‘রাবিশ’- এই একটি শব্দ অনেক বাঙালীর হাসিমুখ মলিন করে দিয়েছে। সবাই ভাবছিলেন, বাংলাদেশ আমেরিকার ৫১তম রাজ্য হতে না পারুক, জানি দোস্ত তো হয়ে গেল। এখন আর বাংলাদেশকে পায় কে! ব্যবসায়ীরা টাকার স্রোতে ভেসে যাবেন, যে কোন বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঙালীকে সাদর অভ্যর্থনা জানান হবে, হয়ত ভিসাও আর লাগবে না। আপনি ভাবছেন, অতিশয়োক্তি করছি। বিন্দুমাত্র না।
আজ যদি আমেরিকা বলে দ্বার খুলে দিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে যারা আসবে তারা আমেরিকান সিটিজেন। প্রায় ১৬ কোটি বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দেবে। ইসলামী হুকুমত কায়েম যাঁরা করতে চান খুন, ধর্ষণ ও লুটের মাধ্যমে সেই গোলমাল আযম ও মতি নিজামীর পুত্ররাও ঐ নাছারার দেশে বসবাস করেন, সৌদি আরবে নয়। রাজনীতিবিদ, গার্মেন্টস মালিক, আমলাদের পুত্র কন্যারা তো অনেক আগেই সেখানে।
হয়ত লেফটিদেরও।
কিন্তু ঐ ‘রাবিশ!’ একটি শব্দই বোধহয় সব শেষ করে দিল। আমাদের প্রিয় অর্থমন্ত্রীর প্রিয় শব্দ ‘রাবিশ’। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য শুনলে বোঝা যায় ঝানু রাজনীতিবিদ ও কম রাজনীতিবিদের পার্থক্য। ঝানুরা এমন সব বক্তব্য রাখেন যার কোন অর্থ হয় না।
ম্যাডাম হিলারি অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ওয়াশিংটন থেকে তিনি বিষয়টি মনিটর করবেন। এই উক্তি ড. ইউনূস, তাঁর ভক্তদের [গ্রামীণ ব্যাংকের নয়] উল্লসিত করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু, কারও কি মনে হচ্ছে না, এ ধরনের উক্তি ঐ পর্যায়ে করা যায় না। ড. ইউনূসও করেননি। এবং এ ধরনের উক্তি একটি দেশ বা জাতিকেও অপমান করে।
অনেকে এও বলতে কসুর করবেন না যে ড. ইউনূস ইচ্ছাকৃতভাবে দেশটির সরকার ও মানুষকে ধমক দেয়াচ্ছেন। এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, আমাদের লেফটি ব্রাদাররাও এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি, যদিও তাঁরা হিলারির আগমন উপলক্ষে কয়েকজনের মিছিল, বিবৃতি দিয়েছিলেন। মনে মনে হয়ত লেফটিরাও চান, আমেরিকা দোস্ত হলে তাদের পরিবার পরিজন ও সন্তানদের নিউইয়র্ক চলে যাওয়া সহজ হবে। এক কথায়, সুধীজনদের ধারণা, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছিল, আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি মন্তব্য তা ধূলিসাত করে দিয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব মুহিত বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে হিলারির বিবৃতির কোন যুক্তি নেই।
উনি বলেছেন ওনার কথা। গ্রামীণ ব্যাংক সরকার দখল করবেÑ এমন অভিযোগ রাবিশ। আমি দুঃখিত যে রাবিশ শব্দটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমাকে রাবিশই বলতে হচ্ছে। ’ [প্র. আলো, ৯.৫.২০১২]
আমার কাছে মনে হয়েছে, হিলারি যা বলছেন তা অনাকাক্সিক্ষত।
এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ও কূটনৈতিক দৃষ্টিতে অনাকাক্সিক্ষত মনে হলেও তার মধ্যে অপমানের একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা আছে। সেটি প্রশংসনীয়। কিন্তু, এটা কি ