রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন এবং এতে তিনটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে, যাঁরা মুসলিম দর্শনে ও ইসলামের ইতিহাসে খারিজি, শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় হিসেবে অভিহিত। মূলত রাজনৈতিক প্রশ্নে বা নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে এই বিভাজন ঘটলেও পরে এর ওপর ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক রং চড়ানো হয়। এই বিভাজনের বীজ উপ্ত ছিল রাসুলুল্লাহর জীবনের শেষের দিনগুলোতে। যদিও ইসলামে সব মুসলমান ভাই-ভাই এবং সবার মর্যাদা সমান; তবুও একদল বেদুইনদের, অন্য দল হাশিমি কুরাইশদের এবং অপর একটি দল অ-হাশিমি কুরাইশদের (উমাইয়া কুরাইশদের) শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের দাবিদার ছিল। এ তিনটি দলই পরবর্তী সময়ে খারিজি, শিয়া ও সুন্নি হিসেবে পরিচিতি পায়।
খারিজি, শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় কয়েকটি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্য হচ্ছে খিলাফত বা ইমামত অর্থাৎ নেতৃত্বের প্রশ্নে।
খারিজিঃ
খারিজিদের মতে, যেকোনো মুসলমান খলিফা হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাঁরা হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.) ছাড়া অন্য দুজনকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। শিয়াদের মতে, ইমাম বা খলিফা অবশ্যই রাসুলুল্লাহর বংশধরদের মধ্য থেকে অর্থাৎ ‘আহলে বাইত’ থেকে হতে হবে। সুতরাং তাঁদের মতে, প্রথম তিন খলিফা প্রকৃতপক্ষে খলিফা ছিলেন না; বরং তাঁরা ছিলেন ক্ষমতার জবরদখলকারী।
সুন্নিদের মতে, খলিফা হওয়ার জন্য কাউকে রাসুলুল্লাহর পরিবারভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁকে কুরাইশ বংশের হওয়াই যথেষ্ট। তারা চার খলিফার রাজত্বকালকে ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’ মনে করে। হজরত আলী ও আমীর মুয়াবিয়ার মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সিফফিন যুদ্ধকে (২৯ জুলাই ৬৫৭ খ্রি.) কেন্দ্র করে খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তাঁরা ভিন্নমত পোষণ করতেন বলে তাদের ভিন্নমতাবলম্বী বা খারিজি বলা হতো।
মুয়াবিয়ার ক্ষমতা দখল (৬৬১ খ্রি.) এবং কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাকে (৬৮০ খ্রি.) কেন্দ্র করে আলীর নামে একটি দলের উদ্ভব ঘটে, যারা শিয়া সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রাসুলুল্লাহর ‘সুন্নাহর’ অনুসারী হিসেবে সুন্নি হিসেবে পরিচিত।
খারিজিরা হচ্ছেন ইসলামে প্রথম রাজনৈতিক সম্প্রদায় বা দল। তারা হজরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এই অজুহাতে যে তিনি (আলী) সিফফিন যুদ্ধের ফলাফলের ক্ষেত্রে সালিসের মাধ্যমে মীমাংসায় রাজি হয়ে গুনাহ বা পাপ করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেন আবদুল্লাহ আল কাওয়া, ঈতাব বিন আল ‘আওয়ার’, আবদুল্লাহ বিন ওহাব আর রাশিবী প্রমুখ।
খারিজিদের মতে, সমগ্র মুসলিম সমাজ কর্তৃক খলিফা নির্বাচিত হতে হবে। যদি প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে। খলিফাকে কুরাইশ বংশের কিংবা মুক্ত মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। দাসরাও খলিফা নির্বাচিত হতে পারবেন, যদি তাঁরা ভালো মুসলিম ও দেশ পরিচালনার যোগ্য হন। খারিজিদের কারো কারো মতে, এমনকি নারীরাও খলিফা হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
আবার কেউ কেউ খলিফার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে এই মত পোষণ করেন যে মুসলমানদের সম্মিলন নিজেদের শাসন করতে পারে।
খারিজিদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অখারিজি মুসলমানরা অবিশ্বাসী এমনকি কিতাবপন্থীদের (আহলুল কিতাব বা ইহুদি এবং খ্রিস্টান) চেয়েও খারাপ। তাদের মতে, অন্যায়কারী সে মুসলমান হলেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কর্তব্য। খারিজিরা মনে করেন, একজন মুসলমান যদি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান (নামাজ, রোজা ইত্যাদি) পালন না করেন, তবে তিনি পৌত্তলিকের (কধনরৎ) চেয়ে ভালো কিছু নন। তাদের মতে, একজন মুসলমান যদি গুনাহ বা পাপ করে তওবা ছাড়া বা অনুতপ্ত না হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তবে সে ব্যক্তি অনন্তকাল দোজখে বা নরকে শাস্তি ভোগ করবে।
এ ক্ষেত্রে বিশেষ দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনো সুযোগ নেই। খারিজিদের মধ্যে কট্টরপন্থী এবং মধ্যবিত্ত উদারপন্থী হিসেবে দুটি উপ-সম্প্রদায় দেখা যায়। নাফী বিন আজারকের (মৃত্যু ৬৮৬ খ্রি.) নাম অনুসারে এই উপ-সম্প্রদায় আজারিকা নামে পরিচিত। কট্টরপন্থী এই উপ-সম্প্রদায়কে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিকের শাসনামলে ইরাকি শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কার্যত নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। খারিজি অন্য একটি উপ-সম্প্রদায় আবদুল্লাহ বিন ইবাদজের নাম অনুসারে ইবাদজিয়া হিসেবে পরিচিত।
মধ্যম ও উদারপন্থী এই উপ-সম্প্রদায় বসরায় কেন্দ্রীভূত ছিল। বর্তমানে উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার ‘ইবাদাইতস’ এবং আলজেরিয়ার মজাব অঞ্চলের ‘উমান’ ও ‘মোজাবাইটসরা’ খারিজি সম্প্রদায়ভুক্ত।
শিয়াঃ
আমীর মুয়াবিয়া ইসলামের সার্বভৌম ক্ষমতা দখল করলে (৬৬১ খ্রি.) এবং কারবালায় ইমাম হোসেন মর্মান্তিকভাবে নিহত হলে (৬৮৫ খ্রি.) হজরত আলীর নামে মুসলমানদের একটা ‘দল’ বা সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, যারা শিয়া সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। শিয়ারা দৃঢ়ভাবে এই মত পোষণ করেন যে রাসুলুল্লাহ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং জামাতা হজরত আলী (রা.)-কে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেননি।
রাসুলুল্লাহ তাঁর অসুস্থতার সময় হজরত আবু বকর (রা.)-কে ইমাম মনোনীত করায় কেউ কেউ তাঁকে উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ইঙ্গিত বলে মনে করেন। আবার অন্যদের মতে, রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। শিয়ারা দাবি করেন, যে বিদায় হজ শেষে রাসুলুল্লাহ(স) খুমে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর সঙ্গীদের বলেছিলেন, ‘মুসার কাছে হারুন যেমন ছিলেন, আলী আমার কাছে তেমনই। আল্লাহ সর্বশক্তিমান! তাঁর বন্ধুদের বন্ধু হও এবং শত্রুদের শত্রু হও।
তাদের সাহায্য করো, যাদের তিনি সাহায্য করেন। যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দাও। ’ তারা আরো দাবি করেন, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানের নগর এবং আলী হচ্ছেন তার প্রবেশদ্বার। ’ একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও ইসলামী আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে শিয়া মতবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ : ১. খিলাফত বা ইমামতের অর্থাৎ নেতৃত্বের যোগ্য একমাত্র রাসুলুল্লাহর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা; ২. ইমাম হবেন ঐশী আশীর্বাদপুষ্ট, অভ্রান্ত এবং অভিশংসনের অযোগ্য। ৩. ইমাম হবেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আল কোরআনের ‘নিগূঢ় তত্ত্ব’ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী’ (অর্থাৎ তিনি কোরআনের দৃশ্যমান ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য অর্থাৎ অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যায় পারদর্শী)।
