আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলখানার জীবনযাপন: ধারাবাহিক উপন্যাস "লোহার খাঁচায়" (পর্ব-৯)

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব-৯: মণিহার-৫ যমুনায় ফিরে এসে দেখি সবাইকে আবার ‘ফাইলে’ বসানো হয়েছে। এবং সেখান থেকে ডেকে ডেকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হচ্ছে। আমি আর রাসেল একসাথে বসেছিলাম; এবার আলাদা হয়ে গেলাম। ওকে যেতে হল ‘পদ্মা’ ভবনে; আমাকে অন্য গ্রুপে এক কয়েদীর জিম্মায় দিয়ে যেতে বলা হলো ‘মণিহার’ ভবনে। মণিহার ভবনটি পদ্মার মতোই পাঁচতলা বড় লাল একটি ভবন।

পদ্মা আর মণিহার-এর মাঝখানে একটা বড় উঠান; সেই উঠানের এক পাশে বড় বড় দুটি হাউজ, তার এক পাশে রান্নাঘর। মণিহারে আমাকে দেওয়া হলো একটি ‘পরিবার’-এর সাথে। এখানে প্রত্যেকটি ব্লকের সব কয়েদীদেরকে কয়েকটি ছোট ছোট দলে ভাগ করা হয়, যার নেতৃত্বে থাকে একজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী; এবং এই পরিবারের সদস্যদেরকে নানা ধরণের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। আমি যে পরিবারে যোগ দিলাম, তার সদস্যসংখ্যা ১৪; এদের মধ্যে ৩ জনের সাজা ঘোষণা হয়েছে, বাকীদের মামলা চলছে দীর্ঘদিন ধরে; প্রায় সবাই এসেছে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। তপন-স্বপন নামে দুই সহোদর ভাই আছে এই পরিবারে; ওদেরকে ধরেছে র‌্যাব; ওদের কাহিনীটা বেশ নাটকীয়।

বিদেশে চাকরী দেবার নাম করে যে আদমব্যাপরী ওদের কাছ থেকে ২ লাখ করে টাকা নিযে দীর্ঘদিন ধরে ঘোরাচ্ছিল, ওরা তাকে ধরে নিয়ে এলো ওদের বাসায়; মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করল ওদের সেই টাকা; টাকা দেবার আশ্বাস দিয়ে সেই লোকের আত্মীয়রা এলো তাকে ছাড়িয়ে নিতে; সাথে নিয়ে এলো র‌্যাব; ধরিয়ে দিল অপহরণের মামলায়…। বেচারা ভাই দুটির টাকাও গেলো, জেলও হলো! আমার সাথে একজন খুনের আসামীর বেশ আলাপ জমল; সুমন নামের এই ৩৫ বছরের যুবক ভাড়াটে খুনী ছিলেন। কেন খুন করেন, এ জাতীয় প্রশ্ন করার সাহস আমার হয়নি, তবে আমার দৃষ্টি দেখে তিনি নিজেই বললেন, বাপ-মা কোনদিন আদর-যত্ন করেনাই; অনাদরে অবহেলায় বড় হইছি; টাকার জন্যে করিনাই এমন কোন কাজ নাই…। সুমন ভাই ডাকে সবাই তাঁকে; বেশ রাজা রাজা ভাব তার; সাগরেদরা তাঁকে খাবার-দাবার এনে দেয়; গতকালকের একটা বাসি খবরের কাগজ দেখলাম তাঁর বিছানায়; সেটা দেখিয়ে তিনি বললেন, আপনার খবরটা এখানে পড়লাম…। আমি হতভম্ব! কাগজটা নিয়ে পড়লাম; না, বানিয়ে কিছু লেখেনি এরা।

বিকেলে এক কয়েদী আমাকে ডেকে নিয়ে গেল যমুনার পেছনের এক ছাউনীতে; মা-মৌমিতার পাঠানো ব্রেড, জুস, বিস্কিট, কেক আর আমার লুঙ্গি, তোয়ালে, জামা, জায়নামাজ পেলাম সেখানে। সন্ধ্যার একটু আগে এলো রাতের খাবার। আজ নাকি ইমপ্রুভড ডায়েট: সাদা ভাত আর গরুর মাংস। আমাদের পরিবারের যিনি প্রধান, তার নাম আকরাম; বয়স প্রায় ৪০; অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। আকরাম ভাই ৫ টুকরা মাংসকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ১৫ টুকরা করলেন।

