ঢাকা: দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলে আজকাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটি বিজ্ঞাপন। এর প্রকাশভঙ্গীটি চমকপ্রদ:
``২ গ্লাস হরলিক্স = ৬৬৬ গ্রাম ইলিশ মাছের সমান আয়রন বেড়ে ওঠার ডোজ, রোজ রোজ হরলিক্স তো রেগুলার খাবার। কেন আপনি দিচ্ছেন না?``
কিংবা ননদ তার ভাবীর পেছন পেছন ছুটছে আর বলছে- ভাবী ও এমন কী চাচ্ছে...(কারণ ভাতিজা বেশ হৃষ্টপুষ্ট এবং চটপটে আর ওই নারীর নিজের সন্তানটিকে দেখা যায় রোগা-পাতলা গোছের)।
প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলো দেখে মনে হতে পারে ভিটামিন এবং মিনারেল খুবই দুর্লভ বস্তু এবং আপনাকে ফুড সাপ্লিমেন্ট (সম্পূরক খাবার) হিসেবে ভিটামিন এবং মিনারেল বিশাল পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।
এ সূত্রে ভিটামিন এবং মিনারেল সম্পর্কে কিছুটা জানা যাক।
ভিটামিন
ভিটামিন হচ্ছে জৈবিক পদার্থ যা মানুষের জন্য খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন হয়, শরীরের নির্দিষ্ট কিছু কোষের কাজ সম্পাদনের জন্য। মানুষের দেহ ভিটামিন তৈরি করতে পারে না। সুস্বাস্থের জন্য ভিটামিনগুলোকে আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সাথে নিতে হয়।
মিনারেল
মিনারেল হচ্ছে অজৈব উপাদান যা মানুষের দেহ গঠনমূলক পদার্থ। এটি এনজাইম এর বিশ্লেষণে সহকারী হিসেবে কাজ করে।
স্নায়ুর সঞ্চালনে সাহায্য করে। অম্ল এবং ক্ষারের মধ্যে সাম্য রক্ষা করে। মানুষের দেহ মিনারেল তৈরি করতে পারে না। প্রত্যেকটি মিনারেল প্রতিদিন খাবারের সাথে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে নিতে হয়। এবং তা বেশি পরিমাণে নিলে হিতে বিপরীতই হবে।
এ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এর নির্দেশনাটি দেখা যেতে পারে
“There are many good reasons to consider taking vitamin supplements, such as over-the-counter multivitamins.
আমেরিকান একাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান্স (এএএফপি) এর মতে, একজন চিকিৎসক নিম্নোক্ত কারণে ভিটামিন প্রেসক্রাইব করতে পারেন। এগুলো হচ্ছে—
● নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায়
● নিরামিষ ভোজীদের ক্ষেত্রে
● মায়েদের ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা বা সন্তানকে দুগ্ধদানকালে
ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট তখনি উপযোগী হয় যদি তা নির্দিষ্ট কোনো পুষ্টি ঘাটতিকে পূরণ করে যা ওই ব্যক্তির নিয়মিত খাদ্য কোনোভাবেই পূরণ করতে পারছে না।
ভিটামিনগুলো সাপ্লিমেন্ট আকারে উপরে উল্লেখিত কন্ডিশনে উপকারি হতে পারে কিন্তু এর উপকারিতা প্রমাণিত নয়। আর স্বাভাবিক অবস্থায় তো নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
ভয়ংকর তথ্য
এফডিএ’র ডিভিশন অব ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট এর পরিচালক ব্যাসিলিওস ফ্রাঙ্কোস পিএইচডি বলেন, অন্যসব ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টের মত সাপ্লিমেন্ট ভিটামিন নেওয়ার সিদ্ধান্তও হাল্কাভাবে নেওয়া উচিৎ নয়।
কারণ, এতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে যায়।
যদি ভিটামিগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেওয়া হয় তাহলে এটা প্রমাণিত যে আপনার নিম্ন বর্ণিত সমস্যাগুলো হতে পারে:
চর্বি বা তেলে দ্রবণীয় ভিটামিন গ্রহণে যেসব ক্ষতি :
ভিটামিন এ (রেটিওনিক এসিড)—বিতৃষ্ণাবোধ বা সমুদ্রপীড়া, বমিভাব, মাথাধরা, মাথঘোরা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা, অবসন্নভাব, জন্মত্রুটি, লিভার (কলিজা) সমস্যা, হাড়ের ক্ষয়রোগে (অস্টিওপরোসিসে) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।
ভিটামিন ডি (ক্যালসিফেরল)—সমুদ্রপীড়া, বমিভাব, ক্ষুধামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস, দুর্বলতাজনিত বিভ্রান্তি, হৃদরোগ (হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন), কোমল কোষকলায় ক্যালসিয়াম ও ফসফেট জমাট বাঁধা। রক্ত তরলকারক হিসেবে ভিটামিন ই ও কে গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন গ্রহণে যেসব ক্ষতি হতে পারে:
