গত ১০ জুন ছিল রেনেসাঁর কবি, জাতীয় মননের কবি ফররুখ আহমদের ৯৫তম জন্মদিন। আর মাত্র পাঁচ বছর পর কবির জন্মশতবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের এই অসাধারণ জননন্দিত কবির ৯৫তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ১০ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ঘরে ঘরে জনে জনে ফররুখের রচনা পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। এ আহ্বানের আলোকে ফররুখ আহমদের গান নিয়ে আমার দেশ ‘সংস্কৃতি’ বিভাগের পক্ষ থেকে একটি তাত্ক্ষণিক অনুসন্ধান চালানো হয়। এ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বাংলা গানের জগতে ফররুখের বিশিষ্ট অবদান সম্পর্কিত বিস্ময়কর তথ্যাবলী।
কবির জন্মশতবার্ষিকীর আগেই বিস্মৃতির আবরণ ভেদ করে তার গানগুলোকে জনসম্মুখে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জরুরতও অনুভূত হয় এ অনুসন্ধানে। লিখেছেন আহমদ বাসির
১৯৩৭ কিংবা ৩৮ সালে কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয় ফররুখ আহমদের। আরও কয়েকজন সঙ্গীসহ নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে যান ফররুখ। ওই সাক্ষাতে তখনও অখ্যাত ফররুখ নজরুলকে বলেছিলেন, আমি আপনার চেয়ে বড় কবি হতে চাই। নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ প্রাণখোলা হাসি হেসে জানতে চেয়েছিলেন—‘গান জানিস তুই? গান না জানলে আমার চেয়ে বড় কবি হবি কি করে!’ ধারণা করা হয়, ফররুখ আহমদ তখন থেকেই গানের ব্যাপারে সচেতন।
ফররুখের কলকাতা জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে রচিত বেশ কিছু গান এ ধারণার পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। ওই সময় ফররুখ আহমদের একটি গান মাওলানা আকরম খাঁ’র রচনা হিসেবে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ছাপা হয়। এ নিয়ে ফররুখের সঙ্গে মাওলানার সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে।
১৯৪৭ সালের পর অন্য অনেকের মতো ফররুখও ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা বেতারে যোগদান করেন স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪২ সালে নজরুলের সৃষ্টিশীলতার অবসানে বাংলা গানের জগতে সৃষ্টি হয় শূন্যতা। তদুপরি ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন সাংস্কৃতিক ধারা বিনির্মাণের প্রবল তাগিদ সৃষ্টি হয়। সে সময় রেডিও ছিল বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধান অবলম্বন। ফররুখ আহমদ তখন সবচাইতে জনপ্রিয় কবি। রেডিওর প্রয়োজনে সুরকার, শিল্পীরা গানের জন্য ধরনা দিতে লাগলেন ফররুখ আহমদের কাছে।
রেডিও তো শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান পরিচালনার সুবাদে ছোট শিশুদের জন্য যেমন তেমনি শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি রচনা করেন প্রচুর গান। ওই সময়ের সেরা সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকাররা ফররুখের গানে সুরারোপ করেন, গানের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন এবং সময়ের সেরা শিল্পীদের কণ্ঠে রেডিও’র মাধ্যমে সে সব গান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ফররুখ আহমদ নজরুলের মতোই বিচিত্র রকম গানের বাণী সৃষ্টি করে দুই যুগ ধরে এদেশের গানের জগতের বিপুল চাহিদা পূরণ করেন। সে সময় কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখ গান লিখতেন। এদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা ও জসীম উদ্দীন লিখতেন।
কিন্তু ফররুখের গানের চাহিদাই ছিল সবচাইতে বেশি। সে সময়ের সেরা আধুনিক গানের সুরকার, শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত বিভাগের প্রথম মুসলমান ছাত্র এবং উপমহাদেশ খ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিচালক আবদুল আহাদ ফররুখের অজস্র আধুনিক রোমান্টিক গানে সুরারোপ করেন। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে (আসা যাওয়ার পথের ধারে; বাংলা একাডেমী) সে কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। তার সুরারোপিত তার সবচেয়ে প্রিয় গানের তালিকায় ফররুখ আহমদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গানের কথা উল্লেখ করেছেন। এ গানগুলো সে সময় ছিল সর্বত্র জনপ্রিয়।
