আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্পদের আরেক নাম বর্জ্য সোনা! রাজধানীর বর্জ্য থেকে গ্যাস, বিদ্যুত্, কমপোষ্ট ও ফ্লোর পেভমেন্ট তৈরির সম্ভাবনা।

যেমন কর্ম তেমন ফল। রাজধানীর অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত বর্জ্য-আবর্জনাও হয়ে উঠতে পারে দেশের সম্ভাবনাময় সম্পদ, খুলে দিতে পারে নতুন দিগন্ত। গৃহস্থালীর আবর্জনা থেকে শুরু করে কল-কারখানার বর্জ্য; সবকিছুই নাগরিকদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে, অতিষ্ঠ করে তোলে জনজীবন। অথচ পরিকল্পিত উদ্যোগ আর ব্যবস্থাপনায় উত্কট দুর্গন্ধের আবর্জনা হয়ে উঠবে কমপোস্ট সার, বায়োমিথের মাধ্যমে উত্পাদিত হবে বিদ্যুত্। আবর্জনা থেকে উত্পাদিত গ্যাসে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৫০ মেগাওয়াটেরও বেশী বিদ্যুত্ উত্পাদন সম্ভব।

বিদ্যুত উত্পাদনের পাশাপাশি অবশিষ্ট কঠিন বর্জ্য থেকে তৈরি হবে আধুনিকমানের ফ্লোর পেভমেন্ট। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পিত উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে পরিবেশ-প্রতিবেশের, বেঁচে যাবে ঢাকার খাল-বিল-নদী। সম্ভাবনাময় এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়াটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি, পাশাপাশি প্রয়োজন সমন্বিত কার্যক্রমের। জানতে চাইলে বর্জ্য গবেষক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মজিবর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রথম কাজ হবে বর্জ্যগুলো আলাদা ভাবে সংগ্রহ করা।

তা হলে বর্জ্যকে রিসাইক্লিং করতে সুবিধা হবে। তিনি বলেন ঢাকা শহরের বর্জ্যের মধ্যে অরগানিক বর্জ্য বেশি। এটা থেকে সহজে কমপোস্ট সার তৈরি করা যেতে পারে। বিদ্যুত্, ডিজেল, পেভমেন্ট ব্লক তৈরিও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।

আমাদের সরকারের এসব নিয়ে সুষ্ঠ চিন্তার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তাদের টপ টু বটম এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ভালো ভাবে বুঝতে হবে। দীর্ঘসময় ধরে রাজধানীর বর্জ্যব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ ও জলবায়ু বিভাগের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু ধারণ ও অপসারণ ক্ষমতা বাড়ছে না। এখন জরুরী ভিত্তিতে ‘বর্জ্য’ সম্পদের পূণ ব্যবহার করা দরকার।

ঢাকা শহরের বর্জ্য থেকে খুব ভালো কমপোস্ট তৈরি করা সম্ভব। এ উত্পন্ন কমপোস্ট আমাদের দেশের কৃষি জমিতে ব্যবহার করলে জমির উর্বর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, বর্জ্য থেকে কমপোস্ট, গ্যাস, বিদ্যুত বা ফ্লোর পেভমেন্ট তৈরি করে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়াও সম্ভব। তবে বেশি উপকৃত হবে ঢাকা শহরের পরিবেশ, প্রতিবেশ। রক্ষাপাবে ঢাকা ও চারপাশের নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা নালা।

বর্জ্যকে সম্পদ করার উদ্যোগ: রাজধানীর বর্জ্য থেকে বিদ্যুত্ তৈরি করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিদেশী একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। ওই কোম্পানি প্রতিদিন ১০ হাজার টন বর্জ্য থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ তৈরি করবে। এছাড়াও বেশ কয়েক বছর ধরে ডিসিসির কাছ থেকে ওয়েস্ট কনসার্ন নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিদিন ৭শ-৮শ টন বর্জ্য নিয়ে কমপোস্ট সার তৈরি করে মার্কেটে বিক্রি করছেন। বর্জ্যের ধরণ: রাজধানীতে উত্পন্ন বর্জ্যগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়।

জৈব বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য (ধাতব এবং বিবিধ বর্জ্য এতে অন্তর্ভূক্ত)। বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করলে একদিকে যেমন বিভিন্ন পদার্থ/দ্রব্যাদি নির্মানের কাঁচা মালের পরিবেশ সম্মত যোগান সম্ভব হবে এবং অন্যদিকে বর্জ্য ফেলার ল্যান্ডফিলের আয়ুস্কাল বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য বর্তমানে ঢাকা সিটির জন্য দুটি মাঝারি ধরনের ল্যান্ডফিল রয়েছে যা আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে ভরাট হয়ে যাবে। ল্যান্ডফিলের জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া ঢাকা সিটির জন্য খুবই দুস্কর। বর্জ্য থেকে বিদ্যু, কম্পোস্ট সার রূপান্তর ব্যতীত এবং বর্জ্যের পুনচক্রায়ন ছাড়া ল্যান্ডফিলের উপর বর্জ্যের চাপ কমানো সম্ভব নয়।

