বার্তা২৪ ডেস্ক
লন্ডন, ২৬ মে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের সর্বনাশ করছেন। তাকে এ কাজ থেকে বিরত করতে দিল্লির হস্তক্ষেপ দরকার।
বৃটেনের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট শনিবারের সংখ্যায় বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে এসব কথা বলেছে।
‘বাংলাদেশের বিষাক্ত রাজনীতি: হ্যালো দিল্লি’ এবং ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যায় অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত দুটি নিবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
‘পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ ... ব্যাংগড অ্যাবাউট ... দ্য প্রাইম মিনিস্টার সেটস দ্য কান্ট্রি অন এ ডেঞ্জারাস পাথ' শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, সংসদ নির্বাচনের ১৮ মাস আগে বাংলাদেশে রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে, বিরোধী দলের নেতাদের জেলে পাঠানো হয়েছে, রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে গুম আর খুন বেড়েছে। আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে এবং স্বচ্ছ হবে কি-না তা নিয়ে বিবাদ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অনেক পর্যবেক্ষক সন্দিহান হয়ে পড়েছেন, দেশটিতে আদৌ নির্বাচন হবে কি-না।
খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক লোডশেডিং, নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় রাজপথে বিক্ষোভ হচ্ছে।
নিবন্ধে বলা হয়, সম্প্রতি অনেক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, দম্পতি সাগর-রুনিরও প্রাণনাশ হয়েছে। এ ছাড়া নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্তা করা হয়েছে।
সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দীর্ঘ অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি এতটা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, দাতারাও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে ঋণদান বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতির অভিযোগে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও তাকে নির্দোষ ঘোষণা এবং মন্ত্রিসভায় পুনর্বহাল করা হয়েছে।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, শেখ হাসিনা যতই কঠোর হচ্ছেন জনগণ ততই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে শেখ হাসিনা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আলোচনার পথ খোলা রাখতে চাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
নিবন্ধে বলা হয়, ঢাকার জরাজীর্ণ সড়কের মতো বাংলাদেশের রাজনীতিও যানজটকবলিত।
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিদেশী কূটনীতিক এবং পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়।
অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ'স টক্সিস পলিটিক্স, ... হ্যালো দিলি্ল ... ইট ইজ আপ টু ইন্ডিয়া টু ট্রাই টু স্টপ শেখ হাসিনা রুইনিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত অন্য নিবন্ধে হাসিনা সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দলও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে বিরোধী দল আগামী নির্বাচন বয়কট করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিবৃত্ত করতে দিল্লির প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
বলা হয়েছ, ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় ভারত এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বাড়াবাড়ি মেনে নিচ্ছে। দিল্লির প্রতি এ আহবান জানানোর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বেশ ভালো। এ ছাড়া আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হিসেবে একমাত্র ভারতই এখন বাংলাদেশের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব খাটাতে পারে।
নিবন্ধে বলা হয়, বিরোধী দলের একজন তরুণ নেতাকে (ইলিয়াস আলী) এক মাস আগে অপহরণ এবং সম্ভবত হত্যা করা হয়েছে।
এর আগে আরো দু'জনকে হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ নেতাকে অগ্নিসংযোগের মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রায় তিন হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি শুধু ভীতি প্রদর্শনের জন্য নয়, আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক মাসে আরো অনেক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এমনকি দু'জন গোয়েন্দা মোটরবাইকে ইকোনমিস্টের এ সংবাদদাতার পিছু নিয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে স্বনামখ্যাত ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্তা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে থাকেন। বাংলাদেশ সফর করার সময় হিলারি ক্লিনটন তাকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে জোরালো সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
হিলারির কথা ফের উল্লেখ করে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বলেন, আগামী নির্বাচন অবশ্যই সব দলের অংশগ্রহণে হতে হবে। সঙ্গত কারণেই ভারতের মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধী দলের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ আছে। একজন প্রবীণ বিএনপি নেতা বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি বিএনপি বয়কট করে তবে বিএনপি সমর্থকরা রাস্তায় ২০ দিন বিক্ষোভ সমাবেশ করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাবে।
'হ্যালো দিলি্ল' শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতি- যেখানে সাবেক রাষ্ট্রপতির কন্যার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতির বিধবা স্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের ওপর আঘাত হানছে। বিগত কয়েক মেয়াদ এ দু'দলই সরকার পরিচালনা করছে। এ ব্যাপারে বহির্বিশ্বের কোনো আকর্ষণ নেই। কারণ তাদের নেতৃত্বে দেশটিতে কোনো পরিবর্তনই আসেনি।
সম্প্রতি এ দু'দলের বিবাদ দেশটিতে সংকট তৈরি করেছে, যা দেশের পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাতে পারে।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, নব্বইয়ের দশক থেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া পালাক্রমে সরকার চালাচ্ছেন। তাদের নেতৃত্বে দেশের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কিন্তু গত এক দশকে পরিস্থিতি আরও করুণ আকার ধারণ করেছে। খালেদা জিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সরকার ছিল নির্মম। আসে সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাটদের সরকার।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিরঙ্কুশ গণরায়কে শেখ হাসিনা এখন ব্যবহার করছেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত এবং তার দৃশ্য-অদৃশ্য শত্রুদের হেনস্তা করার কাজে।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, গত বছর আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে; কিন্তু এ ব্যবস্থা যথার্থ নয়। ২০০৭ সালে বিএনপি নির্বাচনে কারচুপি করবে_ এমন আশঙ্কা থেকে আওয়ামী লীগ তুমুল বিক্ষোভ গড়ে তোলে, যা রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। এবার বিএনপিও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে ২০১৪ সালের ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।
এরই মধ্যে তারা কিছু হরতালও করেছে। এ অবস্থায় দেশটিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে দেখা দিতে পারে রাজপথে ভয়াবহ বিক্ষোভ। এত কিছুতেও মনে হচ্ছে সরকার নির্বিকার।
এতসব বিরূপ মন্তব্য ও সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি ইকোনমিস্ট।
অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগতির প্রশংসা করে নিবন্ধে বলা হয়, অর্থনীতির দিকে বিবদমান রাজনীতিকদের তেমন ভ্রুক্ষেপই নেই। তাদের উচিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখা, দারিদ্র্য আরও কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। বিদ্যুৎ স্বল্পতা, সড়ক অবরোধ এবং ভূমি বিরোধের মুখেও বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য ভালো করছে। দেশটির পোশাক শিল্প থেকে বছরে চার হাজার কোটি ডলার রফতানি হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনীতির সব সূচকেরই উন্নতি হচ্ছে।
৬ শতাংশের বেশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই তো সেদিনও যে দেশটি ছিল দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, সে দেশটি এক দশকেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। সে জন্য প্রয়োজন সরকারের একাগ্রতা।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ১১ আগস্ট 'দ্য পয়জনাস পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ : রিভারশন টু টাইপ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপে 'দি ইকোনমিস্ট’। ওই নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুস্থ-সবল; কিন্তু দেশটির রাজনীতি এগিয়ে চলেছে বিপরীত দিকে।
একই দিন 'ইন দ্য নেম অব ফাদার' শীর্ষক আরেক নিবন্ধে বিরূপ মন্তব্য করেছে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার এ আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। এ নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অতীত মোহে আবিষ্ট। বাংলাদেশ গত বছরের সে নিবন্ধ দুটির ব্যাপারে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছিল ইকোনমিস্টের দফতরে। ম্যাগাজিনটির অনলাইন সংস্করণে প্রতিবাদলিপিটি ছাপাও হয়েছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।