নিজে ২ টুকরা নিয়ে বাকিটা আমাদের ১৩জনের প্লেটে রাখলেন; ঝোল ছিল পর্যাপ্ত, সাথে পাতলা ডাল। সন্ধ্যা ৬টায় মূল গেইট বন্ধ হলো। হাবিলদার এসে সবাইকে ‘ফাইল’ করিয়ে একদফা গুনে বিদায নিলো। গোনা শেষ হতেই সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিলো এই ভরা সন্ধ্যায়। আমি খেলাম সামান্য; নষ্ট করলাম অনেক।

ভরসা হিসেবে রইলো বিকেলে মায়ের পাঠানো আমার সেই শুকনো খাবারগুলো আর জুস; ওগুলো অবশ্য আকরাম ভাই আমার কাছ থেকে নিয়ে নিজের ব্যাগে রেখে দিয়েছেন; এখানকার নিয়ম হলো যখন খাওয়া হবে, সবাই মিলে খেতে হবে; কেউ একা কিছু খেতে পারবেনা…। মণিহার ভবনটি ৫ তলা; আমি স্থান পেয়েছি নীচতলার বারান্দায় এটার নাম মণিহার-৫; প্রত্যেক তলায় রয়েছে দুইটি ইউনিট; ইউনিট মানে একটা ৫০০ বর্গফুটের একটা বড় হলঘর; তার পেছনে নোংরা টয়লেট। বারান্দায় থাকার ফলে আমি যেমন মানুষ অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছি; পাচ্ছি বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে; তেমনি ওপর তলা থেকে ফেলা ময়লা, খাবার ইত্যাদি আমার বারান্দার সামনে জমে জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তাও সহ্য করতে হচ্ছে। সবার সাথে বসে আমি ভাত খেলাম, যেটুকু খেলাম, নষ্ট করলাম তার চেয়ে অনেক বেশী। হলঘরের সবাইকে বারান্দায় পাঠিয়ে মাগরিবের নামাজের জামাত হলো; আমিও সেখানে পড়লাম নামাজ; কষ্ট করে ওযু করতে হলো নোংরা টয়লেটের সামনে রাখা ড্রামের পানি দিয়ে।

আমার চোখে শুরু থেকেই চশমা ছিল; মোটাসোটা এক তরুণ কোত্থেকে যেন এসে আমাকে বলল, দেখি ভাই চশমাটা! বলেই সে নিজেই আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে চোখে দিলো। বলল, ও বেশী পাওয়ারনাই; এইটা আমি নিলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? ওটা ছাড়া আমার সমস্যা হয়; আপনি নিচ্ছেন কেন? না, এটা আপনারে দেওয়া যাবেনা; আপনি যে এইটা দিয়ে কারো চোখে গুতা দিবেননা, তার গ্যারান্টি কী? আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। আমাকে ঘাবড়াতে দেখে সে বেশ মজা পেল। আমি জানি এরা লোক সুবিধার না, তাই ঝামেলা এড়াতে বললাম, ভাই, চশমাটা দেন, এটা আমার শখের চশমা না, দরকারী জিনিস…।

দেব, তাইলে আমারে কী দিবেন? বেনসন দিব, আমি বু্দ্ধি খাটিয়ে বললাম। দেন, বলেই সে হাত বাড়ালো। এবার আমি বিপদে পড়লাম। বললাম, ভাই, কাল আমার পিসি একাউন্ট চালু হবে; তখন কিনে দেব। শুনে সে হাসল।

আমার ঘাবড়ে যাওয়া চেহারা দেখে মনেহয় সে ব্যাপক বিনোদন পেয়েছে। বলল, যান, এখন দিয়ে দিলাম; বেনসন যেন মিস না হয়…। এবার আমার মুখে হাসি ফুটল। সাথে সাথে আরেক দাড়িওয়ালা তরুণ এসে জিজ্ঞেস করল, আরে, আপনার পকেটে কী? ডাইলের শিশি মনে হয়…। আমি খালি জুসের বোতলটা বের করলাম।

ওটার ল্যাবেল-এর কারণে বোঝা যাচ্ছিলনা খালি কিনা। সে আমার হাতে থেকে কেড়ে নিয়ে দেখল সত্যিই খালি। ধুর, এইটা নিয়া ঘুরতেছেন ক্যান? বলেই সেটা বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। আমি বিপন্ন বোধ করলাম; এরা কি র‌্যাগ দিচ্ছে নাকি? আমার এ্ই বেকুব বেকুব চেহারাই আমার কাল; সবাই আমায় ঘুঘু চরায়…। তরুণটি এবার বলল, বাদ দেন; মজা করলাম; আপনার কেসটা শুনছি; আপনার ব্যাডলাক।

