শিপু চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে তিন পার্বত্য জেলা। সরকারী কর বা ভ্যাটের মতো যেন এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। চলছে প্রকাশ্যে। যে কেউ যা কিছু করতে যাক চাঁদা তাকে দিতে হবে। এই চাঁদাবাজদের হাত থেকে বাঙালীতো দুরের কথা সাধারণ উপজাতীয়রাও বাদ যায়না।
আনসার, পুলিশ, বিডিআর, আর্মি, প্রশাসন সব আছে কিন্তু চাঁদাবাজিও আছে প্রকাশ্য দিবালোকে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকেও চাঁদা দিয়ে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হয়। ব্যবসা, ঠিকাদারী এমনকি শ্রমজীবী মানুষকেও সেখানে চাঁদা দিয়ে কাজ করতে হয়। ক্ষেতের ফসল, বাড়ির পোষা মুরগীর জন্যও চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা ছাড়া কারো নিস্তার নেই।
এক কথায় পাহাড়ে বাস করতে, কাজ করতে চাইলে চাঁদা আপনাকে দিতেই হবে। না দিলে নির্যাতন, নীপিড়ন, লুঠতরাজ থেকে শুরু করে আপহরণ, খুন, ধর্ষণ যে কোনো কিছুরই শিকার হওয়া লাগতে পারে।
এইতো গত ১৬ জুন রোববার খাগড়াছড়িতে দলীয় এবং ব্যবসায়কি কাজ শেষে মাটিরাঙ্গায় একটি ব্যাংক থেকে ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করে মো: হারুন মিয়ার ভাড়ায়চালতি মোটরসাইকলে যোগে গুইমারা যাওয়ার পথে বাইল্যাছড়ি এলাকা থেকে ইউনাইটডে পিপলস ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ‘র অস্ত্রধারী উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ সময় তার কাছে নগদ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ছিল। তার সঙ্গে থাকা মোটরসাইকলে চালক মো. হারুন মিয়াকে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা।
সরকার দলীয় নেতা হওয়ার পরও সকল চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে মুক্ত করা যায়নি তাকে, শুধু মুক্তিপণের অঙ্ক তাতে কমছে মাত্র। অবশেষে গত ২১ জুন এক কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন পরিবারের মধ্যে।
কিন্তু ফিরতে পারেননি বিএনপি নেতা চাঁন মিয়া। ২০ জুন পুলিশ খাগড়াছড়ি সদররে পাঁচমাইল এলাকা থেকে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করছে। পুলিশ সূত্র মতে, বৃহষ্পতবিার রাতের যেকোনো সময় র্দুবৃত্তরা তাকে গলা কেটে হত্যা করে লাশ পাঁচমাইল এলাকায় খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা রাস্তার উপরে ফেলে যায়।
শুধু বাঙালী নয়, চাঁদার দাবীতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে এমনকি নিজ দলের উপদলীয় গোত্রে প্রায়ই লিপ্ত হয় প্রকাশ্য বন্দুক যুদ্ধে। চাঁদার স্পট দখল রাখতে পাহাড়ী সংগঠন ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস সংস্কারপন্থীরা প্রায়ই পাহাড়ে অপহরণ, খুন, বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
