আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে ১২: অব্যাহতি
স্থায়ী জামিন পাবার একমাস পর পাওয়া গেল ময়না তদন্ত রিপোর্ট; আর সেটা পেতে আমাকে ডাক্তার সাহেবের কাছে ফোনে ধর্ণা দিতে হয়েছে অন্তত পনেরবার। তাঁকে এক লক্ষ টাকা পুরিয়ে দেবার পর থেকে আমার সাথে আচরণ তিনি ভালই করছেন; তবে ভিসেরা রিপোর্ট পেতে নাকি সময় লাগে। একসময় জানালেন ভিসেরা রিপোর্ট এসেছে; আমি যেন সামনের রবিবার থানা থেকে কাউকে পাঠানোর ব্যবস্থা করি ওটা আনতে। আমি নিজে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা ফটোকপি নিয়ে আসলাম; মূল কপিটা তিনি পুলিশকে দেবেন। রিপোর্টটা বাসায় এনে পড়লাম; ডাক্তার সাহেব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন সবকিছু (মেডিক্যালের ভাষা সবটা আমি বুঝলামনা; মৌমিতা বুঝিয়ে দিলো), উপসংহারে লেখা আছে “It is a case of natural death”.
এরপর আমার থানায় দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো।
প্রথমে ফোনে এস.আই. সাহেবকে বলার চেষ্টা করলাম; কিন্তু এরা অতি সাবধানী, ফোনে শুধু বলেন দেখা করতে, টাকা সংক্রান্ত কোন কথা এরা ফোনে বলেননা; আমি জানি দেখা মানেই টাকা…। যাহোক, থানায় গিয়ে এস.আই. সাহেবকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বললাম, ভাই, এবার কাউকে মেডিক্যালে পাঠান, রিপোর্ট রেডী থাকবে।
শুনে তিনি এক হাবিলদারকে দেখিয়ে বললেন, ওকে যাওয়া-আসার খরচ দেন, ও গিয়ে নিয়ে আসবে।
কত দেব? আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম (আমি জানি এই লোক পুলিশ ভ্যানে যাবে, একে আবার কী খরচ দেব?)
দেন পাঁচশ, ঠোঁট উল্টে বললেন এস.আই. সাহেব।
এরপর কেটে গেল আরো কিছুদিন; থানায় ফোন করলে শুনি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট দেয়নি; ডাক্তার সাহেবকে ফোন করলে বলেন, রিপোর্ট তৈরী আছে, থানা থেকে কেউ যায়নি।
আমার অস্থিরতা দেখে ডাক্তার সাহেব প্রস্তাব করলেন, তিনি তাঁর লোক দিয়ে রিপোর্ট থানায় পৌঁছে দেবেন যদি আমি তাঁর লোকের যাতায়াত খরচ দিই। কত দিতে হবে জানতে চাইলে ডাক্তার সাহেব সেই পাঁচশ টাকার অংকটা উচ্চারণ করলেন অবলীলায়! আমি রাজী হলাম; মৌমিতা আমাকে ঠেকালো; অনেক হয়েছে, আর নয়।
সামনে ঈদ; আমি গ্রামে যেতে চাই ঈদ করতে; কিন্তু থানা থেকে অব্যাহতি না পেলে ঈদের আনন্দ কোথায়? এস.আই. সাহেবকে সে’কথা বলে অনুরোধ করলাম বিষয়টা দ্রুত সুরাহা করতে। ঈদের সালামীর একটা ইঙ্গিত দিলাম তাঁকে (আমি মনেহয় ‘শিল্প’টা রপ্ত করে ফেলেছি); এবার কাজ হলো। তিনি বললেন, তিনি আমাকে জানাবেন কবে থানায় যেতে হবে।
এর দু’দিন পরই পেলাম তাঁর ফোন, মিষ্টি গলায় জানালেন, রিপোর্ট তিনি পেয়েছেন, আমি যেন একটু থানায় যাই। এই ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। অফিস থেকে সে’রাতে সোজা থানায় গেলাম। আমি এস.আই. সাহেবকে বললাম, ভাই এবার আমায় মুক্তি দিন; বিনা অপরাধে অনেক শাস্তি ভোগ করলাম।
এস.আই. সাহেব বললেন, কত আনছেন?
