দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবনটাই বদলে যাবে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর থেকে ফিরে: প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই ভোট দেন যাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রহিমা বেগম (ছদ্মনাম)। ভোট দেন ধানের শীষে। কেন তিনি ধানের শীষে ভোট দেন? জানতে চাইলে বাংলানিউজকে বলেন, “বাবুরে অন (এখন) কি আর দেশো হানি (পানি) আছেনি? নাই। হানিও নাই, নোকাও নাই।
দু’গা (অল্প) ধান অয়, ধান খাই, ধানের শীষে ভোট দি। ”
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোট দিয়েছেন ধানের শীষে। কিন্তু যখন জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের এলাকায় ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে কে নির্বাচন করেছে বা যাকে ভোট দিয়েছেন তার নাম জানেন কি?” তখন অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো অভিব্যক্তিতে। উত্তর দিলেন, “ধানের শীষ জিচ্ছে (জিতেছে)। এবার নতুন বেডা (লোক) একগা (একজন) খাড়াইছে (নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন), হেতার নাম জানি ন।
তয় এবার বেলে জিয়াউল হক জিয়া ধানের শীষে খাড়ায় ন। ”
উল্লেখ্য, `৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপি’র জিয়াউল হক জিয়া। তবে ১/১১ এর পটপরিবর্তনের সময় তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরই মধ্যে লক্ষ্মীপুরের রাজনীতিতে মজবুত অবস্থানে চলে আসেন নাজিম উদ্দিন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ও পান বিপুল ভোটে।
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের উত্তর ফতেপুরের বৃদ্ধা রহিমা ধানের শীষে ভোট দেয়ার আর কোনো কারণ বলতে পারেন না। আর নৌকায় ভোট না দেয়ার কারণও ওটাই। আর কোনো মার্কার নাম জানেন? “অ্যাঁ (হ্যাঁ), লাঙ্গল আর দাঁড়িহাল্লা (দাঁড়িপাল্লা)। ’
জানা গেল, প্রথম ভোট দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সে সময়টার স্মৃতিচারণ করে বললেন, “হেতেনে (তিনি অর্থাৎ রহিমার স্বামী) কইছিল (বলেছিল) ধানের শীষে ভোট দিতে।
এয়ার হরের তাই (এরপর থেকে) এই মার্কা ছাড়া অইন্যো কোনো মার্কায় ভোট দেইনো (দেইনি)। আর আঙ্গ গেরামো বেকেএ (এবং আমাদের গ্রামের সবাই) হেই সময় ধানের শীষে ভোট দিতো। নৌকা আছিল কম। ” আঙ্গুল গুনে কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে বললেন, “অন এনা (এখনকার দিনে এসে) হোলাহাইনে (তরুণরা) নৌকাত ভোট দেয়। আঁই (আমি) দি ন।
”
নৌকা ও ধানের শীষ মার্কার দল ও ‘মালিকদের’ (দলের নেতা)) চেনেন রহিমা বেগম। বললেন, “আওয়ামী লীগের নোকা আর বিএনপি’র ধানের শীষ। ”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার পরিচয়ও জানেন। বললেন, “হাসিনার বাপ আছিল শেখ মুজিব। আন্দা (আমরা) ছোটকালেরতাইয়ে (ছোট বেলা থেকে) হেতার নাম হুইনছি।
হেতারলাইতো (উনার জন্যে) দেশ স্বাধীন অইছে। আঙ্গ হেতেনে (স্বামী) যুদ্ধের ত আই (মুক্তিযুদ্ধ থেকে এসে) কইতো শেখের কতা। হেতেনরা যুদ্ধের সময় বেলে একবার খবর রটছে শেখরে মিলিটারিরা মারি হালাইছে (খবর রটে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে)। হরে হুইনছি (পরে শুনেছি) মিছা কথা। রাজাকাররা এগিনি ছড়াইছে।
”
“আঁর এবো (এখনো) মনে আছে, যেদিন শেখে মইরছে (মারা গেছেন), হারা দুনিয়া আন্ধার অই গেছিল (সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এসেছিল)। আঙ্গ হেতেনে (আমাদের উনি) হদ্দা বাজারের ত (স্থানীয় পদ্মাবাজার) আই কয়, হুইনছনি? শেখ মুজিবরে কারা বলে মারি হালাইছে (কারা যেন মেরে ফেলেছে)। হেতেনের খুব মন খারাপ অইছিল। ”
রহিমা বেগমের মুক্তিযোদ্ধা স্বামী মারা গিয়েছেন বছর চৌদ্দ আগে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মাসিক টাকা নিয়মতই পান।
এ প্রসঙ্গের উল্লেখ করে বললেন, ``হেতেনের সার্টিফিকেট আছিল, হেল্লাই (এ জন্যে) কোনো ঝামিলা অয় ন। ”
তবে শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও মুজিবের নৌকায় ভোট দিতেন না রহিমার স্বামী। রহিমা এ প্রতিবদেককে বলেন, “জানি না, হেতেনেয়না জানে (তিনি জানতেন), কিল্লাই ধানের শীষে ভোট দিত! তোরেতো কইছিয়ে হেকতে (তোকে তো আগেই বলেছি) আঙ্গ এমি (এদিকে) বেকেএ ধানের শীষ কইরতো। ”
আগের এমপি জিয়াউল হক’রে কখনো দেখেছেন? জানতে চাইলে বলেন, “না। একবার ইলিকশনের আগেদি চণ্ডুর (স্থানীয় গ্রাম্য বাজার) গেছিল এই রাস্তাদি (বাড়ির পাশের রাস্তাটি দেখালেন)।
আন্দা চানের লাই (দেখার জন্যে) রাস্তাত খাড়াই আছিলাম। হেতে স্পিডে গাড়িত করি চলি গেছে। দেই ন আর (দেখি নাই আর)। ``
বর্তমান এমপি নাজিম উদ্দিনের নাম জানলেন এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে। জিজ্ঞাসা করলেন, “ইতার বাড়ি কোনাই (উনার বাড়ি কোথায়)?”
