চক্ষু মেলিয়া তাকানোর পর থেকে খালি বাঁদরামি করি যাহা দেখি সবই নয়া লাগে , , পাখির মতো মন হলেও,কলিজা বাঘের মতো , মানুষের মতো খালি দেখতে তে তে তে বগালেক থেকে আবার ট্রাকে , , রাস্তা একটু ভালো , , অনেকক্ষণ পরে ঝাঁকুনি একটু কমে যেন স্বর্গের শান্তি । শরীরের মাসেল গুলোতে যেন একটু স্থবিরতা । কিন্তু কোথায় আছে শান্তি সকলের জন্য নয় । ভেবেছিলুম এভাবেই হয়তো চলে যাব কেওকারাডং এর চূড়ায় । ট্রাকে করে কেওকারাডং জয় , তাহা ভেঙ্গে বিলীন হয়ে গেল যখন ট্রাকওয়ালা নামিয়ে দিল দারজেলিং পাড়ায় ।
এখানে চায়ের দোকান গুলোতে বসে হালকা খেলাম এর পরবর্তী সময় গুলোতে যে কি কুফা এসে টা ভাবতে লাগলাম ।
এখান থেকে ২০ মিনিটের পথ কেওকারাডং এর চূড়া ।
আমাদের ব্যাগ গুলোর বেশ ওজন । প্লান ছিল কেওকারাডং জাদিপাই হয়ে বগালেক এ গিয়ে রাত থাকব । তাই ব্যাগ গুলো চায়ের দোকানে রেখেই কেবল পানির বোতল নিয়ে রউনা দিলান ।
নিতান্তই নতুন,অজ্ঞ আর বোকা ছাড়া এই ধরনের প্লান কেও করে না।
গাইডের ভাষ্য মতে ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগলো । রোদের মধ্যে পাহাড় বেঁয়ে ওঠা অসাধারণ ।
অবশেষে আমরা কেওকারাডং এর চূড়া তে ওঠার সিঁড়িতে
চূড়াতে বসার ছাউনি
কেওকারাডং এর উচ্চতা প্রায় ৪৩৩২ ফুট । চূড়া টার মালিক
লালা মামা ।
তিনি তার পরিবার নিয়ে এখানেই থাকেন । এরশাদ সরকারের আমলে তাকে এই চূড়া ও আশেপাশের বেশ কিছু জায়গার মালিকানা দিয়ে দেয়া হয়। চূড়া থেকে লালা মামার বাড়ি
তিনি পর্যটকদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন । খাওয়া জনপ্রতি ১০০ টাকা , রাতে থাকা জনপ্রতি ১০০ টাকা ( বালিস কমলসহ) , , পানির লিটার ৬০ টাকা , এক বদনা পানি ১০ টাকা ।
লালা মামার কটেজ
দূর হতে আমি তারে দেখেছি , আর মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকেছি
জাদিপাই
কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে রউনা দিলাম জাদিপাই এর পথে ।
কেওকারাডং থেকে ৪ কিমি দূরে জাদিপাই পাড়া । সেইখান থেকে আরও কিছুদুর । আনুমানিক ৬+৬= ১২ কিমি আসা যাওয়া কেওকারাডং থেকে ।
আদা রাখা আছে
যাওয়ার সময় বেশ আরাম , ঢালু পথ খালি লাফিয়ে লাফিয়ে নামছি । কিন্তু আসার সময় যে এই পথ বাইতে হবে ।
ধুলোতে লিফানের পাহাড়ি ডাকাত বেশে
জাদিপাই পাড়া
একেবারে সন্নিকটে , এই পথের অবস্থা একেবারেই খারাপ । এক কথায় জানের ভয় আছে । কোন রাস্তা নেই , মাটিগুলোও বালির মতো স্থায়ী না । একবার ভেবেছিলাম আর যাবই না , ফিরে যাই , কিন্তু তাহলে পুরো কষ্টটাই বৃথা ।
ঝর্ণাটা বেশ নিচে , , এই নিচে নামাটাই রিস্কি
অবশেষে জাদিপাই , , আ হাহা !!!!