৪. হজরত আলী (রা.) ‘আল্লাহর বন্ধু’ (ওয়ালি আল্লাহ) উপাধিতে ভূষিত হন এবং সে জন্য আজান বা নামাজের আজানের সময় হজরত মুহাম্মদ (স)-এর পাশাপাশি হজরত আলী (রা.)-এর নামও ঘোষিত হবে। ৫. হজরত ইমাম হুসাইনের শাহাদাতবার্ষিকী আত্ম-উৎপীড়নসহ গণবিলাপের মাধ্যমে পালন করা। ৬. হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.) এবং হজরত ওসমান (রা.)-এর খিলাফতকে শিয়ারা বেআইনি ঘোষণা করেন এবং তাদের কারো দ্বারা এবং হজরত আয়েশা (রা.) দ্বারা বর্ণিত হাদিসকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে। ৭. শিয়া আইন বিজ্ঞান অনুযায়ী অস্থায়ী বিবাহকে (আল-মুতাহ) আইনসিদ্ধ মনে করা। ৮. অন্তরালবাদের তত্ত্ব (আল গায়েবাহ) অর্থাৎ ‘অন্তরালে অবস্থিত’ ইমামের উপস্থিতিতে বিশ্বাস।
এই বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে ৮৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহর নিজস্ব রক্তধারার শেষ ব্যক্তি শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম হঠাৎ করে উঁধাও হয়ে যান। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে এই ইমাম অদৃশ্য অবস্থায় পৃথিবীতে বর্তমান আছেন। তিনি মানবেতিহাসের ক্রান্তিকালে ‘ইমাম মাহদী’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। ৯. শিয়াদের ১২ জন ইমাম হচ্ছেন_(ক) হজরত আলী (খ) ইমাম হাসান (গ) ইমাম হুসাইন (ঘ) দ্বিতীয় আলী- জয়নুল আবেদীন (ঙ) মুহাম্মদ আল-বাকীর (চ) জাফর আস-সাদিক (ছ) মূসা আল-কাজিম (জ) আলী আর-রিজা (ঝ) মুহাম্মদ তকী আল জওয়াদ (ঞ) আলী নকী (ট) হাসান আল-আসকারী (ঠ) মুহাম্মদ আল মাহদী।
১০. ‘তাক্কীয়াহ’ তত্ত্ব শিয়া মতবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে শিয়ারা তাদের বিশ্বাসকে গোপন রাখার অধিকার রাখে।
শিয়াদের তিনটি উপ-সম্প্রদায় হচ্ছে_ইমামিয়া, ইসমাইলিয়া ও জায়াদিয়া। ইমামিয়া শিয়ারা উল্লিখিত ১২ জন ইমামে বিশ্বাস করে। তাঁরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ইমাম মাহদীর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে। অন্তর্বর্তীকালে ধর্মীয় পণ্ডিতরা হচ্ছেন জনগণের ধর্মীয় নেতা।
এটাই আধুনিক ইরানের ধর্মমত। ১৯৭৯ সালের ১৫ নভেম্বর ঘোষিত ইরানি সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চাশ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দ্বাদশ বা ১২তম ইমামের অনুপস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা আপাতত আইনশাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তিদের ওপর অর্পিত হচ্ছে_আল্লাহ যেন অতিসত্বর তাঁকে আমাদের মাঝে পাঠিয়ে দেন। ’ ইসমাইলিয়া শিয়ারা সপ্তম ইমাম হিসেবে মূসা আল-কাজিমের পরিবর্তে ইসমাইলের নেতৃত্ব স্বীকার ও মান্য করেন। উল্লেখ্য, ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিক তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইলকে সপ্তম ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ইসমাইল তাঁর পিতার আগে মৃত্যুবরণ করলে পিতা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মূসা আল-কাজিমকে ইমাম নিযুক্ত করেন।
কিন্তু ইসমাইলিয়ারা মনে করেন, ঐশী অধিকার হস্তান্তরযোগ্য নয়। জায়াদিয়া শিয়ারা চতুর্থ ইমাম জয়নুল আবেদীনের পুত্র জায়াদের অনুসারী। জায়াদিয়াদের বর্তমানে ইয়েমেনে দেখা যায়।
পরিশেষে শিয়া পাণ্ডিত্যের উচ্চতম ক্ষেত্রটি হলো দর্শনশাস্ত্র। নব-প্লেটোবাদের পরম (ঈশ্বর) জ্ঞানসহ অন্যান্য ধর্ম-দর্শন শিয়াদের পরম তত্ত্বজ্ঞান ও সুফি ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে আছে।
