মাত্রাতিরিক্ত রকমের জ্ঞেয়ানী জনেরা আমার ব্লগের উটকো অতিথি বলে বিবেচিত হবে।
সার-সংক্ষেপঃ
ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশের উদাহরণ টেনে কেউ কেউ দাবী করেন পুলিশকে স্থানীয় সরকারের অধীনস্ত করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুলিশ বিভাগগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়। এই সব পুলিশ বিভাগ কোন এক সময় নির্বাচিত মেয়রদের ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও দলীয় পক্ষপাতিত্বের জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এদের ব্যর্থতার জন্যই সেখানে রাষ্ট্রীয় ও ফেডারেল পুলিশের উদ্ভব ঘটেছে।
অধিকন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ বিজ্ঞানী ও পুলিশ গবেষকরা কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীতে উত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
বৃটেনের পুলিশ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার থেকে রাষ্ট্রীয় সরকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুলিশ বাহিনীগুলোকে একত্র করে ইতোমধ্যেই বড় বড় পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বৃটেনে ২০০ এর বেশি পৃথক পৃথক পুলিশ বাহিনী ছিল। বর্তমানে সেখানে মোট পুলিশ ফোর্সের সংখ্যা ৪৩ টি।
বৃটেন প্রত্যেক রাষ্ট্রে একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী রাখার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের পুলিশ বাহিনীই কেন্দ্রীয় কমান্ডে পরিচালিত হয়। অনেক দেশে স্থানীয় সরকারের অধীনে কিছু কিছু পুলিশরূপী সংগঠন থাকলেও সেগুলো শুধু প্রশাসনিক ও মিউনিসিপ্যালিটির আইন সমূহ প্রয়োগ করতে পারে।
বাংলাদেশের উপজেলা পরিষদ আইনে থানা পুলিশকে উপজেলা পরিষদের অধীনে হস্তান্তর করা হয় নি। পুলিশ আইন-১৮৬১ অনুসারে তা করাও যাবে না।
তবে থানা পুলিশকে পরিষদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। থানা পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উপজেরা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে পারবেন। কিন্তু, উপজেলা পরিষদ বা স্থানীয় সরকারের অধীনে পুলিশকে ন্যাস্ত করা সমীচীন হবে না।
পূর্ণ নিবন্ধ
আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৯(১) অনুচ্ছেদের বিধান মতে রাষ্ট্র স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । বর্তমানে দেশের তিন স্তরের স্থানীয় সরকারের মধ্যে দ্বিতীয় স্তর, মানে উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার জোর অনুশীলন চলছে।
পত্রিকার পাতা খুললেই উপজেলা পরিষদ নিয়ে কোন না কোন প্রতিবেদন আমাদের চোখে পড়বেই। তবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টিকে অনেকে একীভূত করে দেখছেন। অতি সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ তাদের অধিক্ষেত্রে পুলিশের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন প্রেরণের অধিকার দাবী করেছেন। এ সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে বেশ লেখালেখিও হয়েছে।
অনেক মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা হল একটি স্থানীয় বিষয়।
তাই, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বিভাগকে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যাস্ত করাই যুক্তিসংগত। এই শ্রেণির চিন্তাবিদদের মতে, উইরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতে পুলিশ স্থানীয় সরকারের অধীন। যুক্তরাষ্ট্রে তো নগর, বন্দর, সিটি, গ্রাম প্রত্যেকেরই নিজস্ব পুলিশ বিভাগ রয়েছে। তারা নির্বাচিত মেয়র বা সিটি কাউন্সিলের অধীন। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে বাংলাদেশের পুলিশ-ব্যবস্থাও সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা চেয়ারম্যানের অধীনে দেওয়া যেতে পারে।
তা ছাড়া গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনেও স্থানীয় সরকারের অধীন পুলিশ রয়েছে। খোদ লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশও লন্ডন মেট্রোপলিন মেয়রের অধীনেই দায়িত্ব পালন করে। তাই, সারা দেশে একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী না রেখে স্থানীয় সরকারের অধীন ছোট ছোট পুলিশ বাহিনী রাখাই ভাল হবে।
