আসুন অন্যের বিচার করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখি। "ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান
/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
/আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার ।
আজকের এই দিনে এমনই এক কান্ডারীর জন্ম হয়েছিল এই বাংলার মাটিতে। বাঙালী জাতি যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল, তখন তিনি নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন পাল ছেড়া নৌকার ভার। শত তুফান উপেক্ষা করেও নিজের যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন পাল ছেড়া, পথ হারা এই জাতিকে উদ্ধারের জন্য।
নিজের জীবনে বিপন্ন করে কোটি কোটি জীবনে হাসি ফোটাবার ভার কাধে তুলে নিয়েছিলেন স্ব-ইচ্ছায়। বিদ্রোহী কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সমস্ত অন্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জানান দিয়েছিলেন।
"আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,/
/মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
/আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
/আমি দুর্বার,
/আমি ভেঙে করি সব চুরমার !
/আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
/আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল !
/আমি মানিনাকো কোনো আইন,
/আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন !
/আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর !
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
/বল বীর —
/বল বীর —
/চির- উন্নত মম শির !"
এই কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি "বিদ্রোহী কবি" নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরিচিতি লাভ করেন অভাগা বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে। তার এই কবিতার মাধ্যমে ফুটে ওঠে তৎকালীন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত চিত্র।
কবিতার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নজরুলই প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন। আর একমাত্র নজরূলই তার কবিতার মাধ্যমে সমগ্র বাঙালী জাতিকে জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিদ্রোহের স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন প্রতিটি স্বাধীনচেতা বাঙালীর মনে।
দেশ ব্রিটিশ শাসকেদের হাত থেকে মুক্তিলাভ করার পরে তিনি বাংলাদেশে বসবাসকৃত মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে মৈতির বন্ধন সুদৃঢ় করার অভাব অনুভব করেন। তার কবিতার মাধ্যমে ফুঠে ওঠে হিন্দু-মুমিনের মৈত্রির প্রতিচ্ছবি।
"এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
/একজনে দিলে ব্যথা-
/সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা। "
সকল অত্যাচার নিপীরনের বিরুদ্ধে তিনি তার বিদ্রোহ চালিগে গেছেন। সমাজের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন।
"দেখিনু সেদিন রেলে,
/কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
/চোখ ফেটে এল জল,
/এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
/যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
/বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
/বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
/কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
/রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
/রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
/বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
/কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
/তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
/ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!"
সারা জীবন গেয়ে গেছেন মানুষের গান। সকল ধর্ম জাতির উর্দ্ধে তিনি মানুষকে স্থান দিয়েছিলেন।
"গাহি সাম্যের গান-
/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্ ।
/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
/সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
-"
তাছাড়া সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা উঠে এসেছে তার নারী কবিতায়-
"সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। "
সকলে তাকে বিদ্রোহী এবং মানবতাবাদী কবি হিসেবে জানলেও তার কবিতার ছিল রোমান্টিকতার অপূর্ব সমন্বয়। তাছাড়া তিনি শিশু কিশোরদের জন্যও বেশ কিছু জনপ্রিয় কবিতা লিখে গিয়েছিলেন।
"মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেবো খোঁপায় তারার ফুল।
"
শিশু কিশোরদের জন্য তার প্রতিটি কবিতাই ব্যাপক জনপ্রিয় এবং তার লিখা প্রায় প্রতিটি কবিতাই এখন শিশু কিশোরদের পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভূক্ত।
"বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে!"
"কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-"
অনেকে তাকে অমুসলিম বলে দাবি করেছিলেন সে সময়ে। কিন্তু তিনি তার জবাব দিয়েছিলেন বিভিন্ন ইসলামিক কবিতা এবং গান রচনার মাধ্যমে। তার রচিত এই গানটি আমরা প্রতিটি ঈদের আগের দিন খুব আনন্দের সাথেই গাই।
"ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।
/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ । ।
/তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
/দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ। ।
"
পরিশেষে, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। দারিদ্রতাকে জয় করেও যে জীবনকে এতো উপরে নিয়ে যাওয়া যায়, জয় করা যায় কোটি মানুষের মন, তা প্রমান করে দিয়ে গিয়েছেন এই মহান কবি। তার সব অনন্য সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আজও অমর হয়ে রয়েছেন আমাদের কোটি হৃদয়ের মাঝে। আজ এই মহান কবির ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী। তাই এই দিনে আমরা সকলেই আমারদের জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।
"শুভ জন্মদিন হে কবি" ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।