নাসির উদ্দীন তুসী, মীর দামাদ সাদরা সিরাজী অথবা জাফর কাশফীর মতো প্রথিতযশা চিন্তাবিদরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তদুপরি বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার ‘তাক্বলীদ’ তত্ত্বটি শিয়াদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি কোনো দিনই। তবে শিয়া ধর্মতাত্তি্বক পণ্ডিতরা গায়েবি ইমামের নামে একটি ধর্মতান্ত্রিক কমনওয়েলথ পরিচালনা করে আসছেন, যাকে এক অপরূপ ধর্মতান্ত্রিক একনায়কত্ব বলা যায়। ইসলামী ঐক্যের স্বার্থে শিয়া সম্প্রদায় সুরা আল আহযাবের বিশেষ আয়াতটির (৩৩:৩৩) ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়তে চাইবেন বা পারবেন বলে মনে হয় না, যেখানে বলা হয়েছে_’(হে নবী পরিবার) আল্লাহ মূলত এসব কিছুর মাধ্যমে তোমাদের মাঝ থেকে (সব ধরনের) অপবিত্রতাকে দূর করে তোমাদের পাক-সাফ করে দিতে চান। ’
সুন্নিঃ
সুন্নি সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দল।
মুসলমানদের মধ্যে খারিজি, শিয়া ও সুন্নিদের অনুপাত হচ্ছে যথাক্রমে শতকরা ৩, ১৫ এবং ৮২ ভাগ। আগেই বলা হয়েছে, সুন্নিদের মতে খিলাফত বা নেতৃত্ব রাসুলুল্লাহর পরিবারের মধ্যে সীমিত না রেখে কুরাইশ বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই যথেষ্ট। তাঁরা এটাও মেনে নেন যে খলিফাকে তাঁর সময়ের সবচেয়ে ভালো মানুষ হতে হবে না। অর্থাৎ তাঁরা মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের খিলাফতকে মেনে নেন। পরবর্তীকালে তাঁরা এটাও মেনে নেন যে খলিফাকে কুরাইশ বংশের হওয়ারও প্রয়োজন নেই।
কাজেই সুন্নিরা খলিফা উপাধি ধারণকারী সবার ইমামতকে স্বীকৃতি দেয়।
সুন্নিদের মতবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ ১. তাঁদের মতবাদ পুরোপুরি ‘সুন্নাহ’ বা রাসুলের ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি। ২. চার খলিফার ঐকতানিক সিদ্ধান্ত এবং সাধারণ সম্মিলনের সিদ্ধান্তকে কোরআনীয় বিধিবিধানের সম্পূরক হিসেবে গণ্য করা। ৩. সুন্নিদের কেউ কেউ সাদৃশ্যমূলক অনুমান বা সিদ্ধান্তকে আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করে। ৪. সুন্নিরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হলেও তারা তাদের মতবাদের মৌলিক উৎস হিসেবে কোরআন, হাদিস, ইজতিহাদ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে।
সুন্নিরা তিনটি উপ সম্প্রদায়ে বিভক্তঃ মুকাল্লিদ,গাইর মুকাল্লিদ ও আহলে হাদীস(সালাফী)। মুকাল্লিদরা চারজন সুন্নির ইমামের(আবু হানিফা(র),মালিক(র),শাফিয়ী(র),ইবন হাম্বল(র)) ইসলামী বিধিবিধানের ব্যাখ্যা মেনে চলে। অন্যভাবে তাদের হানাফি, মালিকি, শাফিয়ী ও হাম্বলি মাজহাবি বলা হয়। গাইর মুকাল্লিদরা চার মাজহাবের একটির বা অন্যটির কিছু বিষয় মানে বা সব মাজহাবকে সার্বিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে। আহলে হাদিস(সালাফী)রা চার ইমামের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে।
তারা “সালাফ” বা উত্তম পূর্বসূরীর অনুসরণ করে। মুকাল্লিদগণ ৪ জন ইমামের কোন একজনের অনুসারী হওয়াকে অপরিহার্য বলে মনে করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন দল বা মাজহাব অনুসরণ করা উচিত?এর উত্তর আল কুরআনেই পাওয়া যায়। সুরা ফুসসিলাত{হা-মীম সাজদাহ}(৪১) এর ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ”তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে,সৎকাজ করে আর বলে আমি মুসলিমদের মধ্যে একজন। ”অর্থাৎ আমাদের ‘মুসলিম’ হতে হবে,শিয়া বা সুন্নি হতে হবেনা।
এছাড়া কুরআনের বর্ণণা অনুযায়ী হযরত ইব্রাহিম (আ) মুসলিম ছিলেন। নিঃসন্দেহে অন্য সকল নবী-রাসুল(আ) এবং মহানবী(স) মুসলিম ছিলেন সুতরাং মহানবী (স) এর অনুসারীদেরকেও অবশ্যই ‘মুসলিম’ হতে হবে,শিয়া বা সুন্নী নয়। নবী (স) এর সাক্ষাৎ শিষ্যদের(সাহাবী) কেউ কখনো বলতেননা “আমি শিয়া” বা “আমি সুন্নী” বা “আমি হানাফী”,বরং তারা বলতেন আমি মুসলিম। দলীয় বিভাজনগুলো অনেক পরে এসেছে। তাই আমাদের উচিত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সবার আগে নিজেকে মুসলিম ভাবা, নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া।