দূর দিগন্তের ডাক এলো, নব সৃষ্টির বুনিয়াদ হলো শুধু, আঁখিজল ও আঁখিজল, ঝড়ের ইশারা ওরা জানে, গুলে লালার দীপ শিখাতে, উঠল যদি আঁখির পলক—আবদুল আহাদের সুর করা এসব গান লায়লা আর্জুমান্দ বানুর কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে। রঙিন দিনের পাখি যায় ডাকি, অচিন দেশের হংস পাখি, আমার শেষ হলো না আশা—গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে হুসনা বানুর কণ্ঠে। আবদুল আহাদ জানিয়েছেন তার সুরারোপিত ফররুখের বহুসংখ্যক প্রেমের গান জনপ্রিয় হয়েছে আফসারী খানমের গানে। এগুলোর মধ্যে আবদুল আহাদ তার প্রিয় গানের তালিকায় উল্লেখ করেছেন—উঠল যখন আঁখির পলক একটি নিমেষ অনন্তকাল হোক, মালা চেয়েছিলে, যে বসন্ত ফিরে যায়, অভিশাপসম জাগিব তোমার প্রাণে, জ্বলি শ্যামাদানে জ্বলি বেদনার দহে, হায়রে বসন্ত যায় ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও ফররুখের অনেক জনপ্রিয় আধুনিক রোমান্টিক গানের উল্লেখ করেছেন অনেকে।
মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ তার ‘বাংলা কাব্যগীতির ধারায় ফররুখ আহমদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন এরকম কয়েকটি গানের কথা—রক্ত গোলাব তোমায় আমি, আয় মেঘ আয় দুরচারী রাহী, দাও পেয়ালা পূর্ণ করি আমি প্রতীক্ষাতুর আঁখি মেলে, এনেছি প্রাণের অশেষ তুষার জ্বালা, শুক্তি বক্ষে রেখেছ মুক্তা সিন্ধুর প্রাণকণা ইত্যাদি।
ফররুখ আহমদের প্রেমের গান তখন অন্যরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। তত্কালে চিত্রালী পত্রিকায় ‘তরঙ্গে রঙ্গ’ কলামে ফররুখ আহমদের দু’টি রোমান্টিক গান নিয়ে অন্যরকম(?) প্রতিক্রিয়াশীল লেখালেখিও হয়েছিল। এ দু’টি গান ছিল—‘ভোরের স্বপন যেন আমার হয় না বিফল’ এবং ‘এতটুকু বুকে এও কামনা রাখ কি দিয়ে’। ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের প্রেমের গানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে এর মধ্য দিয়ে।
শিল্পী সমাজের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ফলে চিত্রালী পত্রিকার ওই কলামটিই বন্ধ হয়ে যায়।
গণসঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রেও ফররুখের অবদান বিশাল। ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার শেখ লুত্ফর রহমান ও আবদুল লতিফ ফররুখ আহমদের অজস্র গানে সুর করেন। কেবলমাত্র বেতারেই এসব গানের সন্ধান মিলতে পারে এখন। এ ধরনের গানও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল।
এগুলোর মধ্যে ‘মাটির মানুষ মাঠের মানুষ/ঘরের মানুষ আর/এই দুনিয়ার সবার সাথে সমান অধিকার’ কিংবা ‘গরীবের তাজা বুকের লহুতে’ ইত্যাদি গানের কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। ফররুখ আহমদ আল্লামা ইকবালের অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন। আবদুল আহাদের মতে, এসব কবিতার কোনো কোনোটি ইকবালের মূল কবিতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আবদুল আহাদ ও অন্যদের সুর করা এরকম দুটি গান হচ্ছে—‘ওঠ দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও’ এবং ‘গুলে লালার দীপ শিখাতে’।
সে সময় শিল্পী, সুরকাররা ফররুখ আহমদকে অপরিসীম শ্রদ্ধা, সম্মান ও সমীহ করতেন তার কবিত্ব ও সাঙ্গীতিক বোধ-বিবেচনার জন্য।
এরকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। কিংবদন্তি গণসঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার আবদুল লতিফ তার বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন বার বার। আবদুল লতিফের বিখ্যাত গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি তৈরি হওয়ার পর গানটিকে কেউই পাত্তা দেয়নি। বিখ্যাত ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হতাশ হয়ে গানটি নিয়ে গেলেন ফররুখ আহমদের কাছে। তার বিশ্বাস ছিল, তিনি একটি অসাধারণ গান সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু কেউই যখন পাত্তা দিল না তখন দুরু দুরু বুকে এলেন ফররুখ আহমদের কাছে। গান শুনে ফররুখ আহমদ জড়িয়ে ধরলেন আবদুল লতিফকে। বললেন—লতিফ, এ গানই তোমাকে এদেশের মানুষের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে। হয়েছেও তাই। আবদুল লতিফের এ গান অক্ষয় হয়ে আছে আমাদের ইতিহাসে।