ঝর্না সাধারণত সরু হলেও এটি চওড়া , , সবসময়ই পানিতে রংধনু দেখতে পাবেন
পানিতে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে আবার ফেরার পালা ।
ফেরার কথা মনে হতেই আঁতকে উঠি । বিশেষ করে ঝর্নাতে নামার পথের কথা ভেবে , , নামা সহজ উঠবো কিভাবে , আলাহ মালিক । ভিজা কাপড়েই রউনা দিলাম ।
পাহাড়িরা এভাবেই আদা তুলে কেওকারাডং এ , , পারিশ্রমিক ৩ টাকা / কেজি ।
ঐ দিন কেওকারাডং ফিরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল ।
যদিও প্লান ছিল বগালেক ফিরে যাব , কিন্তু টা আর সম্ভব না । শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা । একবার ভেবেছিলাম , ঢাকা আর ফিরব না , , প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে নয় , , পথ পারি দেয়ার ভয়ে । আমাদের ব্যাগ গুলো দার্জিলিং পাড়ায় । কাপড় না হলেও হয় কিন্তু , ঔষধ , সিম , টর্চ, ল্যাপটপ সবকিছু ব্যাগে ।
উপায় না পেয়ে গাইড সাদেক ভাইকে পাঠালাম অন্তত ২ টা ব্যাগ আনতে । তিনি আবার কষ্ট করে গিয়ে আমাদের ব্যাগ ২ টা আনলো আর ২ টা রেখে আসল , , এজন্য আমরা আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ
কেওকারাডং এ রাত জাপনঃ
এ এক নতুন অভিজ্ঞতা । আবহাওয়া যে এত তাড়াতাড়ি বদলাতে পারে টা আগে বুজতে পারি নি । সন্ধার পর থেকেই বাতাস এর তোলপাড় । ফিরে এসে সবাই খেয়েছিলাম , মুরগি আর কুমড়ার তরকারি দিয়ে ।
তাই রাতে অনেকেই খেতে চাইছিল না । কিন্তু আমার আবার খুদা লেগে গেল । রাতে আমরা ৩ জন আবার খেলাম । কারেন্ট নেই , চারিদিক নীরব ।
মোবাইল এ নেটওয়ার্ক নেই , সারাদিন বাসার সাথে যোগাযোগ নেই ।
সাদেক ভাইের টেলিটকে হাল্কা নেটওয়ার্ক থাকলেও তা দিয়ে কথা বলা গেল না ।
চূড়ার ছাউনিতে গিয়ে বসলাম , সে এক অন্যরকম অনুভূতি ।
রাত বারার সাথে সাথে বাতাস আরও বেরে যাচ্ছে । রাত ১২ টার দিকে পুরা টর্নেডোর মতো অবস্থা । শো শো বাতাস , , সব যেন উরিয়ে নিয়ে যাবে ।
সেই কি অবস্থা । আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা । মার্চ মাসে এত ঠাণ্ডা কল্পনাই করা যায় না ।
কটেজের ভিতর
ডবল কম্বল গায়ে আমরা
লালা মামার ছেলে রুবেল ও রুবেলের নবাগত সন্তান । (রুবেলের স্ত্রী অর্থাৎ লালা মামার পুত্রবধূ নিঃসন্দেহে সুন্দরী)
পরদিন সকালে নাস্তা আর করলাম না , ১৭০০ টাকা বিল পরিশধ করে বিদায় নিলাম ।
৮ টা খাবার ৮০০ , থাকা ৫০০ , আর বাকি টাকা পানি ও অন্যান্য । ৬ :৩০ এ রউনা দিলাম ।
লালা মামার সাথে আমরা
ফিরতে পারেন ঝিরিপথে এজন্য বগালেক আগে আসতে হবে। আসার সময় ও আপনি ঝিরিপথে বলালেক এর পর কেওকারাডং । তাতে ৫-৭ ঘণ্টা লাগবে ।
