আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকার ভাগ্যে কি আছে ?

১৬০৮ থেকে ২০১২। আজ ৪০০ বছরে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে পত্তন হওয়া এ শহর দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কালের স্রোতে। অষ্টাদশ শতকে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঢাকা এবং বিশ্বসেরা শহরের ক্রমসংখ্যায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বাদশ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এক সময় কল্পিত তিলোত্তমা হিসেবে এ শহর স্থান করে নেয় জনমনে।

তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংযমি না হওয়ার কারণে অব্যাহত অপরিকল্পিত নগরায়নের বলি হয়ে সেই তিলোত্তমা আজ একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। কালের বিবর্তনে এই ঐতিহাসিক, বিখ্যাত নগরী এখন হয়ে পড়েছে বসবাসের অনুপযোগী। হয়তো ৪০০ তেই চিরতরে শেষ হয়ে যেতে পারে তিলোত্তমা ঢাকার গর্বিত যাত্রা। অন্যদিকে বড় মাত্রার একটি ভূমিকম্পসহ অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগও যেকোন সময় থামিয়ে দিতে পারে ঢাকার চাকাকে। ভয়াবহ দূর্যোগের আশঙ্কা : ধারণা করা হচ্ছে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকায় লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটবে।

ভেঙ্গে পড়বে প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ীঘর। অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। ঢাকা যে অধিকমাত্রায় ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকা তা ইতোমধ্যে অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেও ৫ এবং ৬ মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে রাজধানীতে। ভূমিকম্প নিয়ে বহুদিন আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা নানারকম সতর্কবানী দিয়ে আসলেও তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি।

এখনও পর্যন্ত রাজধানীতে অননুমোদিত নকশা এবং নিুমানের নির্মানসামগ্রী ব্যবহার করে ভবন নির্মাণের প্রবণতা কমেনি। বরং বেড়েছে। ভূ-কম্পন প্রতিরোধক ভবন নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হলেও তা করা হচ্ছে না। ভবন তৈরীতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করা হচ্ছেনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।

রাজধানীর একেকটি ভবন গড়ে উঠছে একেকটি মৃত্যুফাঁদ হিসেবে। এ অবস্থায় শুধু ভূমিকম্পই নয়। বড় রকমের ঝড়েও অনেক ভবন ধসে পড়তে পারে। এর নজিরও মিলেছে। ঝড় না হতেই এমনিতেই রাজধানীর অনেক ভবন ইতোমধ্যে ধসে পড়েছে নরম ভিত্তির কারণে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকার বেশিরভাগ বাড়িঘরই ভূমিকম্প প্রতিরোধক নয়। এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই বুঝা যায়। অপরিকল্পিত কর্মকান্ড ঢাকাকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। নির্মাণ বিধিমালা না মেনে দুর্বল অবকাঠামো তৈরি, অপরিসর রাস্তা, খালবিল ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ ইত্যাদি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেবে। আরেকটি বিষয় ঢাকার জনজীবনের জন্য আত্মঘাতী।

তা হলো, অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। রাজধানীতে এখন প্রতিদিন ২০০ লিটারেরও বেশি পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই উত্তোলন করা হয় ভূ-গর্ভস্থ থেকে। অন্যদিকে নগরীর অধিকাংশ জলাশয় ভরাট করায় ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করতে পারছে না আগের মত। ফলে প্রতিবছর পানির স্তর নেমে যাচ্ছে তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত।

তিন মিটার করে ধরলেও গত ১০ বছরে পানির স্তর কমপক্ষে ৩০ মিটার নীচে নেমে গেছে। অর্থাৎ ভূগর্ভের এই ৩০ মিটারে কোন পানি না থাকায় তা শুন্য রয়েছে। এ অবস্থায় বড় মাত্রার ভূ-কম্পনের ক্ষয়-ক্ষতি হবে আরও ভয়াবহ। শুধুমাত্র রাজধানীর পুরান ঢাকাতেই যে ক্ষতি হবে, তা হবে অনেক বেশি ভয়াবহ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ৫০ থেকে আড়াইশ’ বছরের পুরনো অনেক ভবন রয়েছে যেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন বড় মাত্রার ভূকম্পনে যেকোন সময় তছনছ হয়ে পুরান ঢাকায় মৃত্যুর মিছিল হবে। দীর্ঘদিন থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর রশি টানাটানি ও নানাবিধ জটিলতায় আজও ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব হয়নি পুরান ঢাকাকে। এ এলাকার অধিকাংশ ভবনেরই পলেস্তরা খসে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাঁশ দিয়ে কোনমতে ছাদ ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। দেখলে মনে হয় জোরে বাতাস উঠলেই বুঝি ভেঙ্গে পড়বে।

