নিজেরে হারায়ে দিগদিগন্তে খুঁজি- "আপনভোলা" বৃষ্টি হচ্ছিল। তুমুল বৃষ্টি। সিডনীতে এখন শীত কাল, তার উপর বৃষ্টি। এমন বৃষ্টিতে কেউ সধারণত ঘর থেকে বের হয়না সহজে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঝালমুড়ি অথবা ইলিশ - খিচুরি খাওয়ার কথা এসময়।
কিন্তু বাংলাদেশীদের এই বিলাসিতার মোহ বোধহয় একদম কেটে গেছে আজকাল, দেশে হোক অথবা বিদেশে। তাইতো সিডনীর রাস্তায় গতকাল এক অন্যরকম দৃশ্য দেখা গেল।
আমাদের স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুন সিডনীতে এসেছিলেন। সাধারনত দেশের নেতা নেত্রীরা বিদেশে আসলে প্রবাসীরা খুশি হয়। যতদূর মনে পড়ে ছিয়ানব্বই অথবা সাতানব্বই সালের কথা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন দিল্লীতে। আমার মত অনেক বাংলাদেশীরা তখন ভারতে পড়াশোনা করে। ভারতে তখনও একটাই টিভি চ্যানেল। দুরদর্শন। আমরা সবাই দুরদর্শনের পর্দায় আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম কখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেখাবে।
অবাক ব্যাপার সন্ধ্যার খবরে নেই, রাতের খবরেও নেই - এমনকি সকালের খবর কাগজ তন্ন তন্ন করে খুজেও সে খবর পেলাম না। দল-মত নির্বশেষে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল সবার। স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুন দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি আসায় সবারই খুব খুশি হওয়ার কথা। ভাগ্যবান ভিআইপিরা সাগ্রহে দেখা করতে যাবেন।
কেউ কেউ হয়তো অভাব অভিযোগ নিয়ে তার কাছে যাবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না সিডনীতে এরকম কোন স্বাভাবিক ঘটনা ঘটেনি। ফুটপাতের দুদিকে অসংখ্য বাংলাদেশীরা দাড়িয়ে ছিল, আর আমাদের স্বরাষ্টমন্ত্রী কারো দিকে না তাকিয়ে নতুন বউ-এর মত বিশাল ঘোমটা টেনে গাড়ি থেকে বের হয়ে বোটানী রোড-এর টুইন হলে দ্রুত ঢুকে গেলেন। মনে হল যেন অনেকটা পালিয়েই গেলেন।
কোন নেতা নেত্রীকে এভাবে চেহারা আড়াল করে পালাতে কখনো দেখিনি। বাঙ্গালী নববধূরা ঘোমটা টেনে গাড়ি থেকে নামেন অনেকটা লজ্জায় এবং কিছুটা সামাজিক প্রথা মেনে চলবার জন্য। সেটা বাদ দিলে কোন অপরাধী ছাড়া আর কাউকে কখনো চেহারা আড়াল করে গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যেতে দেখা যায়না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন সিডনীতে। এরপর যাবেন রাজধানী ক্যানবেরাতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) উদ্বোধন করতে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন এমন সামান্য বিষয় উদ্বোধন করেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কেন বিশাল দলবল নিয়ে বিদেশে আসতে হবে? অবশ্য যখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারেই এমন অভিযোগ রয়েছে যে তিনি বিদেশে যাওয়ার কোন সুযোগ মিস করেননা, সেখানে স্বরাষ্টমন্ত্রীইবা সুযোগ পেলে কেন একটু দেশ-বিদেশে ঘুরবেননা? হলই নাহয় গরীব দেশের গরীবের টাকার শ্রাদ্ধ্য!