``ধানের শীষ মার্কায় ভোট দিয়ে সরকারের এমপি নির্বাচন করেছেন, এখন কেমন আছেন?`` রহিমা উত্তর দিলেন, “বালা (ভালো) নাই।
হেতেনে (প্রয়াত স্বামী) মরার সময় কিছু করি যাইতো হারে ন (সহায় সম্পত্তি রেখে যেতে পারেননি)। ভিডা কদ্দুরও আঁই থাই (এক চিলতে ভিটে নিয়ে আমি থাকি) । হোলা বড্ডাগা (বড় ছেলে) সোদি (সৌদি আরব) যানের সময় সব বেচি গেছে। আগে বছরে ২/৩ বার টেয়া হাডাইতো। কিন্তু গত ৪-৫ বছর ধরি টেয়া হাডায় না (টাকা পাঠায় না)।
বো (ছেলের বউ) আর ২ নাতি থায় আঁর লগে (থাকে আমার সঙ্গে)। মাইঝ্যা আর সাইজ্যাগা (মেঝো ও সেজো ছেলে) রায়পুরে মামার দোয়ানো বইয়ে (দোকানে বসেন)। ছোট্টগাতো উড়–ম উড়–ম (উড়নচণ্ডি স্বভাবের)। নিজের বো লই নিজের মতোন থায় (নিজের বউকে নিয়ে আলাদা থাকে)। মাইয়্যা তিনুগা (তিনজন) শ্বশুর বাইত (শ্বশুর বাড়িতে)।
”
বললেন, ``বাউরে (বাবারে) ভোট দি কি আর কিছু অয়নি? বেক (সব) জিনিসের দাম হত্তেদিন (প্রতিদিন) বাড়ে। নোকারে ভোট দিলে কি আঁর লাই হেতারা (রাজনৈতিক দল) কিছু কইরবনি? বেড়ার ঘর এডা ভাঙ্গি যাইবো কোনদিন। আঁর ঘর কি কেউ উডাই দিবনি? ছোট্ট হোলা মেট্টিক পাশ কইরছে, আঙ্গ এমির এক নেতা শরিফ একবার কইছে চাকরি দিব। কই, আর দিছে?”
জিজ্ঞাসা করলাম শরিফ কোন দল করে? বলল, “কে জানি! শরিফ হেকতে (ওই সময়ে) চেয়ারম্যানের কাছের লোক আছিল। ”
২০০৮ এর নির্বাচনে অপরিচিত নাজিম উদ্দিনকে ভোট দেয়ার আগে জিয়াউল হক জিয়াকে ধানের শীষে ভোট দিতেন রহিমা।
১৯৯০ সাল থেকে জিয়াউল হক জিয়া লক্ষীপুর-১ আসনে টানা ১৬ বছর নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। জিয়াউল হক জিয়া’র অনুসারীদের মাঝে তখন একটি ধারণা প্রবল ছিল; তা হলো-- লক্ষীপুরের রামগঞ্জ-রামগতির মানুষ জিয়া ছাড়া আর কাউকে ভোট দেবে না। এবং জিয়া স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করলেও নির্বাচিত হবেন।
ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে, ২০০৮ এর নির্বাচনী ফলাফল সেটাকে ভুল প্রমাণিত করে। জিয়াকে নয়, মানুষ ভোট দেয় ‘ধানের শীষ’কে।
অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষীপুরের বিএনপিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় ছিলেন নাজিম উদ্দিন। ১৯৯৬ সালের ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থী মনোনয়নের জন্যে নির্বাচন করা হয়ে। এতে নাজিম উদ্দিনের কাছে জিয়াউল হক জিয়া পরাজিত হলেও কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে জিয়াকেই মনোনয়ন দেয়া হয়। জিয়া ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন।
এসব বিষয় বলার ফাঁকে রহিমা বেগম ফের জানালেন, নাজিম উদ্দিন বা জিয়াকে নয়, তিনি ধানের শীষ মার্কাকেই ভোট দেন।
বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে ও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, লক্ষীপুর-১ আসনের ব্যাপারে স্থানীয়দের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি মতেরই প্রতিফলন ঘটেছে বারবার; এটা তো জাতীয় নির্বাচনেও দেখা গেছে। আর তা হলো এ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে একটি কলাগাছকে দাঁড় করিয়ে দিলেও বিপুল ভোটে জিতে যাবে। ”
লক্ষীপুরের বিভিন্ন থানার বিভিন্ন বয়সী ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বেশিরভাগই শুধু হাসিনা বা খালেদা এবং নৌকা বা ধানের শীষ দেখে ভোট দেন। বয়স্কদের অনেকেই জানেন না, কোন ব্যক্তিকে তারা ভোট দিয়েছেন।
রহিমা বেগম বললেন, ``ধানের শীষ আর নৌকা কিরব (কি করবে)? এই গেরামো যেগুনরে ভোট দিছি, হেগুনেইতো আর ভোটের হরে ( ভোটের পরে) খবর লয় ন (খোঁজ রাখে না)।
``
বাংলাদেশ সময় ১৭৫৬; ২৫ মে ২০১২
লিংক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।