একেতো বয়সের ভারে ন্যূজ, এর ওপর সেগুলোর উচ্চতা আরো বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেগুলো। এমন অনেক ভবন আছে, যেগুলোর অভ্যন্তরভাগ সুরঙ্গ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এরপরেও সেখানে ঝুঁকি নিয়েই বাস করছে মানুষ। ২০০৪ সালের ৯ জুন শাঁখারীবাজারে এমনি একটি ভবন ধ্বসে ১৯ জন মারা যায়।

এরপর তাঁতীবাজারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের পলেস্তরা খসে আহত হয় ৭ ছাত্র । এভাবে পুরান ঢাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো নিয়ে ডিসিসি থেকে দুই দফা সার্ভের পরে এ পর্যন্ত মাত্র ৫/৬ টি স্থাপনাকে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব স্থাপনা ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং অবিভক্ত ডিসিসি (বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) এ বিষয়ে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি।

প্রতিষ্ঠান দুটি এ বিষয়ে একে অপরের প্রতি দোষারোপ করে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরোধে যেমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি দূর্যোগ মোকাবিলার জন্যও নেই কার্যকর উদ্যোগ। দূর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাও কাজ করছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু কি কাজ করছে তা আর দেখা যায় না।

সুযোগ থাকলেও ঢাকার ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধক করা হচ্ছেনা। দূর্যোগ মোকাবিলার জন্যও নেই কোন প্রস্তুতি। এজন্য ঢাকায় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূ-কম্পন মানে ঢাকাবাসীকে প্রকৃতির হাতে সপে দেয়া। কিছুই করার থাকবে না। মূহুর্তেই ৪ শতকের ঢাকা শেষ হয়ে যেতে পরে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে।

পরিবেশ বিপর্যয় : পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকার নদী ও খালগুলো রক্তনালির মতো। ঢাকা শহরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খালগুলোকে সচল রাখা প্রয়োজন। খাল, নালা, বিলসহ বিভিন্ন জলাভূমি ও প্লাবনভূমির অস্তিত্ব বিলোপ হলে রাজধানীর পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। সৃষ্টি হতে পারে বিপর্যয়। এ আশঙ্কা থেকেই রাজধানীর জলাভূমি রক্ষায় কালে কালে নানা আইন ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কিন্তু সেগুলো থেকে গেছে কাগজে-কলমেই। মহানগরীর মহাপরিকল্পনা ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান (ড্যাপ) করার পর সরকারের দিক থেকেই উচ্চস্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল-রাজধানীতে আর কোন খাল-জলাশয় কিংবা নদী দখলের সুযোগ নেই। যারাই দখল করার চেষ্টা করবে, তারা যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের এ ঘোষণা শেষ পর্যন্ত ঘোষণাই থেকে গেছে। কোন কাজেই আসেনি ড্যাপ।

সরকারের কড়া ঘোষণা এবং ড্যাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনও নির্বিচারে চলছে রাজধানীর নদী, খাল ও জলাশয় দখলের দৌড়াতœ্য। খাল, লেক ও জলাশয় দখল করে বালু ভরাট করে ফ্ল্যাট ও প্লট ব্যবসা চলছে। হাউজিং কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রাজউকও একই কাজ করছে খাল-জলাশয় ভরাট করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে নিরব ভূমিকা পালন করছে। অব্যাহতভাবে খাল-জলাশয় দখলের ফলে ঢাকায় পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।

আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য এক পঁচা নগরীতে পরিণত হতে চলেছে ঢাকা। খাল ও জলাশায় ভরাট এবং অপরিকল্পিত নগরায়নই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে গত চার দশকেও ওয়াসা কোন সমাধানে আসতে পারেনি। উল্টো দিনের পর দিন রাজধানীর খালগুলো ওয়াসার হাত ছাড়া হয়েছে।