সেকারণে পাহড়ের লোকদেরও বলতে শোনা যায়, মুখে, জুম্ম রাষ্ট্র, স্বায়ত্তশাসন, জনতার মুক্তির কথা বললেও কার্যত এই সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি পার্টিতে পরিণত হয়েছে। আদর্শ- বই পুস্তকে, অনুশীলনে চাঁদাবাজি। সেখানে একটা চাঁদাবাজ প্রজন্ম গড়ে উঠেছে।
যারা পার্টির লেবেল লাগিয়ে এক একটি মহাল থেকে চাঁদাবাজি করে জীবন চালায়। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো অপরাধেরই বিচার না হওয়ায় চাঁদাবাজরা সেখানে বেপরোয়া, নির্ভিক। শুধু চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ ও সংস্কার গ্রুপের সশস্ত্র হামলায় চলতি বছরের গত ৬ মাসে নিহত হয়েছে ২২জন, আহত ১১ অপহরণ ২৮জন।
পাহাড়ে সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র চাঁদাবাজি। চাঁদার দাবীতে হত্যা অপহরনের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে ফলজ ও বনজ বাগানের মতো জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে দেয়া।
পাহাড়ে একসময় জনসংহতি সমিতির একক প্রভাব থাকলেও অভ্যন্তরীণ দন্দ্বে বিভক্ত হয়ে খাগড়াছড়িতে গঠিত হয় জনসংহতির এম এন লারমা গ্রুপ। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ইউপিডিএফের সাথে অনেকটা মিলেমিশে চলছে এরা। মাঝে মধ্যে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটে চাঁদার রাজ্যের আধিপত্য নিয়ে।
ভারী অস্ত্রের মজুদ নিয়ে সশস্ত্র সদস্যদের সংখ্যা বাড়িয়ে পুরো জেলার ৯০ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রনে নিয়েছে ইউপিডিএফ। আর প্রতিমাসে বিভিন্ন সেক্টর থেকে আদায় করছে কোটি টাকার চাঁদা।
চাঁদা আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে ইউপিডিএফ নেতারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বরাবর একই কথা বলেন। তারা বলেন জুম্ম জাতির আতœ নিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তহবিলে এই সহযোগিতা নেয়া হয়। (চাঁদার টোকেনের শিরোনাম জনতার মুক্তি সংগ্রামে এগিয়ে আসুন। ) একইভাবে রাঙামাটিতে জেএসএসএর রয়েছে নিরঙ্কুশ প্রভাব।
বসতভিটা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার সকল মাধ্যমে তাদের ইচ্ছেমতো বসিয়েছে চাঁদার হার।
হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া বিশাল অংকের এই চাঁদার অর্থ থেকে কখনো কোন বিপগ্রস্ত পাহাড়ী মানুষ সহযোগিতা পায়নি। ভুক্তভুগীরা বলছে ওরা এখন পাহাড়ের বিকল্প সরকার। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন জেনে শুনেও নীরব, কারণ তাদের কাছে অভিযোগকারী নেই। এদিকে নিরস্ত্র মানুষ অভিযোগ করে জীবন দিতে রাজি নই।
চাঁদা না দেয়ায় এযাবৎ অনেক নিরাপরাধ মানুষকেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের হাতে। বছরের পর বছর চলছে তাদের বোবা কান্না। মাঠ প্রশাসন থেকে সরকারের কেন্দ্রিয় পর্যায়ে বিষয়টি ওয়াকিবহাল হলেও চাঁদাবাজি বন্ধে কোন রকম উদ্যোগ নেই। চাঁদাবাজির এই সীমাহীন দৌরাতেœর কারনে প্রশ্ন উঠেছে পাহাড়ে আদৌ সরকারের কর্তৃত্ব আছে কীনা?
