে পেরেছে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ৭১-এ। ধর্মকে যেই পাত্র ধারণ করে তারি আকার প্রাপ্ত হয়, তারি মন-মানসিকতায় প্রকাশ পায় ধর্ম। আমরা মানুষ চিনতে ভুল করেছি। পাকিস্তানীদের সাথে সেই রাখিবন্ধন ছিল আসলে কূটকৌশলী আরেক প্রভুত্বকে মেনে নেয়া। কিন্তু, আশ্চর্য! আমরা একই ভুল করলাম আবার ৭১-এ ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র নামে রবি ঠাকুরের গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন জীবনের শুরু থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত! অথচ, তাঁর সুবিশাল সৃষ্টির মাঝেও বাঙালি মুসলমানদের স্থান হয় নি।
যেই কবি বাংলা কল্পরাজ্যের মহারাজা ছিলেন, তিনি তাঁর কল্পনাতেও একটি উত্তম মুসলিম বাঙালি চরিত্র সৃষ্টি করেন নি। তিনি অক্ষম ছিলেন না। তবে কেন? কারণ, রবি ঠাকুর ছিলেন সেই হিন্দুদের প্রতিভূ যাদের কুষ্ঠিতে বাঙালি মুসলমান মানুষের মর্যাদা পায় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সামাজিক অবস্থানের ভিত্ নড়াতে চান নি স্বজাতি-মানবতার প্রয়োজনেও; অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের প্রতি একটু মায়া, এমন কি একটু করুণা প্রদর্শন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ব্রাহ্মণ্য-হিন্দু-বর্ণবাদের মুখপত্র এবং সেই প্রয়োজনেই রচিত।
ভারতের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গান আমাদের জাতীয় সংগীত করার ভিতর দিয়ে আমরা পাকিস্তানীদের অনুরূপ কূটকৌশলে এবার ভারতীয়দের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছি। কী মধুর, এতকাল পরে আমরা আবার হিন্দু-প্রভুত্বের জয়গান গাই!
যে বিষয়টি আরো ইন্টারেস্টিং, কিন্তু অনুল্লেখিত, তা হলো এই রবীন্দ্রসংগীতের সূক্ষ ‘শক এন্ড অ’ উপাদানটি। বিত্তশালী, জমিদার ও সামাজিক স্তরের আকাশছোঁয়া অবস্থানের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা...’ গানের সুর শুনলে, পাঠ করলে, অথবা স্মরণে আনলেই যে চিত্র মানসপটে ভেসে উঠে তা হলো আবক্ষশ্বেতশ্মশ্রুমন্ডিত, যেন স্বর্গ হতে নেমে আসা, এক দেব-মুর্তি। এই বাংলাদেশের ‘বাঙ্গাল’, যারা সংখ্যায় নব্বুই শতাংশেরও অধিক, এদের মগজ ‘সাইজ’ করার যে উপযোগ এই গানের ভিতরে আছে তা সহজে অনুমান করে ছিলেন সুচতুর রাজনীতিক গোষ্ঠী।
এই ‘সোনার বাংলা’ গানে যে মনস্তাত্ত্বিক বার্তাটিও দেয়া হয় তা হলো, সমাজের উঁচু স্তরে অতি অল্প কিছু মানুষ থাকবেন, তাঁরা হবেন বিত্তশালী, জমিদার এবং রাজা। তাঁরা ধরাছোঁয়ার উপরে, তাঁরা পূজনীয়! তোমরা তাঁদের স্তুতি গাইবে ও শুনবে - সকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে, তাঁদের সৃষ্ট ‘আমার সোনার বাংলা’ রাজত্বে; এটাই দেব-বাণী এবং মান্য!
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বলবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা, প্রকৃতির কথা এবং এই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার কথা! বাংলাদেশের যে কোন পরিবারের লেখার টেবিলের কয়টা পাতা উল্টালেই এই দেশের প্রতি পরম মমতায় লেখা গানের চরণ দু’চারটি পাওয়া যাবে। এই নির্বাচিত চরণগুলিই হবে আমাদের জাতীয় সংগীত। যে কারণেই নির্বাচিত হোক রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জাতীয় সংগীত, এই নির্বাচন বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোজগতে একটা বিরূপ চাপ যা অগ্রহণযোগ্য এবং তাই এর পরিবর্তন অপরিহার্য। এই বাঙালি রাখিবন্ধনের সূত্র ধরে আগ্রাসনের যে স্পষ্ট লক্ষণ আমরা দেখছি তা আমাদের পাকিস্তানী অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করায়।
তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে যেমন ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্বে’ আস্থাশীল এবং তার জন্য লড়াকু খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না, বাংলাদেশেও ‘বাঙালি ভ্রাতৃত্বে’ আস্থাশীল এবং এর পক্ষে মাস্তান খেলোয়াড়ের অভাব নাই। এরা সেই ‘রাজাকার’ ‘আলবদর’-এর ‘বাঙালি ভার্সন’ হয়ে পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়বে তাদের গূঢ় স্বার্থ রক্ষার জন্য। এমন বাধা আমরা আগে অতিক্রম করেছি, এবারও করবো!
