ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... বাংলাদেশ প্রতিদিন , 'ডাংগুলি' তে ১ জুন, ২০১২ এ প্রকাশিত
..............................................
বলটা উইকেটে লাগার সাথে সাথে রুবনের চোখ-মুখ কালো হয়ে যায়। ব্যাটটা বগলদাবা করে ও রওয়ানা দেয় মাঠের বাইরে। আমি আর আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করা মিশু দৌড়ে যাই ওকে থামাতে। অন্যরাও ছুটে আসতে থাকে।
মিশু বলে- ‘কই যাস, কই যাস, আমি কি তোকে আউট দিয়েছি?’
আমি অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।
মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না। দোষটা তো আমারি - যেহেতু আমিই বোলার।
উইকেটকিপার হাবিব হতাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- ‘কি রে ভাই, দেইখ্যা-শুইন্যা বল করতে পারিস না?
আমি মিন মিন করি- ‘আমি তো ঠিকমতোই বল করেছিলাম, অতটা ঘুরবে আমি কি জানতাম?’
রুবন অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে সমাধান দেয় আম্পায়ার মিশুই- ‘আচ্ছা আচ্ছা, এইটা নো বল কল করলাম। রুবন ক্রিজে যা।
’
সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। নয়তো আজকে পুরো খেলাটাই মাটি হতো।
ক’দিন আগেও ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। রুবনকে ব্যাট করতে দেয়া হতো একদম শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। কোনদিন দুই রানের বেশী করে ফেললেই ব্যাপারটা হতো বিস্ময়কর।
কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে পুরো চিত্রটি একদম পাল্টে গেছে। রুবন এখন ব্যাটিংয়ে নামে তার ইচ্ছানুযায়ী। ব্যাটিংয়ের সময় প্রতিপক্ষের বোলারদের তটস্থ থাকতে হয়। ফাস্ট বোলারদের বলের গতি কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসে, উইকেট সোজাও যায় না। স্পিনারদের বল ঘোরে না একদম।
রুবন পেটানোর পর বল আকাশে উঠে গেলেও ফিল্ডারদের গতি মন্থরই থাকে।
এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ রুবনের মামা। আগে আমাদের ব্যাট ছিল কাঠ দিয়ে নিজস্ব হস্তশিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত। সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকা থেকে রুবনের মামা রুবনের প্রাইমারী স্কুলের বৈতরণী পার হওয়া উপলক্ষ্যে উপহার পাঠিয়েছেন একটা ব্যাট। ও রকম ব্যাট আমরা কেবল টিভিতেই দেখেছি, একবার সদর স্টেডিয়ামে আন্তঃজেলা কলেজ টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়দের খেলতে দেখেছি ওরকম ব্যাট দিয়ে - কখনো ও রকম ব্যাটে হাত লাগানোর সৌভাগ্য হয় নি।
এর পরই রাতারাতি রুবনের ক্রিকেটীয় ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হলো। প্রথম দিন দশেক ব্যাটটা দিয়ে রুবন অন্য কাউকে খেলতে দিল না। তবে, ওরকম একটা ব্যাট হাতে নিতে পারাটাই আমাদের কাছে চরম সৌভাগ্য মনে হলো। খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিল। কয়েকজন ওই ব্যাট হাতে খেলার সুযোগ পাওয়ার আশায় রুবনকে খেলার মাঠের কর্তৃত্ব ও অবারিত অধিকার দিয়ে দিল।
খেলার নৈতিকতা আর বিশুদ্ধতা রক্ষায় আগ্রহী কয়েকজন রুবনের স্বেচ্ছাচারিতায় আহত ও ক্ষুব্ধ হলেও রুবন-গ্রুপ দলে ভারী হওয়ায় এবং আমাদের মনেও ব্যাট হাতে নেয়ার কিঞ্চিত লোভ থাকায় মুখ বুজে এই অত্যাচার সয়ে নিলাম। ফলশ্রুতিতে, গত কয়েকদিন ধরে সবাই এই ব্যাট দিয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে রুবনের ঔদার্যে নিজেদের ধন্য মনে করছি। তবে, রুবনের কড়া হুঁশিয়ারি - বল যেন জোরে না পেটাই, মাটিতে ব্যাট দিয়ে যেন আঘাত না করি - পাছে নতুন ব্যাটটা নষ্ট হয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন জানা গেল, গ্রামের চৌধুরী সাহেবের ক্লাস ফাইভ পড়–য়া অপরূপা সুন্দরী নাতনি আট বছর পর এসেছে গ্রামে। আমাদের খেলোয়াড় সমিতির সবচেয়ে তুখোড় ব্যাটসম্যান রিজভীর বাড়ির পাশে চৌধুরী বাড়ি হওয়ায় রিজভীর বোন ঝুমার সাথে সখ্য গড়ে উঠেছে।