ভুক্তভোগীরা বলছেন চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট সংঘর্ষে রূপ নেয় এরপর অভিযোগ দেয়া হয় পাহাড়ী বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, গত জরুরী সরকারের সময় চাঁদাবাজি বন্ধ থাকলে এখন কেন সম্ভব নয়? চাঁদার নামে শোষনের শিকার বিক্ষুদ্ধ ও সাধারণ মানুষ বলছেন এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই পাহাড়ে আবারো ভয়াবহ সংঘাত হতে পারে।
তবে এই সংঘাত হবে অতীতের চেয়ে অনেক ভয়ংকর পরিনতির। কারণ এই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে সকল শ্রেনী পেশার মানুষের মাঝে।
এক সময় কিছু নির্ধারিত ব্যবসা বাণিজ্যের উপর চাঁদা আদায় হলেও এখন সর্বক্ষেত্রে এই চাঁদা বাধ্যতামুলক। অন্যথায় ধার্য্য ব্যাক্তির জানমালের উপর নিশ্চিত বিপদ। উন্নয়নকাজ, পাহাড়ের আবাদী জমি, ফলদ ও বনজ বাগান, ব্যবসায়ী, সরকারী চাকুরে, কৃষক থেকে দিন মজুর পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছেনা এই চাঁদার কবল থেকে।
ইউপিডিএফের শ্রেণীবদ্ধ চাঁদার নতুন সংযোজন বসতবাড়ী। নিয়ন্ত্রিত এলাকার উপজাতীয়দেরকেও বসতবাড়ীর জন্য বাৎসরিক চাঁদা দিতে হয়।
প্রতি ঘনফুট সেগুনকাঠ ৪০টাকা, প্রতি গাড়ী বাঁশ ১হাজার টাকা, বড় দোকান বছরে আড়াই হাজার এবং ছোট দোকান বছরে ১হাজার টাকা,তামাক প্রতি কানিতে তিনশ টাকা,প্রতিটি তামাক চুল্লি ১হাজার টাকা,ধান প্রতি কানি এক মৌসুমে ২০০ টাকা, হলুদ প্রতি কানী ৩০০টাকা থেকে ৬০০ টাকা, সবজি প্রতিকানি এক মৌসুমে ১০০টাকা, এছাড়া পরিবহন সেক্টরে ট্রাক, বাস, জীপ এবং অন্যান্য যানবাহনে মাসিক ত্রৈমাসিক, সান্মাষিক ও বাৎসরিক নির্ধারিত হারে ধার্য চাঁদা দিয়েই যানবাহন চলাচল করতে হয়। উন্নয়ন কাজের চাঁদার পরিমান শতকরা ১৫ভাগ। প্রতিটি ৫ টনের ট্রাক বাৎসরিক তিন হাজার টাকা, এবং তিন টনের ট্রাক ২ হাজার টাকা, বাস প্রতি বছর তিন হাজার টাকা, এবং জীপ প্রতি বছর ২ হাজার টাকার টোকেন সংগ্রহের মাধ্যমেই সড়কে চলাচলের পারমিট পেয়ে থাকে।
এভাবে প্রতিটি সেক্টর থেকে প্রতি বছর কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে ইউপিডিএফ। এছাড়া পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের তো একেবারেই আলদা। বিভিন্ন বাজারে সপ্তাহের হাটের দিন প্রতিটি পণ্যের উপর নির্ধারিত হারের চাঁদা দিতে হয় বাধ্যতামুলক।
এভাবেই জেলাজুড়ে চলছে ইউপিডিএফের কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের কার্যক্রম। নিরস্ত্র সাধারণ পাহাড়ী বাঙ্গালী তাদের মনে প্রাণে ঘৃনা করলেও সশস্ত্র তৎপরতার ভয়ে মুখ খুলতে একেবারেই রাজী নয়।
উপরন্তু তাদের ডাকে সভা সমাবেশে যেতে হয় অধিকারের নামে। কিন্তু আসল সত্যি বোবা হয়ে আছে। এই হচ্ছে পাহাড়ের প্রকৃত চিত্র। সাধারণ পাহাড়ী বাঙ্গালীদের প্রশ্ন সরকারের কী কোন কর্তৃত্ব নেই, এভাবে আর কতদিন ? প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রায়শঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও সরব চাঁদাবাজি ও অস্ত্রের ঝংকার আকংকিত মানুষ এখন এসব থেকে স্বস্তি পেতে চায়। তাই পাহাড়ে র্যাব মোতায়েন করে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নিতে সরকারে প্রতি পার্বত্য এলাকার সাধারণ পাহাড়ী-বাঙালী জনগণের প্রাণের দাবী হয়ে উঠেছে।
উৎস Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।