আমাদের দেশের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মধ্যে উপজেলা পরিষদের অধীন পুলিশকে ন্যাস্ত করার বিষয়টিই বারংবার আলোচিত হচ্ছে। আর এ কথাও ঠিক যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যে আইনের অধীনেই পরিচালিত হোক না কেন, এর দায়িত্বগুলোর মধ্যে এক বড় দায়িত্ব হল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিশেষ কিছু সামাজিক ও ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি সাধারণভাবে অপরাধ প্রতিরোধ করা।
এই দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন পর্যন্ত সবাইকে দেওয়া হয়েছে। যাহোক, এই নিবন্ধে আমরা উপজেলা পরিষদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব এবং উপজেলা পরিষদের অধীন পুলিশ ন্যাস্ত করার বিষয়টিই আলোচনা করব।
উপজেলা পরিষদ আইন , ১৯৯৮ এর ২৪ (খ) ধারা বলে সরকার কিছু কিছু বিষয় বা বিভাগের কাজ কর্ম পরিচালনা, তদারকি এবং সেই বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারিদের উপজেলা পরিষদের অধীন ন্যাস্ত করতে পারে। কোন কোন বিভাগগুলো উপজেলা পরিষদের অধীন দেওয়া হবে তার একটি তালিকাও আইনের তৃতীয় তফসিলে দেওয়া আছে। বর্তমান তফসিল অনুসারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাপন তথা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গোটা অফিসটিই উপজেলা পরিষদের হাতে ন্যাস্ত করা হয়েছে।
আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুসারে উপজেলা পরিষদের হাতে স্থানান্তরযোগ্য বিভাগগুলোর তালিকা সীমীত নয়। অর্থাৎ তফসিলের বাইরেও সরকার ইচ্ছা করলে কোন বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে।
উপজেলা পরিষদ আইনের ২৮ (১) ধারা অনুসারে পরিষদের সভায় আলোচ্য বা নিষ্পত্তিযোগ্য কোন বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রদান বা পরিষদকে অন্যবিধভাবে সহায়তা করার জন্য উপজেলা বা থানা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে ও তার মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন। অর্থাৎ উপজেলা পরিষদের সভায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ ( উপজেলা পরিষদের কাছে ন্যাস্ত হোক বা না হোক) উপস্থিত থাকবেন। এ ক্ষেত্রে ‘উপজেলা বা থানা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা’ শব্দমালা স্পষ্ট করে যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদের সভায় অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন।
অন্যদিকে, আইনের দ্বিতীয় তফসিলের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপজেলায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ পুলিশ বিভাগের কার্যμম আলোচনা এবং নিয়মিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট উপজেলা চেয়ারম্যানগণ প্রতিবেদন প্রেরণ করতে পারবেন। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ের পুলিশ বিভাগ উপজেলা পরিষদের নিকট হস্তান্ত করা না হলেও আইন ও তার তফসিল বলে উপজেলা পরিষদের কিছু না কিছু কর্তৃত্ব থানার উপর রয়ে গেছে। অধিকন্তু, আইনের ২৪(১) ধারা অনুসারে আইনের তৃতীয় তফসিলের তালিকার বাইরেও অন্যান্য বিভাগগুলোকে সরকার চাইলে উপজেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে কোন নির্বাহী আদেশ জারি করে থানা পুলিশকে সরকার যদি উপজেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করেন, তা উপজেলা পরিষদ আইনের আলোকে আপাত দৃষ্টিতে বেআইনী হবে না।
কিন্তু পুলিশ আইনের ২ ধারা মতে, বাংলাদেশের গোটা পুলিশ-ব্যবস্থা একটি বাহিনী হিসেবে অবিহিত হবে।
৪ ধারা মতে, তা একজন ইন্সপেক্টর জেনারেলের অধীন থাকবে এবং আইনের ৩ ধারার বিধান মতে, সরকার এই আইনের বিধানের বাইরে অন্যকোন ব্যক্তি, অফিসার বা আদালতকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব দিতে পারবে না। এমতাবস্থায়, কোন স্থানীয় সরকারের অধীন পুলিশকে ন্যাস্ত করতে আইনী জটিলতা অবশ্যই রয়েছে।
এবার আসুন ইউরোপ ও আমেরিকার স্থানীয় সরকারের অধীন পুলিশ-ব্যবস্থার স্বরূপ ও এই ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ-ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেখানে ঔপনিবেশিক আমলের স্বনিয়ন্ত্রিত পুলিশ ব্যবস্থা থেকে, নগর পুলিশ হয়ে তারা আজ রাষ্ট্রীয় ও ফেডারেল পুলিশিং ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশিং ব্যবস্থা ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে আজো বিকেন্দ্রীভূত ও খণ্ডিত।
