আমি একজন বাঙ্গালি রমনী....... বিজ্ঞাপন ও আলোকচিত্র:
বিজ্ঞাপনে আলোকচিত্রের ব্যবহার বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি সাধারণ ঘটনা, যার প্রচলন শুরু হয়েছিলো ফটোগ্রাফি ধারনাটির উদ্ভাবনের সূচনালগ্নে । তবে ফটোগ্রাফির ইতিহাস দেখলে দেখা যায় সেখানে প্রচার-প্রচারনায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রের ইতিহাস ব্যাখ্যা বর্জন করা হয়েছে। কিন্তু আলোকচিত্রের এমন বাণিজ্যিক ব্যবহারের ভাষ্য খুজেঁ পাওয়া যায় Raymond Williams এর Advertising the Magical System’(Williams, 1980) নামক রচনায়। তবে বিজ্ঞাপনে আলোকচিত্র ব্যবহার করে নির্মাতা মূলত একটি বিভ্রম তৈরি করে পণ্যের প্রচারনার কাজ করে বলে বর্ণনা করেন রেমন্ড উইলিয়াম। তাঁর মতে,“বিজ্ঞাপনে আলোকচিত্র ব্যবহার করে যে চিত্র তুলে ধরা হয় তাতে নানারকম বিভ্রম দেখা যায়।
” আর এই বিভ্রম তৈরির উপাদান হিসেবে অনেক সময় ব্যবহৃত হয় আমাদের সামাজিক সম্পর্ক ও বন্ধনগুলো। এ নিয়েRobert Goldman বলেন ` Ads offer a unique window for observing how commodity interests conceptualize social relation.’(Goldman, 1992)|
বিজ্ঞাপন : বাংলালিংক
বিজ্ঞাপনটির পরিচিতি
নির্বাচিত বিজ্ঞাপনটি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ১৪ অক্টোবর ২০১২ তারিখে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লোয়ার ফোল্ডারে ৩২ কলাম/ইঞ্চি জুড়ে এসেছে ।
বিজ্ঞাপনটি বাংলালিংক মোবাইল কোম্পানির । বন্ধ থাকা বাংলালিংক চালু করলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে তাই নিয়ে এই বিজ্ঞাপন । বিজ্ঞাপনের ছবিতে একটি দম্পতিকে দেখা যাচ্ছে; যাদের মুখাভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা পরস্পরের প্রতি অসতুষ্ট ।
বিজ্ঞাপনটি বিশ্লেষণ
নমুনাকৃত বিজ্ঞাপনটির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে এটিই মূলত বিজ্ঞাপনটির শাব্দিক বা ডেনোটেটিভ অর্থ। রোলে বার্থের(১৯৭৭) মতে , যে কোন ছবির ফটোগ্রাফিক বার্তা দু-ধরনের , যেমন:
শাব্দিক অর্থ
শাব্দিক অর্থ হলো ছবি দেখে যা প্রথমেই মাথায় আসবে তাই অর্থাৎ সাদামাটাভাবে ছবির বর্ণনা।
অন্তর্নিহিত অর্থ
অন্তর্নিহিত অর্থ হলো ছবিতে আসলেই যা বলার চেষ্টা হয়েছে। যার মাঝেই বিজ্ঞাপনের মূল উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে।
পাশাপাশি মোডিফাই এবং মোডিফায়ারের মাধ্যমে অর্থ আরোপের যে প্রμিয়া এ বিজ্ঞাপনের কোন অংশে তার প্রতিফলন ঘটেছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করা হবে।
আর এই অর্থ তৈরির জন্য ছবির ফ্রেমিং গুরুত্বপূর্ণ। “ফ্রেমিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ছবির উপাদানগুলো নির্বাচন( selection ),, গুরুত্ব নির্ধারণ (emphasis) ও উপস্থাপনের (presentation ) কাজটি সম্পন্ন হয়। ”(গ্লোডম্যান,১৯৯২:৬১-৮৫)
বিশ্লেষণ পদ্ধতি:
অ্যাসাইনমেন্টটিকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হবে।
প্রথম অংশে বিজ্ঞাপনের আলোকচিত্রে পণ্যকে কিভাবে মানবীয় গুণে গুণান্বিত করা হয় তা আলোচনার পাশাপাশি কিভাবে মানুষকে বা মানবীয়/ সামাজিক সম্পর্ককে কিভাবে পণ্যে রূপান্তর করা হয়, তা আলোচনা করা হবে।
দ্বিতীয় অংশে বিজ্ঞাপনের আলোকচিত্রে কিভাবে সামাজিক সম্পর্ককে দেখানো হয়েছে তা বিশেøষণ করা হবে।
