আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব-১০: মুক্তি
আজ রবিবার। আমার ঘুম ভাঙ্গলো ভোর ছ’টায় গেইট খোলার শব্দে; সবার হুড়োহুড়ি লেগে গেল গোসলে যাবার; আমি নির্বিকার শুয়ে রইলাম; জায়গা পেয়ে এবার একটু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমালাম কিছুক্ষণ।
ন’টার দিকে এলো রুটি-গুড়। আমি আকরাম ভাইয়ের কাছ থেকে আমার খাবারগুলো চেয়ে নিলাম; ভাগ করে খেলাম তাদের সাথে। শুনলাম ১২টায় পি.সি. শপ খোলা হবে; আকরাম ভাই জানালেন আমার নামে একটা পি.সি. অ্যাকাউন্টের হিসাবের বই আসবে; সেটা নিয়ে গেলে খাবার কেনা যাবে সেই দোকান থেকে; হিসাব লেখা থাকবে সেই বইয়ে।
১২টায় আমার হয়ে আকরাম ভাই লাইনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াল দিলেন পি.সি. শপের সামনে; তার এই আন্তরিকতার কারণটা বুঝলাম যখন আমার কেনার পালা এলো। আমার একাউন্টে জমা ছিল ২৫০ টাকা; আমার নাম করে ১৫০ টাকার জিনিস কিনলেন আকরাম ভাই: এক বোয়েম আচার, সাবান, সিদ্ধ আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, সরিষার তেল। আমি এখানকার পানি এড়িয়ে চলছি শুরু থেকে; তাই পানি কিনতে চাইলাম; পানি নেই; জুস কিনতে হলো এক লিটার। নিজের জন্যে কেনার মত আর টাকা নেই, ব্যলেন্স শূন্য। দেখলাম এই দোকানে সিঙ্গাড়া, জিলাপী পাওয়া যায়, মুদী দোকানের প্রায় অনেক পণ্যই আছে এখানে, এমনকি তাসের প্যাকেটও।
একটা মেনুচার্ট দেখলাম: খিচুড়ি, চিকেন বিরিয়ানী, তেহারী ইত্যাদিও পাওয়া যায়; তবে একদিন আগে অর্ডার দিতে হবে। টাকা থাকলে দেখছি জেলে থাকাটা খুব একটা কষ্টের নয়…। আমার যেহেতু টাকা শেষ; ফিরে গেলাম মণিহার ভবনে; মনে কৌতুহল, আকরাম ভাই এসব কেন কিনলেন?
দুপুরে গোসলের পর ভাত খেতে বসে পেলাম সে প্রশ্নের জবাব; ভাতের সাথে তরকারীর একটা ঝোল যা দেয়া হয়েছে তার ভেতর মিষ্টিকুমড়া ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না; আর ডাল নামের সেই পাতলা পানি আমি স্পর্শ করতে চাইনা। আকরাম ভাই সেই সিদ্ধ আলু পেঁয়াজ-মরিচ আর আচারের তেল দিয়ে মাখলেন। পরিবারের সবাই একসাথে গোল হয়ে খেতে বসেছি যার যার থালা-গ্লাস নিয়ে; আলু ভর্তা পেয়ে সবাই খুশি; প্রত্যেকের ভাগে বেশ ভাল পরিমানেই জুটলো।
আমি সেটাও খেতে পারলামনা মাত্রাতিরিক্তি ঝালের কারণে; অল্প কিছু ভাত খেয়ে নতুন কেনা জুস খেলাম অনেকখানি। ঝাল আলুভর্তা খেয়ে অন্যরাও একটু করে জুসের ভাগ চাইলো, এবার বোতল খালি হওয়াটা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।
নামাজ পড়লাম পদ্মা ভবনের সামনের মসজিদে। নামাজ শেষ হতেই দেখি আকরাম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন; জানালেন আমার গেস্ট এসেছে…। আকরাম ভাইয়ের পাহারায় ছুটে গেলাম গতকালকের সেই ভবনে।
দেখা হলো মা, মৌমিতা আর শুদ্ধর সাথে। উকিল সাহেবও এসেছেন; ওঁরা জানালেন, আমার জামিন হয়ে গেছে…। শুনে খুশীতে আমি আত্মহারা!! শুদ্ধ কী বুঝেছে কে জানে, আজ ওর মুখেও হাসির আলোকছটা, মৌমিতা আর মার চোখে অশ্রু চিকচিক করলেও মুখে হাসির ঝিলিক। উকিল সাহেবকে ধন্যবাদ দিলাম; মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম সৃস্টিকর্তাকে।
আমি জামিন পেয়েছি শুনে মণিহারে আমার ‘পরিবার’-এর সবাই খুব খুশী; এত দ্রুত নাকি কাউকে জামিন পেতে দেখেননি তাঁরা।
এবার তাদের জন্যে আমার ভীষণ মায়া লাগছে। এরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত; জায়গামতো টাকা ঢালতে পারলে হয়ত নিরীহ লোকগুলো খোলা হাওয়য় ঘুর বেড়াত আজ। আমি অনুধাবন করলাম, সত্যিকারের অপরাধীরা বের হবার পন্থাগুলো আগে থেকেই তৈরী রাখে; ধরা খেয়ে জেলের ভেতর পঁচে মরে পরিস্থিতির শিকার নিরীহলোকগুলো। জেলের ভেতরেও এরা কষ্টে আছে টাকা নেই বলে, এই এক দিনেই বুঝে গেছি এখানে টাকা থাকলে ভাল থাকা যায়; রাইটারকে সপ্তাহে ১৫০০ টাকার বেনসন দিলে ভাল বিছানায় ঘুমানো যায় ইলিশফালি ছাড়া, জেলারকে টাকা দিলে সেল-এ থাকা যায় পছন্দের লোকজন নিয়ে… আরো কত কী। আমার খুব ইচ্ছে হলো জেল থেকে বেরিয়ে একদিন এসে এদের পি.সি, অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা জমা দিয়ে যাব; ওরা যেন ভাল কিছু কিনে খেতে পারে।
