আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিবিরের আমলনামা ৪ চাঁদাবাজির অপর নাম বায়তুল মাল!

কিছুই কমু না.. ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কত ধরনের নৃশংসতা, অধার্মিকতা, কূটকৌশল আর স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ যে করে চলেছে ইসলামী শিবির, তা অনেকেই জানেন না। গত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে শিবির যে ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, তার কিছু চিত্র তুলে ধরার জন্য এ আয়োজন ‘ছাত্র শিবিরের আমলনামা’। আজ চতুর্থ কিস্তিতে পড়ুন ‘বায়তুল মাল’ নামে তাদের চাঁদাবাজি আর সিলেটে তাদের নৃশংসতা ও আধিপত্য বিস্তারের কাহিনী। ] বায়তুল মাল শব্দটি আরবি। এর অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগার।

বায়তুল মালের নামে শিবির তার সংগঠনের কোষাগারের জন্য চাঁদা তুলে আসছে বছরের পর বছর। শিবিরের চাঁদা আদায়ের রশিদে বায়তুল মাল লেখা থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যাকাণ্ডের পরপরই শিবিরের বেশ কিছু গোপন নথি উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা শিবিরের গোপন নথিপত্রে মিলেছে এসব চাঁদাবাজির নজির। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প বেতনের মালি-ঝাড়–দার থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র দোকানির কেউই।

রাবি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্র শিবির নিয়ন্ত্রিত রুমগুলোতে কয়েক দফায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ উদ্ধার করেছে তাদের চাঁদাবাজির তালিকা। শিবিরের নির্বিচার চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি ওই হলের কর্মচারীরাও। সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজির তালিকায় দেখা যায়, তারা হলের ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে নিয়মিত ধার্য করা চাঁদা তুলত। এদের মধ্যে হলের মালি জাবের ও লোকমানের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে, চান মিয়ার কাছ থেকে ১০০ টাকা, ঝাড়ুদার সাইদুরের কাছ থেকে ১০০ টাকা; প্রহরী আলাউদ্দিন, চান মিয়া, মোহাম্মদ আলী ও রাজ্জাকের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে; প্রহরী আমজাদের কাছ থেকে ৩০ টাকা; ক্যান্টিন ম্যানেজার আবুল হাশেমের কাছ থেকে ১০০ টাকা; লাইব্রেরি কর্মচারী আজহার আলীর কাছ থেকে ১০০ টাকা; ডাইনিং কর্মচারী ইসমাইলের কাছ থেকে ৫০ টাকা; গেমরুমের কর্মচারী আলী ও আশরাফের কাছ থেকে ১০০ টাকা কওে; ক্রীড়াশিক্ষক মন্টু সিংয়ের কাছ থেকে ৩০০ টাকা এবং ডাইনিং কর্মচারী হকের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেছে শিবির। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজি করেছে শিবির।

সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদা আদায়ের একটি রসিদে দেখা গেছে, তারা নানা প্রক্রিয়ায় হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা আদায় করেছে। সোহরাওয়ার্দী হলের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বাজার এলাকা। হলের আশপাশেও রয়েছে বেশকিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর দোকান। স্বল্পপুঁজির এসব ব্যবসায়ীর কাছে থেকেও নিয়মিত চাঁদা নিত শিবির। হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজির তালিকায় দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে স্টেশন বাজার এলাকার সেলুন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০০ টাকা, চা দোকানি আজিজের কাছ থেকে ১০০ টাকা, ফল ব্যবসায়ী চান মিয়ার কাছ থেকে ১০০ টাকা, হাবিব ভ্যারাইটির কাছ থেকে ৩০০ টাকা, বটতলা হোটেল থেকে ২০০ টাকা, ফটোকপি ব্যবসায়ী লিখনের কাছ থেকে ১০০ টাকা, ক্ষুদ্র দোকানি মিন্টুর কাছ থেকে ৫০ টাকা, মনোহারি দোকানি মামুনের কাছ থেকে ৬০০ টাকা এবং মোবাইল ব্যবসায়ী আনিসুরের কাছ থেকে ৫০ টাকা চাঁদা আদায় করেছে শিবির ক্যাডাররা।

এ চিত্র যে শুধু রাজশাহীতে তা নয়, প্রায় সারা বাংলাদেশে শিবির বায়তুল মালের নামে চাঁদাবাজি করছে। সিলেটে শিবিরের নৃশংসতা আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সিলেটে শিবিরের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। সিলেটে প্রথম খুনের রাজনীতিও সূচনা করে শিবির। একেবারে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির সিলেটে নিজেদের অবস্থান করে নিতে ১৯৮৮ সালের একই দিনে খুন করে জাসদ ছাত্রলীগের তিন অকুতোভয় সৈনিক মুনির, তপন ও জুয়েলকে। এই তিনজনের অপরাধ ছিল, তারা মৌলবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