তাই ঐ পথে আর পা বারালাম না । তবে চিংড়ি ঝর্না দেখব , তাই কেওকারাডং থেকে হেঁটে বগালেক আসার সময় পাবেন চিংড়ি ঝর্না
কাঠের পুল
চিংড়ি ঝর্না ( পানি নেই )
বগালেক থেকে আরও অনেক দূর পাহাড় বেয়ে নামলাম । কারণ রুমা ফিরতে হলে , গাড়ী চাই । আমরা আগে থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চান্দের গাড়ী ভাড়া করি নি , কারণ আমরা এসেছি ট্রাকে । তাই ট্র্যাকের আশায় বসতে বসতে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম , , হঠাৎ ট্র্যাকের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে মহাআনন্দে জেগে উঠলাম ।
শুরু হল আবার ট্রাক যাত্রা । অবশেষ প্রায় ৩ ঘণ্টার বেশি সময় পর আসলাম রুমাতে । এসেই আগে খেতে বসলাম ।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম । আজকেই ফিরতে হবে বান্দরবান সদরে ।
রাতে রউনা দিব ঢাকা ।
রুমা থেকে কাইক্ষ ঝিরি পর্যন্ত নৌকা ছাড়ার সময় সূচি
বিদায় বেলা , সাদেক ভাইয়ের সাথে ।
৮০০ টাকা দিয়ে নৌকা রিজার্ভ করলাম । প্রায় ১ ঘণ্টা পর ওপারে পৌছালাম । এপারে এসে সদরে আসলাম লোকাল বাসে করে ।
৬ টার দিকে সদরে । এসেই উঠলাম চট্টগ্রাম এর বাসে ১০০ টাকা জনপ্রতি । ৯ টার দিকে পৌছালাম। গ্রিন লাইনের টিকেট কাটলাম , , ৯০০/৯৫০ করে ।
প্রচণ্ড ক্ষুদা নিয়ে বসে আছি ।
টাকা ও তেমন নেই , , এমন সময় বন্ধু জাবেরের ফোন, তার বাসায় আসার নিমন্ত্রন ও বেশ অন্তরিকতার সাথেই । আমরা মুখে মানা করলেও মনে ঠিকই চাইছি । অবশেষে চলেই গেলাম তার আন্দরকিল্লার বাসাতে । নানান পদের তরকারি ও রকমারি ফল , আমরা গিয়েই খেতে বসে গেলাম সকল লজ্জা উপেক্ষা করে । হাফ প্যান্ট পরে কারো বাসায় গমন আমার জীবনেচ এই প্রথম।
তার আপ্যায়ন আজীবন মনে থাকবে ।
ফিরে আসলাম ঢাকায় , একগুচ্ছ সৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে । কষ্টের চেয়ে প্রাপ্তিই বেশি । পরিচিত হয়েছি নতুন কিছু মানুষের সাথে । নতুন ভাবে জীবন উপলব্ধি করেছি ।
দেখেছি প্রকৃতির রূপ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালাকে ।
সবাইকে অনুরোধ করব , অন্তত বান্দরবান সদরের ৬ টি স্পট পরিবার ও বন্ধুনবান্ধব নিয়ে ঘুরে আসুন । দেখুন বাংলাদেশ আর্মি কিভাবে অক্লান্ত পরিস্রম করে গড়ে তুলেছে ।
বাংলার পথে(পর্ব ১৬) -- বান্দরবানের ৬টি স্পট হয়ে জাদিপাই, ক
বাংলার পথে(পর্ব ১৭) -- বান্দরবান ৬টি স্পট হয়ে জাদিপাই, খ
বাংলার পথে(পর্ব ১৮) -- বান্দরবানের ৬টি স্পট হয়ে জাদিপাই, গ
