বদলে গেছি
ভনিতা নয়, ভূমিকা
স্থানীয় সাংবাদিকতার বর্তমান হাল হকিকত প্রসঙ্গে নিজ খরচায়, স্বতত্ত্বাবধানে একটি গবেষণার কাজে হাত দিয়েছি সম্প্রতি। এখনও প্রশ্নপত্র উন্নয়ন পর্যায়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রশ্নপত্রের মাঠ মূল্যায়নের জন্য টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের অফিসে যাই। ঐ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অত্যন্ত সোজা সাপ্টা মানুষ। যা বলেন মুখের ওপর সোজাসুজি বলে দেন।
ভদ্রলোকের এ চরিত্র দেখে খুবই ভাল লাগল।
তার সোজাসুজি কথা বলার একটা নমুনা আমি এখানে পেশ করতে চাই। আমি তাকে বলেছিলাম ব্যবসা হিসেবে স্থানীয় সংবাদপত্রের অবস্থা অবস্থান দেখাও আমার গবেষণার একটি উদ্দেশ্য। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছেন যারা স্থানীয় পত্রিকা বের করে তারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে নয় বরং আদর্শগত কারণেই পত্রিকা বের করে।
এ কথা আলবৎ সত্য।
স্থানীয় সংবাদপত্রের লোকবল আয় ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব পাতি আমার গবেষণা কর্ম শেষ হলে সবার জন্য হাজির করব। বোধ হয় সেখানেই দেখা যাবে ব্যবসা হিসেবে এটা কোন ভাবেই লাভজনক নয়। অধিকাংশ সাংবাদিক এখানে আদর্শিক কারণেই আসে, হয়তো বা আদর্শিক কারণে আসে না। কোনটাই এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রশ্নপত্রের বাইরেও অনেক কথা হল।
অবতারণা তিনি নিজেই করলেন।
সোনার কাঠি রূপার কাঠি-- মূল আলাপের জাগরণ
কিন্তু এবার আসল আলাপে আসি যার জন্য পাঠককে এতণ ধরে নানা ভূমিকা শোনালাম। আমাদের এ সম্পাদক স্থানীয় ধনিকদের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। সেটা স্বাভাবিকও বটে। যারা স্থানীয় সংবাদপত্র সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন পয়সার অভাবে এ পত্রিকাগুলোর মালিককে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকতে হয় কালকের পত্রিকাটা আর বের করতে পারবেন কি না (মালিক নিজেই আবার সম্পাদকও বটে, দুই একটি ব্যতিক্রমও আছে)।
এ রাজধানী কেন্দ্রিকতার যুগে স্থানীয় যে দুই-একটি উৎপাদন বা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান থাকে তারা স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাকে অপচয়ী ডুপ্লিকেশন মনে করে। অর্থাৎ জাতীয় দৈনিকের পাঠক যারা তারাই আবার স্থানীয় পত্রিকারও পাঠক। কিন্তু জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিলে তা বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে (এ নিয়ে ভিন্ন বিতর্কও আছে কিন্তু তা এখানে আলোচনার অবকাশ নেই)। তাই দুইটি মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেওয়াকে তারা অপচয়ই বিবেচনা করে। সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে পত্রিকাকে আগে জাতীয় মিডিয়া তালিকাভুক্ত হতে হয়।
মিডিয়া তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও স্থানীয় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিলে থাকে চরম বৈষম্য। আবার এসব বিজ্ঞাপনের বিল পাওয়াও এক দীর্ঘ সূত্রিতা। ততদিনে হয় তো পত্রিকাটাই বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে স্থানীয় সংবাদপত্রের অর্থনীতি টিকে থাকবে কীভাবে?
স্থানীয় সংবাদপত্রে কোচিং-কিনিক রাজনীতি
আমাদের এই সম্পাদক ভদ্রলোক অনেক অভিযোগ আক্ষেপ করার পর বললেন, ‘বরং স্থানীয় কোচিং সেন্টারগুলো অনেক ভাল। ’ এখানে আমি যোগ করতে চাই স্থানীয় ক্লিনিকগুলোও কিন্তু এ বিচারে ভাল।
যা হোক সম্পাদক ভদ্রলোক কোচিং সেন্টারগুলোকে ভাল বললেন তার কারণ হচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলোর দেওয়া বিজ্ঞাপন বাবদ আয় তার মোট বিজ্ঞাপন বাবদ আয়ের ৬০ শতাংশ। টাঙ্গাইলের স্থানীয় দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিকের পাতায় কোচিং সেন্টার আর ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। তারা এত বিজ্ঞাপন দেয় কেন?