ভিটামিন বি-৩ (নিয়াসিন)—মুখমণ্ডলে রক্তাভা, ত্বকের লোহিতভাব, পাকস্থলীর সমস্যা।
ভিটামিন বি-৬ (পাইরিডক্সাইন, পাইরিডক্সাল এবং পাইরডক্সামিন)— নার্ভ ড্যামেজ অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্র বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। যার সূত্রে অনুভূতিশূন্যতা বা অসাড়তা, হাঁটাচলায় সমস্যা এবং ব্যথাজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন সি (অ্যাসকরবিক এসিড)—পাকস্থলী বিপর্যয়, কিডনিতে পাথর, শরীরের লৌহশোষনের হার বেড়ে যায়।
ফলিক এসিড—বয়স্কদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে স্নায়ু বিপর্যয়।
অর্থাৎ হরলিক্স-এর কৌটায় ভর্তি করে দেওয়া ভিটামিনগুলো আপনার জন্য বিষ হয়ে আপনার যকৃৎ (কলিজা) নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, পক্ষাঘাত, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, কিডনি সমস্যা, ত্বকের সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতায় আপনাকে মনোদৈহিকভাবে ভঙ্গুর করে তুলতে পারে।
হরলিক্স কি?
বাংলাদেশে যে হরলিক্সটি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে ফুড ফরটিফাইড। পাউডার দুধ, গম এবং বার্লির সংমিশ্রণে তৈরি হরলিক্সে ভিটামিন এবং মিনারেল যোগ করা হয়েছে ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে। হরলিক্স প্রস্তুকারি কোম্পানি হচ্ছে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (GlaxoSmithKline(GSK))।
যেই ভিটামিন এবং মিনারেলগুলো উপকারি কিনা সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাই নিশ্চত নন, বরং অতিরিক্ত নেওয়ার কারণে সমস্যা হতে পারে সেগুলো আজ অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনভোলানো বিজ্ঞাপনে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষের সামনে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।
“বেড়ে ওঠার ডোজ
রোজ রোজ”
ভয়ংকর এই অ্যাডটি।
ফুড সাপ্লিমেন্টগুলোর কার্যকারিতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এগুলোকে রেগুলার খাবার আর ডোজ (কার্যকরি পরিমাণ) হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে! মনে হচ্ছে বাংলাদেশ যেন দ্রুত উন্নতির পথে ধাবমান একটি প্রতিশ্রুতশীল দেশ নয়, আফ্রিকার দুর্গম কোনো অঞ্চলের সভ্যতাবর্জিত কোনো সমাজের চিত্র--- যেখানে রাতদিন বিজ্ঞাপন আকারে একটি খাদ্যপণ্যের বিক্রি বাড়াতে এর কল্পিত গুণগান করা হচ্ছে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর।
হরলিক্স`র দেশ ব্রিটেনে দেওয়া বিজ্ঞাপনগুলোতে যা বলা হয়:
“Horlicks doesn`t just taste great; one mug contains 12 essential vitamins and minerals and is a rich source of Vitamin D - an essential aid to calcium absorption”.
“Horlicks contains a wide range of vitamins and minerals. Dr Frankie Phillips - an independent Nutrition Consultant and Registered Dietician - gives you the good news about how these vitamins and minerals are essential for wellbeing.
We all need a variety of essential vitamins and minerals to carry out important roles to keep us well”.
অ্যাডগুলোর কোথাও লেখা নেই: “বেড়ে ওঠার ডোজ” বা “Stronger, Taller, Sharper” বা “২ গ্লাস হরলিক্স = ৬৬৬ গ্রাম ইলিশ মাছের সমান আয়রন। ”
এই অ্যাডগুলো তারা ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেয় না। কারণ এ ধরনের ভুয়ামি করলে তারা সেই দেশগুলোতে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
আরো চমকপ্রদ তথ্য আছে।
২০০৪ সালে ডেনমার্কে হরলিক্স নিষিদ্ধ করা হয় অতিরিক্ত ভিটামিন এবং মিনারেল ব্যবহারের কারণে।
UK-তে “Stronger, Taller, Sharper”এই অ্যাডটি নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৮ সালে। তাও বাংলাদেশি কয়েকটি টিভি চ্যানেল এটি প্রচার করে। আরো মজার বিষয় হল, ইউকে’র হরলিক্সটি ফুড ফরটিফাইড নয়। মানে এতে অতিরিক্ত কোনো ভিটামিন অথবা মিনারেল এতে যোগ করা হয়নি।
কিন্তু, এখানে তাই করা হচ্ছে গ্রাহকের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় না এনেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।