“চার মাজহাবের যেকোন একটির অনুসারী হওয়া অপরিহার্য” এ মতবাদ বিষয়ে যেটা বলা যায় সেটা হচ্ছে সবার আগে কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী হওয়া প্রয়োজন,মাজহাবের নয়। মাজহাবের ইমামগণও(র.) ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন,তারা শুধুমাত্র দ্বীন পালন করবার সুবিধার জন্য আল-কুরআন ও প্রাপ্ত হাদীসের আলোকে সমগ্র দ্বীনের বিধি-বিধান ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদেরকে মহান শিক্ষক বা গুরু হিসাবে গ্রহন করা যেতে পারে,এর বেশি নয়। আল্লাহ অবশ্যই তাঁদের মহৎ শ্রমের প্রতিদান দেবেন। কিন্তু তাঁদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ ও প্রায় নবী-রাসুলের পর্যায়ে জ্ঞান করা মোটেও সমীচিন নয়।
ইমামগণের মাজহাবগুলো নিঃসন্দেহে একই ইসলামী মূলনীতির ওপরে ও সহীহ হাদীসের আলোকে দাঁড়িয়ে আছে,তবে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের বাত্যয় কিংবা ব্যখ্যার ক্ষেত্রে ত্রুটি প্রমাণিত হলে অবশ্যই সহীহ হাদিস ও তার ব্যাখ্যা গ্রহণ করা আবশ্যক। একটা কথা মনে রাখা দরকার,ইমামগণের সময়ে সকল হাদীস বর্তমানের মত সংকলন সম্পন্ন হয়নি,এত সহজলভ্য ছিলনা,কখনো একটি হাদীস সংগ্রহ করতে কয়েক মাইল ভ্রমণ করারও প্রয়োজন পড়ত। এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও ইমামগণ(র.) অক্লান্ত পরিশ্রম করে হাদীস সংগ্রহ করে তাঁদের প্রজ্ঞা অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। কোন কোন হাদীস তাঁদের কাছে পৌঁছান সম্ভব হয়নি এবং ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন বলে যদি পরবর্তীতে যদি তাঁদের ব্যাখ্যায় ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তবে আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করা উচিত। এ বিষয়ে স্বয়ং মাজহাবের ইমামগণের বক্তব্য পেশ করছিঃ
ইমাম শাফিয়ী (র) বলেন,
তোমাদের কারো কাছ থেকে রাসূল (স) এর সুন্নাত যেন ছুটে না যায়।
আমি যত কিছুই বলে থাকি তা যদি রাসূল (স) এর হাদিসের পরিপন্থী হয় তবে, রাসূল (স) এর কথাই আমার কথা।
[হাকিম, পাতা-১০০]
ইমাম মালিক (র) বলেন,
আমি মানুষ। ভুল ত্রুটি দুটোই করি। আমার রায় দেখ। যা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক তা গ্রহন করো এবং যা তার বিপরীত তা প্রত্যাখ্যান কর।
[আল জামি, পাতা-৩২]
ইমাম আবু হানিফা (র) বলেন,
হাদিস সহীহ হলে সেটাই আমার মাজহাব।
[আল হাশিয়া, পাতা-৬৩]
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র) বলেন,
যে ব্যক্তি রাসূল (স) এর হাদিস কে প্রত্যাখ্যান করে সে ধংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
[ইবনুল জাওয়ী, পাতা- ১৮২]
প্রকৃতপক্ষে মাজহাবের সকল ইমাম (র)গণের উদ্দেশ্য ছিলো মহান এবং তারা সবসময় সকল মানুষকে কুরআন ও হাদিস মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করে গেছেন। আর আমাদের নিকট আল্লাহর ‘মনোনিত’ ব্যক্তি হচ্ছেন রাসুল(স)। তাই একমাত্র ‘অন্ধভাবে’ অনুসরণ করা যেতে পারে রাসুল(স)কেই।
মাজহাবের ইমামগণ আল্লাহর মনোনিত নন বরং আল্লাহর রাসুল(স) এর অনুসারী এবং শরিয়তের মহান ব্যাখ্যাদাতা। সুতরাং সেভাবেই তাঁদের অনুসরণ করা উচিত। একথা নিশ্চিত যে আল-কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারীরাই আখিরাতে মুক্তি পাবে। পরিশেষে আল কুরআনের বানী ও রাসুল(স)এর হাদীস পেশ করে এই আলোচনা শেষ করছি।
“রাসুল(স) তোমাদিগকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদিগকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক”(আল-কুরআন,সুরা হাশরঃ৭)।
“আমি তোমাদের নিকট দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি – তোমরা যতদিন সে দুটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি জিনিস হচ্ছে আল্লাহ্'র কিতাব ও রাসূলের (স) সুন্নাত” (মিশকাত)।
লেখক: Md Mushfiqur Rahman Minar
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃনজরুল ইসলাম মজুমদার ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।