যারা নিয়মিত জাতীয় সংবাদপত্র পাঠ করেন তারা খেয়াল করে থাকবেন টাঙ্গাইলের সৃষ্টি একাডেমিক স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন আছে, শাহীন, শহীদ ইত্যাদি কোচিং সেন্টারেরও বিজ্ঞাপন আছে। তাহলে তারা অপচয়ী ডুপ্লিকেশনের দোহাই দিয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে না কেন? স্থানীয় অভিভাবকের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার আশায়? বোধ হয় এই একটা যুক্তিতেই তারা বিজ্ঞাপন দেন না। আসলে যাতে আমাদের সম্পাদকরা বলেন ‘বরং স্থানীয় কোচিং সেন্টারগুলো অনেক ভাল’।
এ জন্যই তারা এ সব বিজ্ঞাপন দেন।
একটা উদাহরণ
টাঙ্গাইলের সরকারী বিন্দুবাসিনী বালক ও সরকারী বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এক সময় ঢাকা বোর্ডে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। এখানে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হয়। দুই একজন শিক্ষক ছাড়া ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা কোন টিউশনি করতেন না, কোচিং সেন্টারে যাওয়া তো দূরের কথা। তখন একজন অভিভাবক তার সন্তানকে এ স্কুল গুলোতে ভর্তি করতে পারলে নাম মাত্র মূল্যে নিজের সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন ভেবে আশ্বস্ত হতেন।
কিন্তু টাঙ্গাইলে উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রিক কোচিং সেন্টার স্থাপন শুরু হয় ১৯৯৫ সালের দিকে। শাহীন কোচিং সেন্টার এর পথ প্রদর্শক। এরপর সৃষ্টি কোচিং যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৭ সালের এসএসসি পরীক্ষাতে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে একটি ছেলে এস এস সি পরীক্ষায় বোর্ডে প্লেস করে। সে সৃষ্টি কোচিং এও পড়ত।
কিন্তু খেয়াল করার বিষয় সর্বত্র যে প্রচার প্রচারণা হয় তাতে বলা হয় এ ছেলে সৃষ্টি কোচিং এর ছাত্র। (টাঙ্গাইলে এই প্রথমবারের মত কোন ছাত্র স্কুলের নয় বরং কোচিং সেন্টারের পরিচয়ে পরিচিত হল)। সে যে বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তা ধামাচাপা পড়ে যায়। এ কোচিং সেন্টারগুলোর উচ্চ বেতনের লোভে বিন্দুবাসিনী বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা এখানে পাঠদান করতে শুরু করেন। স্কুলে তারা পাঠদান এক অর্থে একেবারে নিঃশেষ করে দেন।
পরবর্তীতে স্কুল গুলোর কিছু কড়াকড়িতে এ শিক্ষকরা এ সব কোচিং সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ানো বাদ দেন। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে তারা থেকে যান এ সবের উপদেষ্টা হিসেবে। উপদেষ্টার কাজ কী? স্কুলের শিক্ষার্থীদের এসব কোচিং এ আসতে উদ্বুদ্ধ করা। এজন্য তাদের ক্লাস ভিত্তিক অলিখিত টার্গেটও নির্ধারণ করা থাকে। পরে কোচিং সেন্টারগুলো কলেজ থেকে প্রভাষক ভাড়া শুরু করে।
এক পর্যায়ে কোচিংওয়ালারা কলেজও প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। যেমন শাহীন কলেজ, সৃষ্টি কলেজ ইত্যাদি। সরকারী স্কুলের শিক্ষকরা যখন কোচিং সেন্টারে যুক্ত হওয়ার কড়াকড়িতে পড়েন তখন এ কোচিং গুলো বেসরকারি স্কুল থেকেও শিক্ষক ভাড়া করা শুরু করেন। বারোটা বাজতে শুরু করে বেসরকারি বিদ্যালয়েরও। এমন একটা বিদ্যালয় হল টাঙ্গাইল শহরের বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়।
টাঙ্গাইলের নিম্ন আয়ের মানুষের খবর
দাপ্তরিক কাজে বিভিন্ন সময় আমাকে নিম্ন আয়ের মানুষদের সাক্ষাৎকার নিতে হয়। এসব সাক্ষাৎকারে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রসঙ্গ হামেশাই আসে। আমি আতঙ্কের সঙ্গে ল করেছি এসব সাক্ষাৎকারে অভিভাবকরা যখন তাদের সন্তানের শিক্ষা প্রসঙ্গে কথা বলেন তখন তারা প্রায়ই শিক্ষা ব্যয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘লেখা পড়ার এখন যে খরচ আমরা হয়তো কুলাতে পারব না, কোচিং সেন্টারের খরচ, প্রাইভেট টিউটর ইত্যাদি ইত্যাদি নানা খরচ। ’ অর্থাৎ টাঙ্গাইলে এখন শিক্ষাখাতের খরচের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট টিউটর। এ কারণে এ অঞ্চলে দরিদ্রদের মধ্যে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
