২৬ মার্চ সকাল থেকেই আমার চোখ ছিল জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে জাতীয় সংগীতের বিশ্বরেকর্ড গড়ার আয়োজন সম্প্রচারের ওপর। টিভি পর্দায় অনুষ্ঠানটিকে সুপরিকল্পিত ও সুসমন্বিত বলেই মনে হচ্ছিল। মনে মনে আয়োজকদেরকে ধন্যবাদ দিতে শুরুও করেছিলাম। কিন্তু মূল সময় যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততই স্পষ্ট হতে থাকলো অনুষ্ঠানের দলীয় চেহারা । ফারজানা ব্রাউনিয়া চিৎকার করে 'জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগান উপস্থিত জনতার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে এর ষোলকলা পূর্ণ করেন ।
আমি জানি, এই শ্লোগান উচ্চারণ না করে সেটাকে বিকৃত করে বলা বা তাচ্ছিল্যের স্বরে ব্যঙ্গ করার বহু মানুষ উপস্থিত ছিল সেখানে। জাতির জনককে অসম্মান করে বিমলানন্দ উপভোগ করার বিকৃত রুচির মানুষ এ দেশে বহু আছে এটা কে না জানে। বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানিত করার সে সুযোগ তারা হরহামেশাই পেয়ে যায় এভাবে। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বা সরকারের এক শ্রেণির সুবিধাবাদী চাটুকার, যারা ক্ষমতাসীনদের হিতাকাঙ্ক্ষী নয় মোটেই, সুযোগ পেলেই নিজের আনুগত্যের প্রমাণাকৃতির প্রমাণ হাজির করতে লেগে পড়ে, তাতে রাষ্ট্রের বা সরকারের ক্ষতি-বৃদ্ধি হোক, তার তো আনুকূল্য বা পদোন্নতির পথ প্রশস্ত হয় ! যেমন এই একই আয়োজনে প্রত্যেকের জন্য ছিল একটি ক্যাপ, যাতে আঁকা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। শুধু এ কারণে এই ক্যাপ অনেকে টোকাই বা হকারদেরকে দিয়ে গেছে শুনেছি।
তাতে অবশ্য 'ব্ঙ্গবন্ধু' নামের প্রতীকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় না; কিন্তু এই কথাগুলো জনে জনে ছড়িয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলেই যাদের কর্ণবিদীর্ণ হয় তারা এমন আচরণে তুষ্ট হয়, পরিতৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ে তাদের চোখে মুখে। এবং এর ক্রুড়তা না বুঝলেও আমোদিত হয় কেউ কেউ। তাতে অবশ্য কিচ্ছু যায় আসে না কোট-টাই পরিহিত চাকরদের। তাদের তো উদ্দেশ্য হাসিল হলেই হয়।
আরও মর্মান্তিক হল, এই বিপুল জনতা, যারা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যেও সমস্বরে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি' গেয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়লো, যাবার সময় তাদের হাতে থাকা হাজার হাজার জাতীয় পতাকা তারা ছুঁড়ে ফেলে গেল প্যারেড স্কোয়ারে। আমার প্রাণের পতাকা পদদলিত হল, ছিন্ন-ভিন্ন হল। বিক্ষুব্ধ, বেদনাহত কয়েকজন ব্যথিত দেশপ্রেমিক, কিছু কিছু পতাকা এক জায়গায় জড়ো করে রাখার চেষ্টা করেছেন। সেটা সামান্যই। এতে অবশ্য আয়োজকদের দায় কতটুকু তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
কারণ কাগজে-কলমে তাদের কাজ শেষ পর্যন্ত জাতীয় পতাকার মর্যাদার দিকটি দেখা বা সে বিষয়টি ভাবার মধ্যে হয়তো থাকে না। জাতীয় পতাকার সম্মান বা মর্যাদা কীভাবে সমুন্নত রাখতে হয় এমন প্রশিক্ষণের জন্য বাজেট বরাদ্দ না থাকলে তারা এটা ভা্ববেন কেন? কিন্তু যে জনতার একটা বড় অংশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগত অথবা যারা সবাই ঢাকা শহরকেন্দ্রিক সচেতন জনগোষ্ঠী, তাদের এখনও এমন শিক্ষার অভাব থেকে গেল কোন রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতায় তা ভেবে দেখতে হবে। কিন্তু কারা ভাববেন ?
জনতা ব্যাংকের আব্দুল গণি রোড শাখায় গিয়েছিলাম টাকা তুলতে। আমার আগে থাকা এক ব্যক্তি ক্যাশ কাউন্টারে চেকসহ হাত বাড়াতেই বিপরীত দিকে থাকা অফিসার 'এখন টাকা দেয়া যাবে না, টাকা নেই' বলে চেকটি ফিরিয়ে দিলেন। ব্যাংকে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হওয়া নতুন কিছু নয়।
কিন্তু সেই লোক তার জ্বালা ঝাড়লেন এভাবে,
"ক্যান, আপনার ব্যাংক তো 'সোনার গান' গাওয়ার লাইগা হাসিনারে টাকা দিছে। এহন নাই কন ক্যান?'