বোটানী রোড-এর টুইন হলে স্বরাষ্টমন্ত্রীর দলের লোকজন তার সিডনী আসা উপলক্ষে একটা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। আগেই যেমন বলা হয়েছে দেশ থেকে কেউ আসলে দল-মত নির্বিশেষে সব প্রবাসীই উদগ্রীব থাকেন। তাই এরকম সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শুধু দলের লোকই নয় সকল বাংলাদেশীদের অংশগ্রহন করার কথা। অথচ দেখা গেল অনুষ্ঠানে দলের লোকজনের উপস্থিতিও ছিল খুবই নগণ্য। দল হিসেবে সিডনীতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তশালী একটি দল।
তাদের সংগঠক এবং সমর্থকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সিডনীতে সবচেয়ে প্রসংশনীয় এবং সফল অনুষ্ঠান হচ্ছে বৈশাখী মেলা। তার আয়োজকও বঙ্গবন্ধু পরিষদ। এমন দলের নেত্রীর সংবর্ধনায় সামান্য উপস্থিতি বিস্ময়কর বটে! মনে হয় আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিক বিবেকবান সমর্থকরাও সাহারা খাতুনকে সংবর্ধনা দেবার কোনো যুক্তি খুজে পাননি । অনেকে অবশ্য বলতে পারেন, প্রবল বৃষ্টির কারনেই গতকাল তেমন কেউ আসতে পারেননি।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাড়ায় বৃষ্টির কারণে যদি হলের মধ্যে লোক সমাগম না হয় তাহলে হলের বাইরে খোলা আকাশের নিচে এত লোকজন এল কী করে? আরও মজার ব্যাপার হলো এসব লোকদের এক হাতে ছিল ছাতা আরেক হাতে ঝাঁটা।
ঝাঁটা বা ঝাড়ু বেশ প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি জিনিষ হলেও এটির প্রদর্শন যথেষ্ট অপমানজনক। যে কোন বিবেকবান মানুষ বলবে আমাদের এমন কোন কাজ করা উচিত নয় যাতে করে দেশের ভাবমুর্তি বিদেশে খারাপ হয়, দেশের একজন মন্ত্রী বিদেশে অপমানিত হন। একথা সবাই জানেন, সবাই মানেন। সবাই।
তাহলে কেন এতগুলো মানুষ এই শীতের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে গেলোরাস্তায়? কেন ঝাড়ু প্রদর্শন করলো সাহারা খাতুন কে? এদেশে তো আর মানুষ ভাড়ায় পাওয়া যায়না। সবাইকেই খেটে খেতে হয়। যে লোকগুলো এভাবে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল তারা প্রত্যেকে খেটে খাওয়া মানুষ। ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থেকে শুরু করে ট্যাক্সি ড্রাইভার, সরকারি বেসরকারি অফিসার থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের বেয়াড়া, সাধারন ছাত্র সবাই ছিল সেখানে। কিন্তু কেন?
বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৮ জন সেনা হত্যা, ৪৯ জলজ্যান্ত মানুষের গুম হয়ে যাওয়া, সাগর-রুনির অমানবিক খুন নিয়ে অবিবেচকের মত বক্তব্য, RAB কে দিয়ে সন্ত্রাসী নিধনের পরিবর্তে সাধারন মানুষের পিছনে লেলিয়ে দেওয়াসহ নানান সব অপকর্ম-ব্যর্থতা এবং সাহারা খাতুন দের ব্যার্থতা আর অদ্ভুত সব মন্তব্যগুলোই মানুষকে পথে নামিয়ে এনেছে।
একটি সাধারন পরিস্থিতিতে এরা কেউ অবশ্যই দেশের কোন নেতাকে গায়ে পরে বৃষ্টিতে ভিজে অপমান করতে যেতনা। দেশের পরিস্থিতিকে এখন কোন ভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এই ঝাড়ু দিয়ে এরা হয়তো দেশের অবস্থার এক্ষুনি কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবেনা, কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী একজনকে ঝাঁটা দেখিয়ে প্রতিবাদ করে নিজেদের ক্ষোভতো কিছুটা প্রশমিত করতে পারবে। সাহারা খাতুনের এই অপমানে নিহত মানুষদের পরিবার, ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া অসংখ্য ব্যক্তির পরিবার কতটা শান্তি পাবেন জানিনা তবে এতটুকু বলা যায় দেশের মানুষের কাছে তিনি যে একজন অতীব নিন্দিত, ঘৃণার্হ্য তা বিশ্ববাসী আরো একবার জানতে পারল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।