আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসাদ মান্নানের পারাপারের কবিতা

সাইফ শাহজাহান আবুবকর সিদ্দিক শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষ্যমতে, কবিবহুল এই সত্যধামে প্রকৃত কবি এক বিরল প্রজাতি। কবিপ্লাবিত বঙ্গভূমেরও দশা তথৈবচ। আধুনিকতার অজুহাতে আজকাল মাঝে মাঝে ধোঁয়া ও ধোঁকায় চোখ জ্বালা করে। শিরঃপীড়া কুপিত হয়ে ওঠে। মদিবা ক্বচিৎ কোথাও কারুর একটি-দুটি সুস্থ কবিতা পেয়ে যাই, মন ভরে ওঠে কৃতার্থতায়।

গত এপ্রিলে রাজশাহী গিয়েছিলাম সাংস্কৃতিক উৎসবে। সেখানে আসাদ মান্নানের কাছ থেকে তার আনকোরা কাব্য ‘যে পারে পার নেই সে পারে ফিরবে নদী’ উপহার পাই। উৎসবমঞ্চে এ বইয়ের মোড়কও উšে§াচন করতে হয় আমাকে। তখন সৌজন্য ভাষণের বেশি আর কিছু বলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আমার পক্ষে। পরে ঢাকায় ফিরে এসে অনুকূল অবসরে বইটি পড়তে বসে প্রসন্নতায় ভরে উঠতে থাকে মন।

বহুদিন উপোসের পর সুকবিতার স্বাদে ঘরের আলো-বাতাস শুচি হয়ে যায়। সাগরমেখলা সন্দ্বীপের সন্তান কবি আসাদ মান্নানের কবিতাশরীর শিরায় শিরায় জলজ রসে আর্দ্র। নদী বিনা কবিতা বিরল তার এই ছত্রিশ পৃষ্ঠার কাব্যটিতে। পরিণামে শব্দপ্রবাহ, ধ্বনিস্রোত, উপমাব্যঞ্জনা সবকিছু নদীর মতোই নমনীয়-রমণীয়। স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রেরণা মূল উৎস তার কবিতার।

আবেগের তরল টানে ভেসে যেতে পারতেন কবি। না, সে প্রমাদ ঘটে যেতে পারেনি। পরিণত সংযমে বাঁধা তীর ধরে নিশ্চিন্ত নিরাপদে এগিয়ে গেছে কবিতার ধারাস্রোত। তবুও সংযম ক্ষুণœ হয়েছে শেষের দিকের একটি অংশের কিছু কবিতাযোজনায়। কী পেলব করস্পর্শে কবিতা লিখে যান আসাদ মান্নান।

পূর্ববঙ্গের জলমাটিলালিত জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে মনে হয় এটাই আমাদের কবিতার প্রধান উত্তরাধিকার। আসাদ মান্নানের প্রায় সব কবিতাই সমুদ্রসিঞ্চিত নদীনিকাশিত। উপমাপ্রতীকেও সেই হার্দ্য দ্যোতনা। স্বভাবে রোমাণ্টিক, চরিত্রে আধুনিক। আসাদ মান্নানের কবিতার সর্বাঙ্গে যে নদীপ্রাধান্য, সে তার আশৈশবের জলবিলাসজাত, সে কথা আগেই বলেছি (‘নদীকে জড়িয়ে বুকে যে কিশোর পাড়ি দেয় যৌবনের খাঁড়ি’, পৃ. ১৬)।

সে এক চিরকালের কিশোর, যাকে এই নস্টালজিয়ার অমৃতযন্ত্রণা মজিয়ে রাখে উত্তর বয়সেও (নদীকে ঘুড়ির মতো যে কিশোর উড়িয়েছে মেঘের ফেনায়’, পৃ. ৮)। প্রণয়প্রবণ কবির কবিতায় নারীচেতনা নদীরই রূপকাশ্রয়ী (‘সে কিন্তু প্রেমিক ছিল, তার বুকে নারী ছিল... নদী কি ছিল না?’; পৃ. ১১, ‘সে কেন রমণী ছাড়া অন্য কোনও নদীজলে সাঁতার কাটে না’; পৃ. ১৭)। নদীই নিরাময় (‘শাদা নদী আমার সুন্দর’; পৃ. ২১)। নদীই সুন্দরের মূর্ত পরিবাহী। শুধু প্রণয় প্রসঙ্গে নয়, জীবনের অন্যতর সব বিচিত্র অভিঘাতেও আসাদ মান্নানকে ফিরে আসতে হয় নদীর প্রতীকে-ইমেজে (‘নদীকে ঘুড়ির মতো যে কিশোর উড়িয়েছে মেঘের ফেনায়’; পৃ. ৮); (‘যে নদী আপন বুকে ধরে রাখে বেদনার মধু ও মৌচাক’; পৃ. ৯)।