সর্বশেষে বিজ্ঞাপনের ভাষায় সামাজিক সম্পর্কের রূপায়ন কিভাবে ঘটেছে তাও বিবেচনা করা হবে।
প্রথম অংশ: এ বিজ্ঞাপনে মানুষকে মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনকে পণ্য করে তোলা হয়েছে । বিধবা স্ত্রী তার স্বামীকে ফিরে পেলেও এত খুশি হতে পারবে না যতটা বাংলালিঙ্ক তার পুরানো কিংবা হারিয়ে যাওয়া গ্র্হককে ফিরে পেলে হবে। এখানে মানুষকে তার মানবিক সম্পর্ক কিংবা সামাজিক বন্ধনকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে । অন্যদিকে একটি জড়পদার্থ মোবাইল কোম্পানির চাহিদা তথা ব্যবসায়িক চাহিদার এত মানবিকীকরণ করা হয়েছে যে , যেকেউ স্বাভাবিকভাবে এই বিজ্ঞাপনের প্রতি আকৃষ্ট হবে; যা এই বিজ্ঞাপনের একটি উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় অংশ: হার্টফিল্ডের মতে , বিজ্ঞাপনের ফটোগ্রাফির মাধ্যমে আসলে,
বাস্তব সামাজিক সম্পর্ককে লুকানো হয়,
আবাস্তব সম্পর্কের রূপায়র করা হয়।
এখানে দেখানো হয়েছে এক হারানো ব্যক্তি যাকে তার পরিবার মৃত বলে মেনে নিয়েছে; অনেকদিন পর সে ফেরত এলো । তাকে দেখে তার স্ত্রী খুশি না হয়ে বরং বাজারের লিস্ট দিয়ে বাজারে যেতে বলছে , যা নিতান্তই অবা¯তব। এমন অবাস্তব চিত্রায়নের মাঝে কতিপয় প্রথাগত বাস্তবতাকে আড়াল করলো নির্মাতা, তা হলো নারী মাত্রই গৃহপরিচারিকা । আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে নারীরা পুরুষকে আঁকড়ে ধরেই পরিবার কিংবা সমাজে টিকে থাকবে, পুরুষরাই অর্থের নিয়ন্ত্রণকারী।
বিজ্ঞাপনটিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সে মতাদর্শকেই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এতদিন পর এসেও পুরুষের হাতেই পড়েছে বাজারের দায়িত্ব অর্থাৎ অর্থ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা এখনো তার (পুরুষের)।
এমন অবাস্তব চিত্রায়নের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনটি প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা ও মানবিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন তথা মালিক পক্ষের স্বার্থসিদ্ধি করছে; নিম্নে তা বর্ণিত হলো:
সামজিক কাঠামো
আমাদের সমাজের প্রচলিত কাঠামোতে নারীকে গৃহের ভেতরে রাখার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। যার ব্যতিক্রম এখানে দেখা যায় নি। এখানে স্বামীহীনা (আট বছর যে নিজেকে বিধবা জেনেছে) এই নারী চরিত্রটিকে তার ন্বামী আট বছর পর ফেরত এসে ঘরেই পেল! যা আমাদের প্রথাগত সামাজিক কাঠামোরই একটি পরোক্ষ প্রদর্শন।
অন্যদিকে নারী চরিত্রটি তার স্বামীকে বাজারে লিস্ট দিল কিন্তু টাকা দিল না, যেন অর্থের মালিকানা প্রাপ্তি নারীর জন্য বেমানান। পাশাপাশি চাকুরীহীন গৃহপরিচারিকা নারীর পরিবারে কোন দারিদ্র্য নেই, কোন দুঃখ নেই, অপ্রাপ্তির বেদনা নেই বরং ফুলের টবে শোভা পাচ্ছে তাজা ফুল। কারণ বিজ্ঞাপনে কেবল সমাজের ধনিক শ্রেণীর চাহিদাকেই তুলে ধরা হয়। রোলে বার্থের(১৯৭৭) বক্তব্য এখানে বাস্তবায়িত জতে দেখা গেল,
`Commercial photographs because of their profuse nature, they have never sought to challenge the status-quo within the society , since they are only produced to sell the product.’