১৯৯৬ সালের হিসেব মতে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০,০০০ পৃথক পৃথক পুলিশ ফোর্স/বিভাগ রয়েছে। ২,৫০০ জনের বেশি জনসংখ্যা অধ্যূসিত প্রায় ৯০% মিউনিসিপ্যালিটির নিজস্ব পুলিশ বিভাগ রয়েছে। পুলিশ বিভাগগুলোর ৮০% এর সার্বক্ষণিক নিয়োজিত পুলিশ অফিসারের সংখ্যা ১০ জনেরও কম। প্রায় ৩,০০০ পুলিশ বাহিনী রয়েছে কাউনিট্রগুলোতে, নগর গুলোতে রয়েছে প্রায় ৩,০০০ এবং বাকী ৩৩,০০০ পুলিশ বাহিনী রয়েছে বরো, নগর, ও গ্রামে ।
এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুলিশ বাহিনীর সীমাবদ্ধতা দূর করতে প্রত্যেক রাষ্ট্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় বা স্টেট পুলিশ।
এর বাইরেও রয়েছে বিষেশ বিশেষ কাজের জন্য সারা যুক্তরাষ্ট্রে অধীক্ষেত্র সম্পন্ন ফেডারেল বুরো অব ইনভেস্টিগেশন, ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন, ফেডারেল বুরো অব প্রিজনস ইত্যাদি।
যুক্ত রাষ্ট্রের খন্ডিত ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুলিশ-ব্যবস্থা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দ্বারা যাচ্ছেতাই ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এই ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য নানা পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছিল। আমেরিকার পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ১৮০০-১৯০০ সাল পর্যন্ত একটি শতাব্দীকে আমেরিকার পুলিশিং ইতিহাসে ভ্রষ্ট নীতির যুগ। কারণ, সেই সময় সিটি মেয়রগণ তাদের স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত পুলিশ বিভাগে তাদের দলের নষ্ট পোলাপাইন দিয়ে ভরিয়ে দিত।
সেই সময় সিভিল সার্ভিসের বেহাল অবস্থা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত শ্লোগান ছিল, টু দি ভিক্টর, গোস দি স্পইলস। মানে, ভ্রষ্টগণ বিজয়ীদের কাছেই প্রশ্রয় পায়। নিজ দলীয় দুষ্ট বালকদের দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া পুলিশ জনগণের সেবা নয়, ক্ষমতাসীনদের তল্পীবাহন ও বিরোধীদের নিপীড়ণেই ব্যস্ত থাকত।
এর পরের ২০ বছর ছিল এই ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিতর্কের যুগ বা প্রগতির যুগ। রাজনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, অপরাধ বিজ্ঞানী, পুলিশ বিজ্ঞানী এবং পুলিশ নেতৃত্ব এই ভ্রষ্টনীতি থেকে উত্তোরণের তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেন এই বিশ বছরে।
বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশে পেশাদারিত্বের যুগ শুরু হয়। রিচার্ড সিলভাস্টাইন, আগস্ট ভলমার, ডব্লিউ উইলসন প্রমূখ পুলিশ নেতৃবৃন্দ পুলিশকে ভ্রষ্টনীতির কবল থেকে উদ্ধার করে পেশাদারিত্ব প্রদানের নেতৃত্ব দেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের স্বকীয় প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুলিশ বিভাগগুলোকে একত্রিত করে প্রতি রাষ্ট্রে একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য আগস্ট ভলমারসহ অন্যান্য পুলিশ নেতৃবৃন্দ আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সফল রাষ্ট্রপতি (১৯০১-১৯০৯) থিওডর রুজভেল্ট রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কমিশনার ছিলেন (১৮৮৫-৮৬) ছিলেন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের খন্ডিত পুলিশ-ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্তত প্রত্যেক রাষ্ট্রে একটি মাত্র পুলিশ বিভাগ রাখার তত্ত্ব প্রচার করতেন।
তার শুপারিশের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্রে পেনসিলভেনিয়ায় ১৯০৫ সালে সমগ্র রাষ্ট্রে অধিক্ষেত্র সম্পন্ন প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। কিন্তু, শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের বিরোধিতার কারণে তারা সফল হয় নাই। তাই বলে যুক্তরাষ্ট্র শুধু স্থানীয় সরকারের অধীন পুলিশ বাহিনী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে নাই। কারণ, এই সব স্থানীয় সরকারের পরিধি এত ছোট এবং সেই অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ পুলিশ বিভাগের আয়তন যা ছোট তাতে করে স্থানীয় নির্বাচিত নেতাগণ পুলিশকে অতি সহজেই নিজের প্রাইভেট বাহিনীতে পরিণত করতে পারে। অধিকন্তু, ১ জন মাত্র সার্বক্ষণিক পুলিশ অফিসার কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক বা খণ্ডকালিন পুলিশ নিয়ে কোন শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাসহ অন্যান্য পুলিশি দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়।