একদিন রিজভী জানায়, সেই অপরূপা মেয়েটি আজ বিকেলে আসছে আমাদের খেলা দেখতে।
আমাদের মধ্যে উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায়। সবাই নিজের সবচেয়ে সুন্দর টি-শার্টটা পরে খেলতে আসে বিকেলে।
অন্যদিন দু’একজন বাদ পড়লেও আজকে হাজির খেলোয়াড় সমিতির ১৪ জনই। ৭ জন করে দল ভাগ হয়।
অন্যান্য দিন টস করে ব্যাটিং-বোলিং বাছাই করা হলেও আজকে তা হয় না। রুবন বলে দেয়, ওর দল ব্যাটিং করবে। আমাদেরও তা মেনে নিতে হয়।
ব্যাটিং শুরু করে রুবনই। আমি ওর বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন।
ওর চামচারা এসে বলে যায় - আজকে ভুলেও কোন গড়বড় হলে ফিরে যেতে হবে ‘কাষ্ঠযুগে’।
আমি লাল-টেপ দিয়ে প্যাঁচানো টেনিস বলটা আমার দলের ফার্স্ট বোলার সঞ্জয়ের হাতে দিয়ে শুকনো মুখে সে কথা জানিয়ে দিই।
সঞ্জয় আস্তে করে মাথা কাত করে। আমি ফিল্ডারদের জায়গামতো দাঁড় করাই। ঝুমা আর অপরূপা মেয়েটি মাঠের পাশের গাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকে খেলা দেখার জন্য।
সঞ্জয় দৌড় শুরু করে। রুবনের ব্যাট ধরার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বল যেভাবেই আসুক, সে ওটা গাছতলার দিকেই পাঠাতে চেষ্টা করবে।
কিন্তু সে চেষ্টা করার সুযোগ রুবন পায় না। আমাদের দেখা সঞ্জয়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির বল এটাই। ইয়র্কার।
এবং রুবন ব্যাট নড়ানোর আগেই মাঝখানের কঞ্চির তৈরী স্ট্যাম্পে বলের আঘাত। স্ট্যাম্পটা উপড়ে পড়ে যায় কয়েক হাত দূরে।
মেয়েদের হাততালি আর উল্লাসের ধ্বনি শোনা যায়। আমরা সবাই হতভম্ব। রুবনের চেহারা হলো দেখার মতো।
রাগে চোখ দুটো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। একইসাথে ঐ চেহারায় লজ্জা আর হতাশা মিলেমিশে একাকার। আমরাও কি করবো বুঝে উঠতে পারি না। রুবনের দলের খেলোয়াড়-কাম-আপাতত আম্পায়ার সাইফুলও কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। এখন ‘নো বল’ ডেকেই বা কি হবে।
ইজ্জতের যে ফালুদা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
রুবন ব্যাটটা বগলদাবা করে কারও দিকে না তাকিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়।
আমরা গিয়ে ঘিরে ধরি সঞ্জয়কে। - কি ব্যাপার? এমন করলি কেন? এখন রুবনকে মানাবে কে? জীবনে আর ঐ ব্যাট হাতে নেয়া হবে না।
সঞ্জয় মুচকি হাসে।
আমাদের প্রশ্ন আর ভর্ৎসনার তুবড়ির মাঝে সে হাত তুলে দেখায় গাছতলার দিকে। গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি ওদের ছাড়িয়ে আরও একটু দূরে চলে যায়। সেখানে দৃষ্টিপথে দেখা যায় সঞ্জয়ের ছোট ভাই রাজুকে। ওর হাতে ঠিক রুবনের ব্যাটের মতো একটা ব্যাট।
বিস্ময়ভরা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আমরা তাকাই সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয় লাজুক গলায় বলে, ‘কাল রাতে আমার ছোট কাকু এসেছেন ঢাকা থেকে। তিনিও আমার জন্য উপহার নিয়ে এসেছেন একটা ব্যাট। ভাবছিলাম, দু-একদিন পর ওটা নিয়ে আসবো। কিন্তু আজকেই মওকাটা যখন পাওয়া গেল, ভাবলাম, কাজে লাগাই।
এটা শুধু আমার একার ব্যাট না, সবার ব্যাট। আমরা সবাই আজকে থেকে এই ব্যাট দিয়েই খেলতে পারব। কারো দয়ার আশায় বসে থাকতে হবে না। ’
নিজেদের একটা ব্যাট! আজ থেকে সবাই এই ব্যাটে খেলবো! নতুন ব্যাটে! উল্লাসে হুল্লোড় করে উঠি সবাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।