কখনও দহনবেলায় (‘চিতার দহন থেকে যে জীবন উঠে আসে জলের গুহায়; পৃ. ৯); কখনও বা উপেক্ষায় (‘উপেক্ষা নদীর জলে ডুব দিয়ে ছুঁয়ে দেখে মেঘের ছলনা’; পৃ. ১০) নদীর চিত্রকল্পই একান্ত নির্ভর। ওপরে আমি আসাদ মান্নানকে প্রণয়প্রবণ কবি বলেছি। আমার আরও বলতে ইচ্ছে করে, আসাদ মান্নান শিল্প মানসিকতার দিক দিয়ে শতভাগ উপমা প্রতীকপ্রবণ কবি। তার কবিতা উপমাপ্রতীক ছাড়া একটি চরণও এগোতে জানে না। বইয়ে কোন কবিতার তো শিরোনাম দেননি, শুধু ক্রমিক নম্বর দিয়ে সাজিয়েছেন।

সেই অনুসারেই উদাহরণ তোলা যাক : ‘নক্ষত্রের নুড়ি’, ‘চাঁদের ওলান’, ‘লাটিম জীবন’, ‘নক্ষত্রের ওসবি’, ‘নদীর জরায়ু’, ‘ঘুমের মলম’। দুই নম্বর কবিতাটিতে মনে হয় গোটা দশেক মনকাড়া উপমা তথা চিত্রকল্পের সমাহার ঘটেছে : ‘চিতার আগুন জলে’, ‘কান্তিহীন ঈশ্বরের ছেঁড়া বিছানায়’, ‘জলের পিঞ্জর’, ‘নদী উড়ে যায়’, ‘নদীকে ঘুড়ির মতো’, ‘গোলাপি নিঃশ্বাস’, ‘সুগন্ধী নদীর তীরে’। ৬নং কবিতায় কবিতালতা বুঝি কল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে চায় : ‘কিশোরীর স্তন মেঘের ভেতর থেকে নতুন চরের মতো একা জেগে ওঠে খরার নদীর বাঁকে। ’ কত সাবলীল অথচ নতুন এ চিত্রল ইমেজ! এই কবিতার অন্যত্র : ‘মদ ও মাংসের গন্ধে জীবনের তালিমারা জামার পকেটে রাজহাঁস ডিম পাড়ে, ডিম ফেটে বের হয় বসন্তের গান। ’ একই সঙ্গে মৌলিক ও আধুনিক।

এ বইয়ে এরকম স্বকীয় ইমেজারি অঢেল। লোভ সংবরণ করা কষ্টকর, তবু আরও কিছু উদাহরণ টানা যাক : ‘মানুষের জিহ্বা কেটে সভ্যতা কি সবুজের শান্তি ফিরে পাবে?’ (ঐ); ‘যে নদী আপন বুকে ধরে রাখে বেদনার মধু ও মৌচাক’ (৩নং); ‘বাতাসে জিনের মতো উড়ে যাচ্ছে ডানাহীন জলের জীবন’ (ঐ), ‘জীবন আসলে এক চলমান সেলাইমেশিন’ (ঐ); ‘শূন্যতার শাদা পেটিকোট’ (৭নং); ‘অনশ্বর নদী’ (ঐ); ‘মর্গে মৃত রমণীর লাশ নিয়ে ঝগড়া করে ডোম ও ফেরেস্তা’ (ঐ); ‘যে গল্পে সমাপ্তি আছে তার নাম শোকসভা’ (৮নং); ‘যে নারী আগুন থেকে জš§ নিয়ে ঘুমিয়েছে শ্মশান খোলায়’ (ঐ); ‘যে নারী উদাম হয়ে একা একা øান করে শীতের নদীতে/তার বুকে জমা আছে পউষের হিমরাত্রি’ (ঐ)। এসব অসাধারণ সুন্দর মৌলিক বাকপ্রতিমা জরিদার শাড়ির মতো জড়িয়ে-ছড়িয়ে আছে কাব্যটির সারা শরীরে। আরও কিছু উদাহরণ তুলে আনা যাক : ‘আকাশ আড়ালে এসে মুখ ঘষে অরণ্যের নিঃসঙ্গ গ্রীবায়’ (১০নং। জীবনানন্দের উটের গ্রিবা উঁকি দেয় না কি?); ‘মরুভূমি বসে আছে নদীর খেয়ায়’ (ঐ); ‘পাহাড়ি খাদের পাশে চাঁদ এক ঘোমটা পরা বেদেনীর মতো কোমর দুলিয়ে নাচে ঝর্ণাতলে’ (১১নং); ‘শিশুর কাছে মেঘ হয়ে বিক্রি করে নদীর যৌবন’ (১৪ নং); ‘এক মাথা পাকা চুলে প্রজাপতি বসে’ (১৬ নং); ‘নিঃসঙ্গ নদীর যিশু সূর্যটাকে ন্যাংটো করে ঘরে তুলে রাখে’ (ঐ); ‘ঘুমের মলম’, (২৬ পৃ.); ‘প্রেমের খলিফা’ (ঐ); ‘জনক দেবতা’ (২৮ পৃ.।