আধুনিক পুলিশ-ব্যবস্থার সূচনালগ্ন থেকেই বৃটেনের পুলিশ ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় বিষয় বলে পরিগণিত হত। প্রত্যেক বরো, কাউন্ট্রি, শহর ও লোকালয়ের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বৃটেনে প্রায় ২০০ বেশি পৃথক পৃথক পুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৪৬ সালের পুলিশ আইন বলে বৃটেনের কাউন্ট্রি বরোগুলোর অধীনে পরিচালিত সকল পুলিশ ফোর্স বিলুপ্ত করা হয়। এর ফলে ইংল্যান্ড ও ওয়েল্স এলাকায় (উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্যতীত) পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১১৭ টি।
মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে ১৯৬৪ সালের পুলিশ আইন অনুসারে এই পুলিশ বাহিনীগুলোর অনেকগুলোকে একত্রিত করে পুলিশ বাহিনীগুলোর মোট সংখ্যা কমিয়ে আনা হয় ৪৯ টিতে। এর পর ১৯৭২ সালের স্থানীয় সরকার আইন অনুসারে এই সংখ্যা সর্বশেষ ৪৩ টিতে নামিয়ে আনা হয়। একই নীতি অনুসরণ করে ১৯৭৫ সালে স্কটল্যান্ডের ১৭ টি পুলিশ বাহিনীর অনেকগুলোকে একীভূত পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা ৮ এ নামিয়ে আনা হয়।
ক্ষুদ্রাকার অবঅবয়ের পুলিশ বাহিনীগুলো বিলুপ্তির ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ৪৩টি পুলিশ বাহিনীকে আঞ্চলিক ভিত্তিতে একীভূত করে ১০ টি অঞ্চলের জন্য ১০ টি পুলিশ বাহিনী রাখার পক্ষে ১৯৮১ সালে মত দিয়েছিলেন বৃহত্তর ম্যানচেষ্টার পুলিশের চিফ কনস্টেবল জেম্স এনডারটন। ২০০৪ সালে পুলিশ বৃটেনের বিভিন্ন বাহিনীর পুলিশ সুপারদের এসোসিয়েশন থেকে সমগ্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে একটি মাত্র বাহিনী রাখার প্রস্তাব করা হয় ।
কিন্তু পুলিশ প্রধানদের সংগঠন এই প্রস্তাবকে অনুমোদন করেনি। পরের বছর রানীর পুলিশ বাহিনীগুলোর পরিদর্শক (হার ম্যাসেজট্রিস ইন্সপেক্টরেট অব কনস্টেবুলারী) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রদত্ত প্রতিবেদনে মতামত প্রকাশ করেন যে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ক্ষদ্র অবঅবের পুলিশ বাহিনীগুলো তাদের দায়িত্বপালনে সক্ষম নয়। তাই, সরকারের উচিত ৪,০০০ বা তার চেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে এমন পুলিশ বিভাগগুলোর স্বকীয়তা রেখে ক্ষুদ্রাকার পুলিশ বিভাগগুলো বিলুপ্ত বা একীভূত করে প্রতিটি অঞ্চল ও ওয়েলসের পুলিশের সাথে একীভূত করা হলে তা এক দিক দিয়ে অর্থসাশ্রয়ী হবে অন্য দিকে বৃহত্তর পরিসর পেয়ে তারা কাঙ্খিত মাত্রা পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারবে।
এই সুপারিস অনুসারে স্বরাষ্ট্র বিভাগ ২০০৭ সালের পহেলা এপ্রিলের মধ্যেই প্রয়োজনীয় একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু নানা প্রতিকুলতার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপাতত এই প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে।
কিন্তু এই একত্রীকরণ প্রক্রিয়া বৃহত্তর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে আপাতত স্থগিত থাকলেও বৃটেনর অংগ রাজ্য স্কটল্যান্ডে তা অব্যহত রয়েছে। কেননা, স্কটিশ সরকারের হিসেব মতে ক্ষুদ্রাকার হলেও প্রত্যেক পুলিশ বিভাগ যে অর্থ ব্যয় করে তার ২৫% বাজেট ব্যয় হয় হেডকোয়ার্টার্স পরিচালনা করতে। তাই, ২০১১ সালের জানুয়ারী মাসে স্কটিস পার্লামেন্টে উত্থাপিত একটি বিল অনুযায়ী ২০১৩ সালের প্রথম দিকে স্কটল্যান্ড পুলিশ সার্ভিস নামে একটি একীভূত পুলিশ বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তবে পুলিশ-ব্যবস্থার ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে সারা বিশ্বে কেন্দ্রীভূত বা যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল ব্যবস্থা হলে প্রতিরাষ্ট্রে একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী রাখাই বেশি যুক্তিসংগত ও অর্থসাশ্রয়ী।
ইইরোপের ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী; এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান; অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি প্রায় সব দেশেই পুলিশ ব্যবস্থা হয় এক কেন্দ্রিক, নয়তো রাষ্ট্র ভিত্তিক। স্থানীয় সরকারের অধীনে কিছু কিছু দেশে মিউনিসিপ্যাল বা নগর পুলিশ রয়েছে। কিন্তু, এরা শুধুমাত্র মিউনিসিপ্যালিটির পক্ষে প্রশাসনিক, স্যানিটেশন ইত্যাদি সামান্য কিছু আইনের সীমীত প্রয়োগ করে থাকে। একটি পুলিশ বিভাগের সাধারণ পুলিশি ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাদের নেই।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর নয়।