ফররুখ আহমদ ভাষা আন্দোলন ও দেশাত্মবোধক অনেক গান রচনা করেছেন। এ ধরনের গানের একটি ‘ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা/খোদার সেরা দান/বিশ্বভাষার সভায় তাহার রূপ যে অনির্বাণ’। শত শত হামদ, নাত ও জাগরণমূলক গান লিখেছেন ফররুখ আহমদ। সামনে চল সামনে চল, ওড়াও ঝাণ্ডা খুনেরা লাল, আজ মুজাহিদ উদ্যত শির, তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, জামাত হয়েছে খাড়া আজ শুধু ইমামত চাই, চল বীর চল নির্ভয় ইত্যাদি গান পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের বাংলাভাষী সৈনিকদের ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করেছিল। মুস্তাফা জামান আব্বাসী তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ফররুখ আহমদের শত শত হামদ নাত রেডিওর মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।
ফররুখ আহমদের গানের জগত্ যে এতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ এসব তথ্য থেকে এর কিছুটা আলামত মাত্র পাওয়া যায়। আসকার ইবনে শাইখ সম্পাদিত ‘নব জীবনের গান’ এবং আবদুল আহাদ ও লায়লা আর্জুমান্দ বানু সম্পাদিত ‘নব দিগন্তের গান’ (প্রকাশক : সিকান্দার আবু জাফর) গ্রন্থে স্বরলিপিসহ ফররুখের অনেক গান মুদ্রিত হয়েছে।
বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ফররুখ আহমদই প্রথম গান লিখেছেন এবং এখনও পর্যন্ত এ গানই এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গান—‘শোন মৃত্যুর তূর্য নিনাদ/ফারাক্কা বাঁধ! ফারাক্কা বাঁধ!’ ফররুখ আহমদের গানে সে সময়ের সেরা সুরকার আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, শেখ লুত্ফর রহমান, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদারউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মুন্সি রইস উদ্দীন ছাড়াও বহু সুরকার সুর করেছেন। বিখ্যাত শিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু, ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, আফসারী খানম, হুসনা বানু ছাড়াও অসংখ্য শিল্পী গেয়েছেন ফররুখের গান। মোট কথা গানের জগতে ফররুখ আহমদ অতি উঁচুদরের একজন গীতিকারের সারা জীবনের কাজ নিজেই করেছেন।
তার গানের জগত্ বহু-বর্ণিল, বিচিত্র। ফররুখ আহমদ যেমন জীবনে কোনোদিন সমুদ্র না দেখেও সাত সাগরের মাঝি লিখে অক্ষয় হয়ে আছেন, তেমনই সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় দীক্ষা না নিয়েও বাংলা সঙ্গীতের জন্য অপূর্ব সুর-ঝংকার সৃষ্টির উপযোগী অজস্র অসাধারণ বাণী সৃষ্টি করেছেন।
নজরুল-ফররুখ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার, সঙ্গীত স্রষ্টা না হয়েও গীতিকার হিসেবে স্মরণীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন ফররুখ। গীতিকার হিসেবেও যে তিনি বৈচিত্র্যের সাধনা করেছেন, সংখ্যাগত দিক থেকেও যে তাঁর কাব্যগীতি বা গীতিকাব্য বিপুল, সে সত্য চাপা পড়ে গেছে। হয়তোবা কখনও তেমনভাবে উদ্ভাসিতই হয়নি।
বাংলা কাব্যগীতি বা গীতিকাব্যের ধারায় ফররুখ আহমদের অবস্থান নির্ণয় করতে হলে সেটি তাঁর বিপুল সংখ্যক গান গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পরই সম্ভব। কিন্তু পাণ্ডুলিপি আকারে বন্দি তাঁর বিপুল সংখ্যক গান কি কখনও দিনের আলো দেখার এবং সুরের শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে?’ এ বক্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়—ফররুখের অনেক গান এখনও পাণ্ডুলিপিতে বন্দি, যেগুলোর সুরারোপ হয়নি অথচ ফররুখের গানের ব্যাপারে এক আশ্চর্য নীরবতা বিরাজ করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।