শেখ মুজিবের রূপকার্থে); ‘রক্তমাখা হাজার কাসিদা’ (২৯ পৃ.। শহীদ শেখ মুজিবকে উৎসর্গিত শোককবিতা); ‘কালের পাথর দিয়ে তৈরি করে বাধা হল জলের নিঃশ্বাস’ (৩৪ পৃ.। রক্তরঞ্জিত বাংলা বর্ণমালার রূপকার্থে); ‘বেগানা রাত্রির শিশু চুষতে থাকে পূর্ণিমার ডাগর ওলান’ (পৃ. ৩৩। টিপিক্যাল পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দের আধুনিক ব্যবহার); ‘কাবিনের ফুল ছাড়া আর কোনও গাঁদাও ফোটে না’ (পৃ. ৩৬)। সারা বইয়ে একটি তবু কটু উপমা চাঁদে কলংকের মতো রসভঙ্গের হেতু ঘটিয়েছে; (সুন্দরের পায়ুপথে অবিরাম রক্ত ঝরছে’ (পৃ. ৩১)।

বিষয়গত কারণে দু’খণ্ডে সাজানো হয়েছে কবিতাগুলোকে : ‘মরুভূমি বসে আছে নদীর খেয়ায়’ ও ‘নিঃসঙ্গ নদীর যীশু’। প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছন্ন নায়কটি কবি স্বয়ং। ফলে কবিতাগুলো স্বভাবত আÍজৈবনিক। স্বপ্নমাখা হারানো শৈশব, নদী ও সমুদ্রসন্নিধির নষ্টালজিয়ায় জায়মান কবি ব্যক্তিত্ব,Ñ ওইসব ঈর্ষণীয় সম্পদে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে প্রতিটি কবিতা। দ্বিতীয় খণ্ডের নায়ক প্রচ্ছন্ন নন, সরাসরি, নরপশুর অস্ত্রাঘাতে শহীদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।

এছাড়াও আছে প্রিয় স্বদেশ ও রক্তরঞ্জিত বর্ণমালা। না, মোটেই মিশ খায়নি। প্রথম খণ্ডের পরাবাস্তব আবহ ও শৈল্পিক সাংকেতিকতা রূঢ় ধাক্কা খেয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডের রক্ত-মাংসময় বাস্তবতায়। সুলিখিত; মর্মস্পর্শীও। একই সংকলনে তবু এটা দু’সহাবস্থানে ঠেকেছে।

এই কাব্যটির সবচেয়ে প্রধান প্রসাদ গুণ এর সুমসৃণ বাকপ্রবাহ, স্বতশ্চল ধ্বনিনির্ঝর ও জোয়ারীসমৃদ্ধ গীতল ছন্দ (জীবনানন্দ ঘরানার)। এ তিনটি বৈশিষ্ট্যের জš§ আসলে একই ধ্যানোৎসার থেকে। জীবনানন্দ দাশের মতো প্রধানত বাইশ মাত্রায় বাঁধা প্রবহমান মহাপয়ারে চরণগুলো নীরব নদীর মতো বয়ে গেছে। প্রথম দর্শনেই এ কাব্যটি আমার চোখ কাড়ে বহিরঙ্গের টানে। র্৭ ী র্৬র্ -র অচলিত আয়তন, অতিদামী কাগজ, হলুদ পূর্ণিমা চাঁদ খচিত কালো পটভূমিতে সুনীল মেঘ ও তার সীমানায় শাদা রোদের পাড়,Ñ অভিনব প্রচ্ছদ।

ভেতরের প্রতিটি পৃষ্ঠাজুড়ে হালকা সবুজ জমিনের ধারে ধারে অনন্য শিল্পাভাস;Ñ আহা! এমন নান্দনিক রুচিঋদ্ধ কবিতার বইটি, ঢাকা নয়, রাজশাহীর দিবালোক থেকে বেরিয়ে এসেছে, ভাবা যায়? আসাদ মান্নানের কবিতাতরী আপন সিদ্ধির ‘পারে’ ফিরবে না তো কার তরী ফিরবে? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.