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যহত থাকলে আমাদের সকল স্তরের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একদিন পুরোপুরি কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। এমতাবস্থা, সকল স্তরের জনপ্রতিনিধিদের পুলিশ-ব্যবস্থায় একটা সুপারিসমূলক অংশগ্রহণের আইনী ব্যবস্থা থাকা অস্বাভাবিক কিছু হবে না। এই বিষয়ে আমরা অতি সম্প্রতি ভারতের কেরালা অংগ রাজ্যের পুলিশ আইনটি পর্যালোচনা করতে পারি।
কেরালা পুলিশ আইনের-২০১১ এর ১১১ নং ধারার বিধান বলে স্থানীয় পঞ্চায়েতের (বাংলাদেশের ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদের মতো) চেয়ারম্যান, মিউনিসিপ্যালিটি, সিটি/পৌর কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান/মেয়রগণ এবং বিধানসভা ও পার্লামেন্টের সদস্যগণ যে কোন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের অভিযোগ, তা নিজেদের পর্যবেক্ষণে হোক বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক তাদের নজরে আনা হোক, আইন বলে গঠিত ‘অভিযোগ কর্তৃপক্ষের’ কাছে প্রেরণ করতে পারবেন। অভিযোগ কর্তৃপক্ষ তা অবশ্যই অনুসন্ধান করবেন এবং ফলাফল সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিকে জানাবেন।
এই আইনে পুলিশকে কোন স্থানীয় পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। কিন্তু, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের ব্যবস্থা এবং তা আমলে নেওয়া বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আইন-শৃঙ্খলা তথা পুলিশি কর্মকাণ্ডের একটি মূল্যায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে।
উপসংহারে বলব, একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো পূর্ণ বিকশিত গণতান্ত্রিক দেশসমূহের খণ্ডিত পুলিশ-ব্যবস্থা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও অনুশীলনরত গণতান্ত্রিক দেশের প্রচলিত কেন্দ্রীয় পুলিশ-ব্যবস্থাকে নতুন করে খণ্ডবিখণ্ড করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, কার্যকরী তদন্ত ও অন্যান্য পুলিশি সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকারের অধীন পুলিশ-ব্যবস্থা যদি এতই কার্যকরী হত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যবস্থা নিয়ে এত বিতর্ক উঠত না। যে বৃটেনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সারা বিশ্বে অনুসরণীয় সেই বৃটেনের পুলিশ বাহিনীগুলোর ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে খণ্ডিত পুলিশ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম নয়।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পুলিশের সেবার সিংহ ভাগই সামাজিক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও পুলিশের দায়িত্বের বড় অংশ মূলত সেবাদান। তাই পুলিশ তার কর্তব্য পালনে স্থানীয় কমিউনিটি বা সাধারণ মানুষের সাথে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় কমিউনিটি পুলিশিং এর দর্শন গ্রহণ করেছে। এই দর্শন অনুসারে শুধু স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথেই নয়, পুলিশ আপামর জনসাধারণের মতামত নিয়েই তাদের সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই তাদের দায়িত্ব পালন করবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগণ, তাই, পুলিশ-ব্যবস্থা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন থাকবেন না।
অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশি কাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে উপজেলা পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকারগুলো পুলিশের পরামর্শক, অংশীদার ও পুলিশি কর্মকাণ্ডের নীতি নির্ধারণে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু, তাই বলে পুলিশের কমাণ্ড-কন্ট্রোল স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেবার কোন কারণ নেই।
রচনা সূত্রঃ
১. Changing Policing Theories for 21st Century Societies by Charles Edwards, p-37;
২. Click This Link
৩. উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১১
৪. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক (http://blog.bdnews24.com) {C/P}
আমার পোষ্টটি আপনাদের ভালো লাগলে ফেসবুকের এই পেজে একটি লাইক দিবেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।