আর ওয়াসার ঘাড়ে ভর করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় উন্নত সুয়্যারেজ ব্যবস্থাপনার নামে কিছু দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার, পরিকল্পনাবিদের সহয়তায় প্রবাহমান খালগুলোকে ইট কংক্রিটের আড়ালে বন্দী করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ঢাকার চারদিক ঘিরে তৈরি যে বৃত্তাকার নৌপথটি রয়েছে তা অকার্যকর থাকার অন্যতম কারণ শুধুমাত্র খালগুলোর সঙ্গে সংযোগ না থাকা। কারণ আশেপাশের মানুষের গন্তব্য বা চাহিদা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহরের মধ্যে। যদি নদীর সাথে খালের সংযোগ স্থাপন করা না যায় তাহলে বৃত্তাকার নৌপথ ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেনা। বিশেষজ্ঞদের মতে খাল ও জলাশয় উদ্ধার বা সংস্কার কেবল মহানগরীর পানি ও বর্জ্য চলাচলের জন্যই নয়, জলাবদ্ধতা সমস্যা ছাড়াও জলাশয়বিহীন রাজধানী এই জনপদ ও জনজীবনের জন্যই বিপদের কারণ হয়ে উঠবে।

দেখা দেবে নানাবিধ প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ঢাকার পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করেছেন তারা। জনসংখ্যার চাপ ও নিুমানের নাগরিক সেবা : অতীতের তুলনায় ঢাকা বর্তমানে বেড়েছে অনেক গুনে। আশেপাশের শহরগুলির সমন্বয়ে আবির্ভাব হয়েছে বৃহত্তর ঢাকার।

পাশাপাশি জনসংখ্যা বেড়েছে লাগামহীনভাবে। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ঠিক কত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে দেড় কোটি। কারও কারও ধারণা দুই কোটি কিংবা তার চেয়েও বেশি। একেতো জনসংখ্যার বাড়তি চাপ অন্যদিকে সর্বত্র পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। এই দুইয়ে মিলে বর্তমানে যে অবস্থা তৈরী হয়েছে, তাতে ঢাকাকে আর কোনভাবেই বাসযোগ্য নগরী বলা যায় না।

নাগরিক সেবা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থাই এ সত্য প্রমাণ করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাগরিক সেবার মানও না বেড়ে দিনকে দিন কমেছে। দিন যত যাচ্ছে অবস্থা আরও ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে। ঢাকাকে নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবেই এমনটা হয়েছে-অহরহ এ কথা উচ্চারিত হলেও তা কেবল কথার কথাই থেকে গেছে। আদতে কোন কাজ হয়নি ঢাকাকে বাঁচাতে।

যাওবা হয়েছে, তার বেশিরভাগই লোক দেখানো কিংবা দূর্নীতিবাজদের পকেট গরম করা ছাড়া আর কিছুই নয়। শেষ বিচারে এ আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে যে, শিগগির পতিত নগরে পরিণত হতে যাচ্ছে ৪০০ বছরের গরবিনী ঢাকা। এ দায় কার? দায় যারই হোক বড় সত্য এটাই-আমরা আমাদের প্রিয় শহর ঢাকাকে হারাতে বসেছি। কি করছে ঢাকা পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো: এখন দেখা যাক সেবাদানকারী সংস্থাগুলো কি করছে। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে নগরবাসীকে যথাযথ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা-সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর দাবির বিপরীতেও তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ (উত্তর ও দক্ষিণ) রাজধানী ঢাকার দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর যুগ যুগ ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা নাগরিক জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য করতে পারেনি। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাও এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। সংস্থাগুলো যদি আন্তরিক হতো, বিদ্যমান সামর্থ্য দিয়েও ভালো কাজ করা সম্ভব হতো। ৭৫ লাখ মানুষ ধারণক্ষম ঢাকায় বাস করছে দেড় কোটিরও বেশি। পানি, বিদ্যুত, গ্যাস এবং সড়ক ব্যবস্থার ওপর বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা মহানগরী।

যানজট,ফুটপাত দখল, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা, গ্যাসের সরবরাহে অব্যবস্থাপনা, বিদ্যুত বিভ্রাটসহ হাজারও সমস্যা নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। অথচ ১৯ মন্ত্রণালয়ের ৫২ সংস্থা রয়েছে নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা দেখভাল করার জন্য। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের বদলে চরম বিভাজন বিরাজমান। মহানগরের জনগণ যখন পানি, বিদ্যুত, জলাবদ্ধতা এবং পরিবহণ সমস্যাসহ ননাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়, সংস্থাগুলোর এই সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ থাকলেও অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। সংস্থাগুলোর মধ্যে জাতীয় সংস্থা রয়েছে ৬টি, খাতওয়ারি সংস্থা ৩৪টি, ঢাকা মহানগরের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্থা ৫টি এবং স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা রয়েছে ৭টি।

জাতীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনা কমিশন, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিনিয়োগ বোর্ড, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ইত্যাদি। খাতওয়ারি সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে গণপূর্ত বিভাগ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ইত্যাদি। বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজউক, ওয়াসা, ডেসা, ডিটিসিবি ইত্যাদি। স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন কাউন্সিল ইত্যাদি। সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক এলাকা হচ্ছে ৩৬০ বর্গকিলোমিটার।

আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ঢাকা মেট্রোপলিটান এলাকার আয়তন এক হাজার ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে রাজউকের আওতাধীন এলাকা রয়েছে এক হাজার ৫৯০ বর্গমাইল। রাজধানীর দেখভালের প্রধান দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা ঢাকা সিটি করপোরেশন (বর্তমানে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন)। এ সংস্থার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা নেই । পাশাপাশি রয়েছে সংস্থার লোকদের অনিয়ম-দূর্নীতির আয়োজন।

এ সংস্থার যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে, বলা হয়ে থাকে তার চেয়েও বেশি অপব্যবহার করে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশেষ করে এ সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর (ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল) মধ্যে কোন সমন্বয় নেই, নেই কোন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কও। পারস্পরিক বিভাজনের ফলে প্রায়ই একেক সংস্থা বিভিন্ন কাজের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকে। যেখানে নাগরিক সেবার জন্য একটি সংস্থা অপর সংস্থাকে সহযোগিতা করার কথা, সেখানে এক সংস্থার কাজে অন্য সংস্থা প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকা শহরের অঞ্চল-পরিধি নিয়েও রয়েছে এসব সংস্থার মধ্যে বিভাজন।

সংস্থাগুলো নিজেদের মত করে তাদের পরিধি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নগরবাসী বরাবরই বঞ্চিতই থাকছে। পানি, গ্যাস, বিদ্যুত সংকট যেকারণে নগরবাসীর নৈমিত্তিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি যানজটসহ নানাবিধ যন্ত্রণায় নাগরিক জীবন একেবারে বিষময় হয়ে উঠেছে ঢাকাবাসী কাছে। সবাই মানছে এখানে বসবাসের কোন পরিবেশ নেই।

তবুও কেন এত মানূষ ঢাকায়? সহজ উত্তর- দায়ে পড়ে। বিশে¡র সব বড় শহরেই একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনা কর্তৃপক্ষ থাকে। সেই কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে নগর পরিচালনার সার্বিক ক্ষমতা। কিন্তু ঢাকা শহর এক অর্থে অভিভাবকহীন। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা অনেক কম।

তবে আন্তরিকতা ও সেবাদানের সদিচ্ছা থাকলেও এই সীমিত ক্ষমতা দিয়েও নাগরিক সেবা দেয়া যায়। অন্যদিকে রাজউক অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক। সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলেও সেখানেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকায় একই অবস্থা তৈরী হয়েছে। আর ওয়াসা-ডেসাসহ অন্য সংস্থাগুলোতো অনেকটা জনগনের নাগালের বাইরেই বলা চলে। আশা ফুরিয়ে যায়নি : এত কিছুর পরেও এখনও আমাদের প্রিয় শহর ঢাকাকে বাঁচানোর আশা শেষ হয়ে যায়নি।

কারণ এ শহরকে বাঁচানোর জন্য এখনো অনেক সম্ভাবনার জায়গা আছে। সেই সম্ভাবনার জায়গাগুলোকে আরও জাগিয়ে তুলতে হবে। তবে সবার আগে বর্তমান ধ্বংসাতœক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতাকে বন্ধ করতে হবে। সরকারের দিক থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন সময়েই নানামূখী কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে। যদিও ঠিক ঠিকমত সেসব আশ্বাস বাস্তবায়ণ হচ্ছেনা, তারপরেও একটা আশার জায়গা তৈরী হয়েছে খুব স্বাভাবিকভাবে।

আর সরকারের এ কথাসর্বস্ব এসব ঘোষণাও ঢাকাবাসীর ঢাকা বাঁচানোর তীব্র চাওয়াকেই প্রমাণ করে। ঢাকাকে বাঁচাতে সবার আগে যা করতে হবে, তা হলো --------------- * প্রথমত নীতি নির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। * উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতে হবে। * চলমান প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক এবং জনগনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে-এমন পরিবর্তন আনতে হবে। * অনেক খারাপের মাঝেও ক্ষুদ্র হলেও ভালো পরিবর্তনগুলোকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে পরবর্তি পদক্ষেপ নিতে হবে।

* আর ঢাকা বাঁচাতে ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ণ করতেই হবে। * সর্বোপারি জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ঢাকা রক্ষার আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।