এবারের আঘাত আসছে বিভিন্ন রূপে এবং মাত্রায় - সব কিছুই ঘটানো হচ্ছে গভীর বিচার বিশ্লেষণ করার পর সূক্ষ-প্রয়োগ পদ্ধতিতে। এ এক ধরনের খেলা- ‘দুর্বলের’ সাথে ‘শক্তিধরের’। এ খেলার সহচরীর অভাব এ দেশে আগেও হয় নি, এখনো হয় না।
এই অপরাজনৈতিক খেলার প্রথম এবং প্রধান সূত্র হলো বাঙালি মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিকে নড়বড়ে করা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এই যে, ইসলামের আবরনেই ইসলামকে কালিযুক্ত করছে এই অপশক্তি। প্রকৃত শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিবর্জিত অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে ওঠা ওই নষ্টলক্ষ্যের অন্যতম উপাদান। মুসলমান বাঙালিদের একটা স্বতন্ত্র সমাজ ও সংস্কৃতি আছে। কিন্তু, হিন্দু বাঙালিদের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলে প্রচার ও প্রসার করা ওই নষ্টলক্ষ্যের আরেক হীন চেষ্টা।
জংগীতত্ত্ব, পিলখানা হত্যাকান্ড আর ‘বঙ্গভূমি’-লড়াই এক সূত্রে গাঁথা। একই লক্ষ্য, ভিতরে বাহিরে অস্থির করে বাংলাদেশকে নতজানু করে তাদের উদ্দ্যেশ্য হাসিল করা। এবং সেই উদ্দেশ্য অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের স্বার্থ এবং স্বাধীনতার পরিপন্থী।
‘বঙ্গভূমি আন্দোলন’ বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল। এই কৌশলের প্রধান বেনিফিশিয়ারি বাংলাদেশের চরম দুর্নীতিবাজ, এই দেশের স্বার্থবিরোধী, এবং অপরাধী শাসকগোষ্ঠী।
যেই হিন্দু-মুসলমান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাবার তারা গেছেন, এখনো আসা-যাওয়ায় আছেন। যাদের সংগতি আর চালচুলো নাই তারা, আবার অনেকে হয়তো জন্মভূমিকে ভালবেসেই, মাটি আঁকড়ে আছেন উভয় প্রান্তে। ‘বঙ্গভূমি’ নয়, সাতচল্লিশে সীমান্ত নির্ধারণে বাংলাদেশকে যে যথেচ্ছ ঠকানো হয়েছে, ভারতের কাছে বাংলাদেশ তার প্রতিকার চাওয়ার অধিকার রাখে। বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতায় অনেক বেশি সহনশীল। হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃষ্টান বাংলাদেশের অসাধারণ মোজায়িক।
পশ্চিম বাংলায় বাঙালি মুসলমান আর বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের অবস্থান পর্যালোচনা করে দেখুন! তার পরেও যারা বাংলাদেশে এই সম্প্রদায় নিয়ে রাজনীতি করছেন তারা আগুন নিয়ে খেলছেন। এই আগুন সবার আগে তাদের গায়েই লাগতে পারে। আর দাবানল হয়ে অনেক কিছুই গ্রাস করতে পারে। এখানে, ভারতীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আসা বিহারীদের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানীদের সমর্থনপুষ্ট এই বিহারীরা বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে) ভালভাবেই শিকড় গেড়েছিল।
এখানে বিহারীদের অধিষ্ঠানে পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল - তথা এখানকার বাঙালিদের উপর একটা নজরদারি করা, খোলা খবরদারিতে না রাখলেও। বাঙালিদের কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ছিল যে, এই বিহারীরা পাকিস্তানী সমর্থনপুষ্ট, পাকিস্তানপন্থী ঊর্দুভাষী, বাঙালি-সমাজ-বহির্ভূত শ্রেণী। উপরওয়ালাদের সমর্থনে ও সহায়তায় অথচ পরিশ্রমী এই বিহারীরা এখানকার বিভিন্ন পেশা ও চাকুরিতে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিধর পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে বিহারীরা তাদের রক্ষাকর্তা ভেবে ছিল। - পরের ইতিহাস আমাদের জানা! যা বলতে চাই তা হলো, একটা বিষয় এখন স্পষ্টতর হয়ে উঠছে যে, আমাদের হিন্দু সম্প্রদায় সচেতনে বা অবচেতনে একটা বিশেষ পরিচয় নিয়ে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন।
তা হলো, তারা ভারতপন্থী, ভারত-সমর্থনধন্য আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক, আওয়ামী ভোটব্যাংক, এবং আওয়ামী সহায়তায় সমাজে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন। স্বদেশে তাদের মেধা ও পরিশ্রম এই পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য ভাবে। বাংলাদেশের আকাশে এ কি অশনিসংকেত? আমি মনে করি, এ সকলের ভাববার বিষয়!