মুহূর্তেই আমার সারা গায়ে ঘৃণা এবং ক্রোধ ছড়িয়ে গেল। নিজের টাকা-গোনা বন্ধ রেখে তাকে বললাম, "জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজনের জন্য টাকা দিয়েছে"। বিব্রত হয়ে লোকটির উত্তর "ওই একই কথা"।
আমি এবার জোর গলায় বললাম, "না, আপনি যেভাবে বলেছেন, এভাবে বলা ঠিক নয়"।
আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে লোকটি সটকে পড়ায় বলা হলো না।
তারপর থেকে দ্বিধান্বিত একটি জিজ্ঞাসায় সারাপথ তাড়িত হয়েছি। আসলে আমরা 'জাতীয় পতাকা-জাতীয় সংগীত' এসবের উপযুক্ত হয়েছি তো !
পাবলিক-প্রাইভেট যৌথ-উদ্যোগের সাফল্যে পরিতৃপ্ত হওয়ার কোন কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আম-জনতার কাছে যদি জাতীয়তার সারার্থ একটি খাবারের প্যাকেটের সমান হয়, যা কেবল কর্পোরেট মুনাফা ও 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'র মত বর লাভ করে এবং কাড়াকাড়ি বা ধাক্কাধাক্কি করে সেটি দখলে নিতে পারলেই অংশগ্রহণের সার্থকতা থাকে, তাহলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড শুধু "অফিসিয়াল এটেম্পট" ক্যাটাগরিতে নাম লেখানোর ব্যাপার হয়েই থাকে; সেটি দিয়ে কোন জাতীয় উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। আমরা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়াবেগমাখা চিঠিকে পণ্যমূল্যে বিকোতে দেই, আমরা জাতীয় পতাকাকে বিজ্ঞাপনী মোড়কের মত ওয়ান-টাইম সংস্কৃতির সাময়িকতায় বেঁধে ফেলি, জাতীয় নেতা-জাতীয় সংগীতকে মূর্খের তাচ্ছিল্যে পরিণত হতে দেখলেও দল আর বিবৃতির দাসত্ব থেকে বের হতে পারি না।
তবে কোন মমতায়, কোন বিহ্বলতায়, কোন প্রেমাস্বাদিত দেশাত্মবোধে আমাদের পূর্বপুরুষ এই পতাকাকে এই মাটির সম্পত্তি করে গিয়েছিলেন? এই মহাজগতে বাংলাদেশের একমাত্র চিহ্ন হিসেবে গেঁথে দিয়েছিলেন? যে পতাকা তাঁরা আমাদের হাতে দিয়ে গেছেন তা বহণ করার শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলছি না তো ? আমার মনে হয় সময় এসেছে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কঠোর হওয়ার। এর জন্য কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা হতে পারে, বহু লেখায়, বহু বক্তৃতা ও সেমিনারে পরামর্শ-প্রস্তাবনা আসতে পারে। কিন্তু কাজের কাজটি্ করতে হবে আর সময় নষ্ট না করে, এটাই আসল কথা। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধাসরকারি অফিসে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের সর্বোচ্চ সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা- তা প্রচলিত আইন প্রয়োগ করেই হোক বা নতুন করে আ্ইন গড়েই হোক। এখনই।
এই কাজটি করতে শুধু আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি সচেতন মানুষকে কাজে লাগানো জরুরি। বাঙালি এবং বাংলাদেশি পরিচয়গর্বী যেকোন মানুষ একাজে সৈনিকের ভূমিকা নিতে পারে। বাবার কাছে শুনেছি, আইয়ুব খান নামে এক পাকিস্তানি সামরিক শাসকের আমলে নাকি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের অমর্যাদার জন্য তাৎক্ষণিক বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা থাকতো। সেই ভয়ে তটস্থ থাকতো সিনেমা হলের দর্শকও। স্কুলের এ্যাসম্বলিতে জাতীয় সংগীত সজোরে না গাওয়ার জন্য যে শাস্তি আরোপিত ছিল তা আজো ভুলিনি।
ভুলিনি পিটিতে উপস্থিত হতে দেরি হলেও জাতীয় সংগীতের আগে লাইনে উপস্থিত থাকতেই হতো। এসবই এখন ইতিহাস। দূর (নাকি দুর্?)-আলাপন। এভাবে বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে জাতীয় বিষয়াদি চর্চার পাশাপাশি জাতীয় উদ্দীপনামূলক বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি-পট, প্রতিযোগিতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে মাদ্রাসায় কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অবশ্যই আমাদের নবীন-তরুণ প্রজন্মকে বিকলাঙ্গ-প্রতিবন্ধী-শেকড়হীন-ধরনের জাতীয় পরিচয় আমরা দিতে চাই না।
আমরা এমন প্রজন্ম চাই না যারা জাতীয় পতাকা বা সংগীতকে, জাতির বীর সন্তান বা জাতির স্থপতিকে তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে আত্মবিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠবে। আমরা চাই স্বাধীনতার ৪৩ বছরে হলেও এটা নিশ্চিত হোক যে, হৃদয়ের কতটা গভীর থেকে উচ্চারিত হয় জাতীয় সংগীত, কীভাবে চেতনার আকাশ-ছোঁয়া পবিত্রতম স্থানে তুলে ধরতে হয় জাতীয় পতাকা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।