আমি রীতিমতো অপ্রস্তুত; বললাম, পকেটে তেমন কিছু নেই আজ।
তাঁর হাসিমুখ মুহূর্তেই গম্ভীর; বললেন, ওসি সাহেবকে কিছু দিতে হবে; তা না হলে আদালতের কাছে আরো সময় চাইব তদন্ত করার জন্যে; এখন আপনি বলেন কী করব।
আমি বললাম, ভাই, অন্যায় না করেও যে পরিমাণ খরচ করছি…; আর কত দিতে হবে, বলুন?
হাজার বিশেক নিয়ে আসেন; আমিতো সব খাবোনা, অনেককে ভাগ দিতে হবে। টাকা নিয়ে আসেন, কোর্টে সুন্দর করে চিঠি লিখে দেব, মামলা খারিজ হয়ে যাবে; ঠিক আছে?
আমি মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বিদায় নিলাম। থানা থেকে বেরিয়ে মনে মনে শাপশাপান্ত করলাম এস.আই.কে; কত বড় অর্থপিশাচ! এর কি পরকালের ভয় নেই? একবার এর মনে হয়না এঁর স্ত্রী-পুত্র যেকোন দিন যেকোন বিপদে পড়তে পারে? আমি বুঝতে পারছি এই বিশ হাজার টাকা যদি সেই মৃত্যুর রাতে একে দেবার প্রস্তাব করতাম, সেই রাতেই সব সুরাহা হয়ে যেত। হায়, বাংলাদেশ!
বাসায় ফিরে মৌমিতাকে বললাম।
শুনে আঁতকে উঠলো সে। আমরা দু’জনেই সকল প্রকার দুর্নীতির ঘোর বিরোধী; অথচ আজ পরিস্থিতি আমাদেরকে দিয়ে দুনীতি করাচ্ছে।
পরদিন এ.টি.এম. বুথ থেকে টাকা তুলে থানায় গেলাম। বেশ খাতির করে চা খাওয়ালেন এস.আই. সাহেব। আমাকে দেখালেন আদালতকে লেখা তাঁর চিঠি, আমাদেরকে এই মামলায় অব্যাহতি দেবার আবেদন করে তিনি চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন আগামীকাল।
টাকার বান্ডিলটা তাঁর খোলা ড্রয়ারে রাখলাম, তিনি হাসলেন; যেন এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা; বরং টাকা ছাড়া কাজটা করলে সমাজে তার মান-সম্মান থাকতোনা। আজ নানা ধরনের খোশগল্পে মুখর তিনি। কবে কোন্ লোককে কীভাবে ফাঁসিয়েছেন, পুলিশের ডিজির অনুরোধেও কোন্ আসামীকে ছাড় দেননি, আবার নিশ্চিত খুনের আসামী জেনেও কীভাবে একজনকে বাঁচিয়েছেন তিনি তার বিষদ বর্ণনা; আসামীকে মৃত দেখিয়ে কী চমৎকারভাবে মামলা খারিজ করিয়েছিলেন ইত্যাদি গল্প বেশ রসিয়ে রসিয়ে বিস্তারিতভাবে করতে লাগলেন আমার সাথে। আমার সেসব শোনবার ধৈর্য কোথায়? আমি বললাম, এই চিঠিটার একটা ফটোকপি পেতে পারি?
তিনি এক পিয়নকে ডাকলেন। আমাকে বললেন, একে একশ টাকা দেন, কপি করে নিয়ে আসবে।
কোন ব্যাপারনা এমন একটা ভাব করে আমি টাকাটা বের করে দিলাম; এক পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে একশ টাকা! এটা কোন্ দেশ?