বাংলার পথে(পর্ব ১৯) -- বান্দরবানের ৬টি স্পট হয়ে জাদিপাই, ঘ
কিছু প্রয়োজনীয় কথা :
* যাবার আগে ভালো করে সব জেনে যাবেন পরিবেশ পরিস্থিতি । পাহাড়ি- বাঙ্গালী প্রায় মারামারি লাগে ।
* প্রয়োজনীয় মোবাইল নাম্বার গুলো পূর্বের পোস্ট থেকে নিয়ে নেন এবং কাগজে লিখে সাথে রাখবেন ।
* পানির বোতল সবসময় সাথে রাখবেন ।
* অবশ্যই কেডস পরে যাবেন , কারণ পাহাড় ট্র্যাকিং এ স্যান্ডেল খুলে যাবে আর পায়ে ফস্কা পরে যাবে ।
* কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে খারাপ হোটেলে থাকবেন না , নিরাপত্তা অনেক জরুরি ।
* প্রয়োজনীয় ঔষধ নিবেন , ওডমাস , স্যালাইন , ফ্লাজিল , মুভ ক্রিম অবশ্যই ।
* কাপড় যত কম নেয়া যায় । কারণ বদলানোর সময় ও প্রয়োজন কোনটাই নেই । হালকা রঙের কাপড় নিন , ফুল প্যান্ট নেয়া ভেজাল বাড়ানো ছাড়া আর কিছু না ।
* বর্ষায় জোঁক ও মশার উপদ্রব বেশি ।
* বাঙ্গালী গাইড নেয়াই ভালো ।
* গাইডের ১ ঘণ্টা বলা মানে আমাদের জন্য ২ ঘণ্টা ।
* পাহাড়িদের ছবি তুলার আগে জিজ্ঞাসা করে নিবেন ।
* তরকারির ঝোল ও কলের পানি এড়িয়ে চলুন ।
* স্থানীয় তামাকের চুরুট ও বাংলা মদ " মহুয়া " পাওয়া যায়।
* কারো সাথে বিবাদে যাবেন না ।
* রুমা সদরে আর্মি , রুমা থানা ও বগালেক এ আর্মি ক্যাম্পে সশরীরে রিপোর্ট করতে হয় ( গাইডই তা করবে )
* রিপোর্ট করার সময় ক্যাম্পের ভিতর ছবি তুলবেন না ।
* অতিরিক্ত একটা চশমা ( যদি পড়েন ) , মোবাইল ও ক্যামেরার ব্যাটারি রুমা থেকেই চার্জ দিয়ে নিবেন , কারণ আর পর আর কারেন্ট নেই ।
* রুমা পর্যন্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক সব অপারেটরের থাকে । এর পরেই বিপদ । বগালেকের পর থেকে রবি আর টেলিটক পাবেন ।
কেওকারাডং এ শুধু টেলিটক , তবুও হালকা ।
* গামসা গলাতে রাখুন , কারণ তা ব্যাগ কোমরের সাথে বাঁধতে ও ঘাম মুছতে কাজে দিবে ।
* যে কোন সমস্যায় আর্মিকে জানান । বান্দরবান সদর থানা ০৩৬১-৬২২৩৩
* পাহাড়িরা খুবই বিশ্বাসী । আপনি যদি টাকা ও কোথাও ফেলে যান , ঐ টাও ফিরে এসে পাবেন ।
তাই ব্যাগ যে কোন দোকানে রেখে যেতে পারেন ।
* ৬ জনের দলে - বান্দরবান ৬ টি স্পট , বগালেক , কেওকারাডং , জাদিপাই , ৪ দিন ৩ রাত খরচ হবে ৫০০০+ টাকা ।
দয়া করে পরিবেশ নোংরা করবেন না । চিপসের প্যাকেট , কলার খসা , পলিব্যাগ নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন ।
বিশেষ ধন্যবাদ-- লিফান প্রিন্স তানভীর জাবের ও সাদেক ভাইকে ।
ধন্যবাদ সকলকে । বানান ও গুরুচণ্ডালী দোষ মার্জনা করবেন । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।