বর্জ্যের পরিমাণ ও অবস্থা: ডিসিসির হিসাব মতে, ঢাকা মহানগরীতে দৈনিক প্রায় ৪২শ টন বর্জ্য উত্পন্ন হয়। দৈনিক ৬০০-৭০০ টন বর্জ্য অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে রিসাইকেল হচ্ছে। মাতুয়াইল সেনেটারী ল্যান্ডফিলে দৈনিক ১৬০০-২০০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। আমিন বাজার সেনেটারী ল্যান্ডফিলে দৈনিক ৮০০-১০০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। বর্তমানে ঢাকা শহরের সংগৃহীত বর্জ্য উত্স পৃথকীকরন ছাড়া ল্যান্ডফিলে অপসারণ করা হয়।

আবর্জনা-বর্জ্য থেকে কি কি হতে পারে ? ডিসিসি’র মাতুয়াইল ও আমিন বাজার ল্যান্ডফিলের বিদ্যমান স্তুপাকার কৃত অবস্থা থেকে পাইপ বসিয়ে গ্যাস উত্পাদন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা বিশেষজ্ঞরা। তৈরি করা যাবে কমপোষ্ট সার। বর্জ্য থেকে বায়োমিথেনেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুত্ ও উত্পাদন করা সম্ভব বলে তারা মনে করছেন। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি (ডিজেল) তৈরি হবে। বর্জ্য আলাদা করে পেভমেন্ট ব্লকও তৈরি করা সম্ভব হবে, যা সড়ক ও ইমারত নির্মাণে ব্যবহার করা যাবে।

আর্থিক মূল্যায়নে এর পরিমাপ? বর্জ্য কে সম্পদে রূপান্তরিত করলে বড় প্রাপ্তি হবে পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষাপাবে। বন্ধ হবে খাল-বিল ও জলাধার ভরাট। পতিত জমি ভরাট বন্ধ হবে। বর্জ্যকে রুপান্তরিত করে ব্যবহার করা গেলে এর মাধ্যমে অনেক দক্ষ ও অদক্ষ জনবলের কর্মসংস্থান হবে। ব্যবসায়ীকভাবেও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।

মাতুয়াইল সেনেটারী ল্যান্ডফিল: ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় ১৯৯৩ সালে ৫০ দশমিক ৮৩ একর জমি অধিগ্রহন করে ডিসিসি। ২০০৫ সালে ৪০ কোটি ৫ লাখ টাকায় আরও ৫০ দশমিক ৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে। পুরাতন ও সম্প্রসারিত অংশ উন্নয়ন বাবদ ব্যয় হয় ৪৭ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন বাবদ মোট ব্যয় ৯২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। বর্তমান বাজার মূল্যে মোট সম্পদের মূল্য ১২শ ৫৮ কোটি টাকা।

প্রতিদিন ১৭শ ৫০ টাকা হিসেবে এ পর্যন্ত সঞ্চিত ৪৫ লক্ষ টন বর্জ্যের মোট মূল্য ৭শ ৮৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। সর্বসাকুল্যে বর্জ্য ১৭শ ৫০ টাকা হিসেবে মোট মুল্য ২ হাজার ৪৫ কোটি ৫০ লক্ষ কোটি টাকা। বিদ্যামান অবস্থায় এ ল্যান্ডফিলে আরো ৫ বছর আবর্জনা অপসারণ করা যাবে। আমিন বাজার ল্যাল্ডফিল: ২০০৫ সালে ৫২ কোটি ২৮ লাখ একর জমি অধিগ্রহন বাবদ মোট ব্যয় ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। জমি উন্নয়ন বাবদ মোট ব্যয় ৭৪ কোটি টাকা।

জমি অধিগ্রহন ও উন্নয়ন বাবদ মোট ব্যয় ৮১ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। প্রতিটন বর্জ্য ১৭শ ৫০ টাকা হিসেবে এ পর্যন্ত সঞ্চিত ৯ লাখ টন বর্জ্যের মোট মূল্য ১শ ৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সর্বসাকুল্যে বর্জ্য ও সম্পদের মোট মূল্য ৪শ ৭১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। বিদ্যমান অবস্থায় এ ল্যান্ডফিলে আর ৭ বছর বর্জ্য অপসারণ করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্যব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, ময়লা-আর্বর্জনা রাজধানীর অন্যতম প্রধান সমস্যা।

রাজধানীর বর্জ্যেকে রিসাইক্লিং করে সম্পদে রুপান্তরের নানা সম্ভাবনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া প্রতিদিন উত্পাদিত বর্জ্য অপসারনেরও পর্যাপ্ত জায়গা নেই ডিসিসির। সিটি করপোরেশনের দুটি ল্যান্ডফিলের ধারণ ক্ষমতা শেষ পর্যায়ে। এখন নতুন ল্যান্ডফিলের জায়গা দরকার অথবা ল্যান্ডফিলের জীবন ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

এ ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগীতা দরকার বলে মনে করেন তিনি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.