স্থানীয় সংবাদপত্রের আদর্শ ফর্দফাই
আমি সম্পাদক সাহেব কে জিজ্ঞেস করলাম এই যখন অবস্থা তখন তো দেশের স্বার্থে আমাদের উচিৎ কোচিং সেন্টারগুলোর বিরোধতা করা। তখন তিনি যুক্তি দেখালেন, আমাদের টাঙ্গাইলে প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী একটি ভাল স্কুলে ভর্তির উপযোগী হয়ে উঠে সে পরিমাণ ধারণ ক্ষমতা এ স্কুলগুলোর নেই। প্রাইভেটাইজেশনে আমাদেরকে যেতেই হবে। হ্যা কথা সত্যি (?) আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছি, কেন আমরা তবে স্কুল গুলোর উন্নয়নের জন্য, ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, সরকারকে নতুন স্কুল স্থাপনের জন্য চাপ দেব না? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই অবশ্য তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। কারণ আদর্শ এখানে কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
আসলে এটা তার দোষও না। এটা পরিস্থিতির চাপ। সে পরিস্থিতিটাকে মোকাবেলার জন্য খোদ পরিস্থিতিকেই বুঝে নিতে হবে। তুলে ধরতে হবে পরিস্থিতির চেহারা স্থানীয় সংবাদপত্রেও।
ক্লিনিকের ভাল মানুষী
এর আগে আমি উল্লেখ করেছি স্থানীয় ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবসার কথা।
এ ক্লিনিক ব্যবসা যে অপূরণীয় ক্ষতি করছে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা আর স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তাকে তা নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই। এ নিয়ে বহু কাগজে বিভিন্ন সময় অনেক লেখা লেখি হয়েছে। এ সব বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বহুবার। টাঙ্গাইলের সেবা ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যুর খবর ছেপেছে স্থানীয় সাপ্তাহিক প্রযুক্তি। [প্রযুক্তি সেবা কিনিকের বিজ্ঞাপন পেত না।
সেবা কিনিকের এ খবর অন্য কোন স্থানীয় সংবাদপত্রে আসে নি। ] ক্লিনিকগুলোর ডাক্তারদের কোন সুনির্দিষ্ট দর্শনী (ভিজিট) নেই। যে যার খুশিমত ভিজিট আদায় করে। সর্বনিম্ন দর্শনীয়ও আকাশ ছোঁয়া। টাঙ্গাইলের এ ক্লিনিকগুলোতে আপনি ডাক্তার দেখালে যে ভিজিট দেবেন তার রশিদে আপনার দেয়া ভ্যাটের কোন নাম নিশানাও থাকবে না।
রোগী পাঠানো বাবদ আবার দালালরা একটা নির্দিষ্ট অংক পায় যা উশুল করার জন্য ক্লিনিক- হাসপাতাল মালিকরা ডাক্তারদেরকে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট লিখতে বাধ্য করেন। এ টেস্ট গুলো আবার হয় কিনিক মালিকেরই নিজস্ব ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে। এ টেস্টের ক্ষেত্রেও কোন সুনির্দিষ্ট দর নেই। একেক ডায়াগনেস্টিকে একই টেস্টের একেক ধরনের বিল।
ক্লিনিক-কোচিং মহান নয়, এগোতে হবে সাংবাদিককেই
আলাপ করলে তো অনেকই করা যায়।
এই যে এত দুর্নীতি, শোষণ এর বিরুদ্ধে কথা বলার আদর্শের কথাই বলেছিলেন আমাদের সম্পাদক। কিন্তু এ সব বিষয়ে একটি খবরও পাওয়া যায় না স্থানীয় সংবাদপত্রে। কেন? এতক্ষণে পাঠকের হয়তো বুঝতে বাকি নেই যে এসব আলাপ যাতে তুলতে না পারে এ জন্যই স্থানীয় সংবাদপত্রে কোচিং-ক্লিনিকের এত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। এ কারণেই কোচিং-ক্লিনিক ওলারা এত ভাল মানুষ, এত মহান হয়ে অপচয়ী ডুপ্লিকেশন করেন। কিন্তু তরুণ সবসময়ই আশাবাদী।
আমাদের বর্তমান সাংবাদিকতায় জড়িত তরুণদের কাছে তাই প্রত্যাশা এ সব অন্যায় নিয়ে লিখেন, দেখবেন বিজ্ঞাপনের টাকার অভাবে আপনার পত্রিকা বন্ধ হবে না। স্থানীয় জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে আপনার পত্রিকা চালানোর টাকা চাঁদা হিসেবে দিবে। আমারা টাঙ্গইলে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার কিন্তু চাঁদার টাকাতেই চালাই।
[আত্মপক্ষের কাঠগড়ায়: এ লেখাটি নিতান্তই খসড়া। আরও অনেক বেশি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এ লেখার উন্নয়ন করব বলে বিশ্বাস রাখি।
]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।