থানা থেকে বেরিয়ে আরও একবার বুক ভরে শ্বাস নিলাম; খুব হালকা লাগছে। মা-কে ফোন করে জানালাম সব; মা খুব খুশী হলেন। শাহেদ ভাইয়া ও খালুকে এস.এম.এস. করে জানালাম; মাহফুজ ভাইকেও ফোন করে ধন্যবাদ দিলাম; তিনি যা করেছেন তা আপন ভাইও করেনা ভাইয়ের জন্যে। আমার শ্বশুর নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছিলেন এই বিষয়ে; তাঁকে জানাতেই তিনি বললেন আমি যেন সপ্তাহ খানেক পর উকিল সাহেবকে বলি, কোর্ট থেকে একটা অব্যাহতিপত্র নিতে, যাতে পরে আর কোন ঝামেলা না হয়।
সপ্তাহখানেক পর উকিল সাহেবকে বিষয়টা জানালাম।
তিনি বললেন, হয়ে যাবে; আর কিছু টাকা লাগবে। শুনে আমি রাজী হলাম। এরপর সপ্তাহ যায়, মাস যায়, উকিল সাহেবের কোন খোঁজ পাইনা; ফোন করলে ধরেন না, কল ব্যাকও করেননা। যদিওবা এক দু’বার তাঁকে ধরতে পেরেছি, তিনি বলেন, এখনো কাগজটা পাইনি, সামনের সপ্তাহে হয়ে যাবে।
দু’মাস লাগলো সেই কাগজটা আমার হাতে পেতে; যাহোক, তবুতো পেলাম।
একটা স্ট্যাস্প পেপারে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের স্বাক্ষরিত ও সীলমোহর দেওয়া সনদ, যে আমাকে ও মৌমিতাকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এইটুকু পেতে এত সময় আর খরচ! আমার শ্বশুর বলেছিলেন এটা নাকি ২০০ টাকার কাজ; উকিল সাহেব নিলেন এক হাজার।
একদিন অফিসে যাবার পথে ট্রাফিক সিগন্যালে রাসেলের সাথে দেখা; পরনে সেদিনের সেই সবুজ টি-শার্ট (ছেলেটার বোধহয় ভাল জামা এই একটাই)। ওকে ডেকে কিছুক্ষণ গল্প করলাম; ও জামিনে মুক্তি পেয়েছে আমার আট দিন পর। এই দেড় সপ্তাহের অর্ধাহার আর মানসিক চাপে ওর গোল মুখটা কেমন লম্বা হয়ে গেছে দেখে চমকে উঠলাম। রাসেলের বাবা জমি বিক্রি করে চুরিযাওয়া রডের দাম পরিশোধ করে ছেলেকে মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাইয়ে দিয়েছেন; সেই দারোয়ান ছেলেটা ফিরে গেছে গ্রামে।
আমি রাসেলকে আমার একটা বিজনেস কার্ড দিয়ে বললাম, কোন প্রয়োজনে যেন যোগাযোগ করে আমার সাথে। শুষ্ক হাসি হেসে রাসেল চলে গেল তার গন্তব্যে; সে এখন অন্য একটা ফার্মে কাজ করে।
কাকতালীয়ভাবে সেদিনই আমার বন্ধু রাসেল অস্ট্রেলিয়া থেকে দুপুরে ফোন করল। ও অবশ্য প্রায়ই ফোন করে খবরাখবর নেয়; আমার দুর্ভোগের আদ্যোপান্ত জানে রাসেল। ও প্রায়ই বলে, বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য নেই, অস্ট্রেলিয়ায় চলে আয়; এথানে প্রচুর চাকরীর সুযোগ।
জবাবে আমি ‘দেখা যাক’ বলে বিষয়টা পরে ভুলে যাই।
আজ ও একেবারে সুযোগের খবর নিয়ে ফোন করেছে; যে জব এজেন্টের মাধ্যমে ও চাকরী পেয়েছে সে এখন কিছু প্রকৌশলী চাইছে একটা বড় ডকইয়ার্ডের প্রজেক্টের জন্যে; চার বছরের কন্ট্রাক্ট; চাকরী নিশ্চিত হলে সেই এজেন্ট ভিসার ব্যবস্থা করে দেবে; দুই বছর পর স্থায়ী বাসিন্দা হবার সুযোগ পাওয়া যাবে। রাসেল আজ ফোন করেছে আমি আগ্রহী কিনা জানতে; তাহলে ও এজেন্টকে আমার জন্যে অনুরোধ করবে।
বছর দুয়েক ধরে রাসেল অস্ট্রেলিয়ায় আছে; এবং আমাকেও উৎসাহ দেয় ওখানে চলে যেতে। এতকাল ওর এ’জাতীয় কথায় আমি নেতিবাচক জবাব দিতাম।
এবার তা পারলামনা; বরং ওর পরামর্শমতো আমি IELTS এর প্রস্তুতি শুরু করলাম; দুইসপ্তাহ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলাম; তার দু’সপ্তাহ পর আশানুরূপ ফল পেলাম; এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠালাম রাসেলকে।
তারপর শুরু হলো অপেক্ষার পালা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।