পাকিস্তানীদের হাত ধরে আমরা স্বাধীনতার বীজ বপন করে ছিলাম ১৯৪৭-এ। বাইশ বছর শেষে কল্পনাতীত এক ভয়াল ২৫শে মার্চের পরে, এবার ভারতীয়দের হাত ধরে, সেই পাকিস্তানী বিষবৃক্ষ আমরা উপড়ে ফেলেছি। মুছে দিয়েছি আমাদের বিজাতীয় সংগীত ‘পাকছার জমিন’।
কিন্তু, বাস্তবতা এই যে আমরা দাঁড়িয়েছি এখন আরো বড় প্রতিপক্ষ ভারতের সামনে। এই বাংলাদেশের গাত্র লেহনে-শোষণে পিন্ডিওয়ালা আর দিল্লীওয়ালার রুচিতে-চরিত্রে তিলমাত্র পার্থক্য নাই। বরং দিল্লীওয়ালার কলকাঠি নাড়াবার সুযোগ এখন বেশি। আরো অপ্রিয় কথা এই যে, বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের পাশে থাকার চেয়ে হিন্দী-দিল্লীওয়ালার লাড্ডুকে অনেক বড় এবং মিষ্টি ভেবেছেন। আরো পরিতাপের বিষয় হলো এই যে তারা এই ‘বাঙ্গালদের’-কেও ‘দিল্লীকা-লাড্ডু’ খাওয়াবার জন্য অক্লান্ত ক্লেশ স্বীকার করছেন।
অতএব, বন্ধু সাবধান! লোভ, হিংসা আর বিদ্বেষের আগুনে তোমাকে আবার পুড়তে হবে। আরেক অকল্পনীয় ‘২৫শে মার্চ’ আসবে। এই রাত্রি হবে আরো ভয়াল কালো। এর আলামত স্পষ্ট। কিন্তু, এবারের হানাদার হাজার মাইল দূরের নয়।
এরা আপন ঘরের, ভিতরের, বাহিরের, এবং নিকট প্রতিবেশী। এই যুদ্ধ হবে আরো অধিক মর্মান্তিক ও প্রলম্বিত। আর, এই যুদ্ধে আমাদের কতটুকু ক্ষতি হবে তা নির্ভর করবে আমাদের সজ্ঞান মানসিক এবং বাস্তবিক প্রস্তুতির উপর!
এক দিন, হয়তো ভবিষ্যতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের অতীত নিষ্ক্রিয়তার জন্য অনুতপ্ত হব। তখন থাকবে সুগভীর অনুতাপ! হয়তো, সেই অনুতপ্ত-ছাইভস্ম হতেই আগুনে পোড়া পবিত্র কন্ঠ গেয়ে ঊঠবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত - ও বাংলাদেশ, ও আমার বাংলাদেশ! আমার গানের দেশ, আমার প্রাণের দেশ! এই সে দেশ - যেখানে জীবন দেয় ভাষার তরে, এই দেশের মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধ করে! এই সে দেশ, এই সে দেশ! এই দেশের বাতাসে ভাটিয়ালী সুর, সবুজ মাঠে ভাসে ভাওয়াইয়া মধুর। এই দেশের বাণী - যুদ্ধ নয়, শান্তি! মানুষের জন্য মানুষ, যুদ্ধে আসুক ক্লান্তি! এই দেশ এই সুন্দর পৃথিবীর অন্যতম, সবার কাঁধে কাঁধ মিলায় - হাঁটে সম।
এই দেশ আমার জন্মভূমি - আমার গৌরব, আমার গভীর মমতা, এই আমার সব। আমার সকল ধ্যানে, সকল ধারণায় - সকল চিন্তা-চেতনায় আছে অনিমেষ, ও বাংলাদেশ! ও আমার বাংলাদেশ!!
বন্ধু, আমি আমার কথা ও গান লিখেছি। তুমি তোমার কথা ও গান লিখো। আবার যেন আমাদেরকে হাতড়াতে না হয় - অন্ধকারে কোন দিন।
(কপিরাইট © কালাম এ. মীর ২০১০)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।