সাজ্জাদ নামের এই তরুণের সাথে বেশ খাতির হলো আমার; এর কথার টানে আর চেহারায় কবি কবি ভাব; ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে সে আর আমার চশমা ছিনিয়ে নেওয়া সেই তরুণটি। মাসখানেক ধরে এদের কেস চলছে; জামিন হচ্ছেনা; রায় কবে হবে, তার কোন ঠিক নেই। আমি দেখছি, দীর্ঘদিন ধরে কেস চলছে জামিন হচ্ছেনা, এমন লোকের সংথ্যা এখানে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ; অবাক হলাম। দু:খ পেলাম শাইখুল নামের এক পঞ্চাশোর্ধ লোকের কাহিনী শুনে; তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলায় (তার জমিসংক্রান্ত প্রতিপক্ষ করেছে) এখানে বন্দী হয়ে আছেন; কেস চলে; হাজিরার তারিখ পড়ে; সাজাও হয়না, জামিনও হয়না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, তাঁর ছোট মেয়েটাকে তিনি অনেক ছোট দেখে এসেছেন, সে এখন কতটুকু বড় হলো তা জানেননা; গ্রাম থেকে তার বড় ছেলে আর স্ত্রী মাসে একবার এসে দেখা করে যায়; উকিল আসে হাজিরার দুয়েকদিন আগে; বাইরের পৃথিবীর কোন খবর নেই তার কাছে।

উকিল প্রসঙ্গে শাইখুল চাচা বললেন, শুয়োরের বাচ্চার জন্যে আমি জেলে পচতাছি, ও চায়না মামলার রায় হোক; যতদিন মামলা চলব, ওর পকেটে আমার টাকা যাইব, হালারা কুত্তার চেয়ে খারাপ। এই একই কথা শুনলাম আমার এই পরিবারের আরেক সদস্য কার্তিক দা’র মুখে। তিনি তাঁর বন্ধুর সাথে ফলের ব্যবসা করতেন; ১৬ মাস ধরে জেলে বন্দী আছেন প্রতারণা মামলায়। শুনে বললাম, সত্যিই প্রতারণা করেছেন? কার্তিকদা দক্ষিণবঙ্গের সদাহাস্য ধরণের লোক; এক গাল হেসে বললেন, আমার পার্টনারের আশি হাজার টাকা মাইরে দিছিলাম, শালা মামলা করিছে দুই লাখ বইলে; অত টাহা দেব কোন জাগাততে? আমার কেসটা শুনে কেউ কেউ বলল, জামিন পেতে সমস্যা হবেনা; কেউ কেউ বলল, এক সপ্তাহ লাগবে। আমি বললাম, আমার উকিল তো বলেছে কাল কোর্টে কেসটা উঠবে।

শুনে একজন বলল, কাল তো হরতাল; মনে হয় কোর্ট বসবেনা। আমি হরতালের কথা শুনে ভয় পেলাম; কাল যদি জামিন না পাই? রাত বাড়ছে; ভেতরের হলে জামাত করে এশার নামাজ পড়া হলো; নামাজ শেষে বারান্দায় ফিরে এসে দেখি মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তাসের আড্ডা জমে গেছে; আমাকে দেখে একজন একটু সরে আমাকে বসতে দিল; বসে বসে ওদের খেলা আর আড্ডা দেখলাম। এখানে ঘড়ি নেই; কত রাত হলো বুঝতে পারছিনা; বুঝতে পারছিনা সময় থমকে গেল কিনা। আমার হঠাৎ মনে পড়ল সেই মহিলার কথা, যার মৃত্যুর কারণে আমি এখানে; সত্যি কি আমি কোন অন্যায় করেছি? মহিলাকে সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি করাইনি; তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করিনি; সে গত ঈদে বাড়ী যেতে চেয়েছিল, তাকে বলেছিলাম দু’মাস পর তাকে ছাড়ব…এইসব অপরাধের কি এই শাস্তি? এখন মনে হচ্ছে, কেন তাকে তখন বাড়ী যেতে দেইনি? কেন মৌমিতা জোর করে তাকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ালোনা, কেন তার বাড়ীর লোকেদের আর একদিন আগে খবর দিলামনা… এসব নানা চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে গেতে লাগলো। কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম, চিত হবার মতো জায়গা নেই।

বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখলাম; রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ; আকাশে মেঘের আনাগোনা; তার ফাঁক দিয়ে কিছু তারার ঝিকিমিকি। শুদ্ধ তারাকে বলে ‘তালা’; চাঁদকে বলে ‘তাত’; খুব মনে পড়ছে শুদ্ধ-র কথা; “আয় আয় চাঁদমামা” ছড়াটা শুনে ও আকাশ থেকে চাঁদ এনে আমার আর মৌমিতার কপালে টিপ পরিয়ে দিতো। আমি চোখ বুজে শুদ্ধর ছোট্ট মায়ামাখা মুখখানি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.