মানবীয় দুবর্লতার যথার্থ ব্যবহার
অন্যদিকে যেসব বিষয়ের প্রতি আমরা দুর্বল সেসব বিষয়ের উপস্থাপন আমাদের মধ্যে প্রত্যÿভাবে প্রভাব না ফেললেও পরোÿভাবে আমাদের মানবীয় চেতনায় এক ধরনের প্রভাব ঠিকই তৈরি করে। যেমন, এতদিন পর ফিরে আসলেও ব্যক্তিকে সাদরে গ্রহন করছে না তার পরিবার ,তবে একটি মোবাইল কোম্পানি ঠিকই তার গুরুত্ব অনুভব করতে সক্ষম হলো! এভাবে মানুষের মানবিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রচরনার কাজটি সফলতার সাথেই সেরে নিয়েছে বাংলালিংক।
আবার এখানেও সমাজের ধনিক শ্রেণীর মানবিক আবেদনকেই টার্গেট করা হয়েছে; যারা জন্ম থেকেই হারানোর বেদনায় জর্জরিত তাদেরকে এই বিজ্ঞাপনের আধেয় খুব বেশী নাড়া দেবে না । আর তাদের বিষয়টি চিন্তা করা হলে নির্মাতাও হয়তো এমন মানবিক আবেদনকে আধেয় করতেন না। অর্থাৎ এ বিজ্ঞাপনের মানবিক আবেদনটেও শ্রেণী পক্ষপাতী।
সামাজিক ব›ধনকে অবমাননা
বিবাহ একটি সমাজস্বীকৃত চিরস্থায়ী ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বন্ধন যার অবাস্তব রুপায়নের মাধ্যমে এই বিজ্ঞাপনে এমন সম্পর্ককে অর্থনৈতিক চাহিদাভিত্তিক সম্পর্ক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যেন বিবাহের অন্যতম ভিত্তি হলো অর্থ লেনদেন যেমন: সংসারের বাজার, যার কাছে দীর্ঘদিন পর ফেরত আসা স্বামীর ও কোন মূল্য নেই।
আপাতদৃষ্টিতে নিতান্তই মজাদার এই বিজ্ঞাপনের আধেয় একটি সামাজিক সম্পর্ককে অর্থের দাড়িপাল্লায় পরিমাপ করে বন্ধনটির অবমাননা করেছে বলে আমি মনে করছি ।
বিজ্ঞাপনের ভাষা
“আর কেউ না বুঝুক আমরা বুঝি আপনার ফিরে আসার গুরুত্ব”- আপাতদৃষ্টিতে এমন শ্লোগান শুনে মজা পেতে পারে দর্শক তবে গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হবে এটা দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতি তিরস্কার সূচক বাক্য। যা একটি সভ্য সমাজে কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর বিজ্ঞাপনের এমন ভাষা নারী চরিত্রটিকে করেছে হৃদয়হীনা , বিবাহ বন্ধনকে করেছে দৃর্বল বন্ধন।
শেষ কথা:
বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ছবি ও শ্লোগান সহ বিজ্ঞাপনটির ফেমিং সব কিছু মিলিয়ে সামাজিক সম্পর্কের একটি ভিন্নতর রূপায়নের মাধ্যমে মূলত বিভ্রম তৈরি করা হয়েছে যা কেবল কল্পিত নয় বরং একটি সামাজিক সম্পর্কের জন্য অনেকসময় অবমাননাকর।
তাই বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এরূপ চিত্রায়নে আরো বেশী সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি। নির্মাতাদের কেবল প্রচারনামুখী নয় বরং সামাজিক দায়বদ্ধতামুখীও হওয়া প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।