জাসদ ছাত্রলীগ সিলেট শহর থেকে শিবির উৎখাতের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু শিবিরের নারকীয় তাণ্ডবলীলার কাছে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জাসদ ছাত্রলীগের দুর্গে চরম আঘাত করে সিলেটে খুনের রাজনীতির শুরু ও নিজেদের অবস্থান করে নেয় শিবির ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। একদিনেই জাসদ ছাত্রলীগের নিবেদিতপ্রাণ মুনির, তপন ও জুয়েল এই তিন কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই সময়ে শিবিরের তাণ্ডবে সিলেট নগরীতে আহত হন অনেকেই।

১৯৯৮ সালের ২৪ মে শিবির হত্যা করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে। শামসুদ্দিন ছাত্রাবাসে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হলে শিবির ক্যাডাররা নগরীর ব্লু বার্ড স্কুলের সামনে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে সৌমিত্রকে। হামিদ আহমদ খান দোয়েল নামের এক ছাত্রদল কর্মীকে ২০০২ সালে ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের মদনমোহন কলেজের ক্যাম্পাসে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের ঘাতকরা। সিলেট ভেটেরিনারি কলেজের মেধাবী ছাত্র রফিকুল হাসান সোহাগকে ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট নৃশংসভাবে খুন করে শিবির ক্যাডাররা। সোহাগ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন এবং কলেজ ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

এই ছয় খুনের জন্য শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেও কারো কোনো সাজা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুনিরা আজ ব্যবসা করে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়ার কারণে শিবির সিলেটে বেপরোয়াভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সিলেটের যেসব জায়গায় শিবিরের ঘাঁটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সিলেটের শিবির ক্যাডাররা বহাল তবিয়তে আছে। তাদের সাংগঠনিক কাজও ঠিকমতো চলছে।

সিলেট শহরে শিবিরের প্রধান ঘাঁটি হচ্ছে নগরীর পায়রা আবাসিক এলাকা ও আলিয়া মাদ্রাসা। পায়রা আবাসিক এলাকায় অনেক জামায়াত-শিবিরের নেতা বাস করে। অভিযোগ আছে, এখান থেকে মারামারি করার জন্য শিবিরের অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। পায়রা আবাসিক এলাকার বেশ কয়েকটি বাসাকে মেস হিসেবে ব্যবহার করে শিবির তাদের ক্যাডারদের এসব মেসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এছাড়া হত্যা বা অন্য কোনো বড় ধরনের হামলা-হাঙ্গামার সাথে জড়িত শিবির ক্যাডাররা পায়রা আবাসিক এলাকায় এসে জামায়াত নেতাদের বাসায় আত্মগোপন করে থাকে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ আন্দোলনে শিবিরের ক্যাডারদের হাতে প্রকাশ্যে পায়রা আবাসিক এলাকা থেকে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হয়। এককালে চট্টগ্রামের শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ও নাসির বিভিন্ন অপরাধ করেই সিলেটে পায়রা আবাসিক এলাকার জামায়াত-শিবিরের বাসাগুলোতে এসে অবস্থান নিত। সিলেটে শিবিরের যত সন্ত্রাসী আছে তার অর্ধেক বাস করে পায়রা আবাসিক এলাকায়। এরা শিবিরের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্রদের ওপরে শিবির যেসব হামলা চালায় সেগুলো পরিচালনা করে থাকে। আলিয়া মাদ্রাসা হচ্ছে সিলেটে শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্ট।

এখানে শিবির সদস্যদের মারামারি ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীর মদিনা মার্কেটের ধানসিঁড়ি, পল্লবী এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) পূর্ব পাশে ধামালিপাড়ায় শিবিরের বড় তিনটি আস্তানা আছে। বিডিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টারের দ্বিতীয় গেটের বিপরীতে একটি কটেজ, আখালিয়া নয়াবাজারের দুটি বাসা, শাবি গেটের বিপরীতে একটি বাসা, শাবি দ্বিতীয় হল সংলগ্ন একটি বাসা, আখালিয়া সুরমা আবাসিক এলাকা, সুবিদবাজার পল্লবী আবাসিক এলাকার একটি টাওয়ার, আখালিয়াস্থ যুগীপাড়া, শাবির পেছনে দুটি মেসে শিবির নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলেছে। এই আস্তানাগুলো মূলত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০ সালের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিলেটে শিবিরের ৭৫০ সাথী ও প্রায় ২০০ কিলার রয়েছে।

এরা যে কোনো সময় সংগঠনের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে। আগামী কিস্তিতে পড়ুন : সাধারণ পরিবারের ছেলেরা কেন শিবির করছে * শিবিরের আমলনামা ৩ * শিবিরের আমলনামা ২ * শিবিরের আমলনামা ১ বিডিনিউজ২৪.কম ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.