আমি নিজ থেকে কিছু দেবার আগেই আকরাম ভাই বললেন, জেলখানার কাপড় বাসায় ফেরত নিতে হয়না, আপনার এই লুঙ্গিটা আমারে দিয়া যান।
নেন, আমি খুশিমনে বললাম। আরো একটা টি-শার্ট তাঁকে দিয়ে বললাম, আমি ওসব কুসংস্কার বিশ্বাস করিনা, এটা আপনাকে এমনিই দিলাম।
এবার আরেকজন (এর সাথে পরিচয়ও হয়নি আমার) এসে একটা শার্ট দেখিয়ে বলল, আপনার এই জামাটা আমারে দেন।
দিলাম।
বাকি কাপড়গুলো, তোয়ালে আর জায়নামাজটা একটা নেটে ভরে বেঁধে দিলেন আকরাম ভাই। অবশিষ্ট খাবারগুলো ওদেরকে দিয়ে দিলাম।
বিকেল তিনটা থেকে মাইকিং শুরু হলো; আমি এই প্রথম লক্ষ্য করলাম, ভবনের প্রত্যেক হলের দেয়ালে একটা ছোট মাইক স্থাপন করা আছে যেকোন ঘোষণা প্রচারের জন্যে। সেটায় আজকের জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদীদের নাম ঘোষণা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে আমার কাছে চেনা-অচেনা লোকজন আসতে শুরু করেছে, কেউ জানতে চাইছে এত দ্রুত কীভাবে জামিন পেলাম, কেউ চাইছে আমার উকিলের নাম, ফোন নাম্বার।
কিছু লোক এসেছে সাবানের প্যাকেটে, সিগারেটের প্যাকেটে তার ভাই বা পরিবারের কারো ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে; সবারই একটাই অনুরোধ, আমি যেন তাদের বাড়ীতে খবর দিই যে তারা এখানে খুব কষ্টে আছে; যেন কেউ টাকা নিয়ে আসে, দেখা করে যায়। কেউ কেউ অনুরোধ করল, আমি যেন আমার উকিলকে তাদের আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এদের আকুতি-মিনতিতে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম, আমার কষ্ট হতে থাকলো, কথা দিলাম ওদের দেওয়া সবগুলো নম্বরে ফোন করে ওদের বার্তা পৌঁছে দেব।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মাইকে শুনতে পেলাম সেই বহুপ্রতীক্ষিত নাম: স্বপ্নীল হাসান, সেই সাথে আমার প্রিয় বাবার নাম এবং আমার অপ্রিয় থানার নাম। আমি তৈরীই ছিলাম; আকরাম ভাইয়ের সাথে (কোন কয়েদীকে একা ছাড়ার নিয়ম নেই এখানে) বেরিয়ে এলাম মণিহার থেকে; সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারলামনা; ওদেরকে কথা দিলাম আর কিছু না পারি আকরাম ভাইয়ের পি.সি. অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠাব ওদের জন্যে।
এভাবে স্বার্থপরের ওদের ফেলে চলে যেতে খারাপ লাগছে আমার; মুক্তির নির্ভার নি:সীম আনন্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে ওদের বেদনার ওজন ও আয়তনে।
কয়েকদফা কারাগার অফিসের এ টেবিল ও টেবিল ঘুরে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে অবশেষে মূল গেইটের পকেটগেইট দিয়ে আরো কয়েকজন কয়েদীর সাথে বেরিয়ে আমি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলাম। আহ! স্বাধীনতা, তুমি ছিলেনা যখন, তখন বুঝেছি কী অমূল্য তুমি…। সামনে তাকিয়ে দেখি মা, মৌমিতা, শুদ্ধ আর উকিল সাহেব দাঁড়িয়ে; জানিনা এভাবে কত ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা।
আমি ছুটে গিয়ে মৌমিতা আর শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরলাম; তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, মা, আমায় ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।
মা আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করালেন।
শুদ্ধ ভীষণ হাসছে; মা আর মৌমিতার চোখে অশ্রু; তবে আজ ওদের চোখে আনন্দাশ্রু।
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো; “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।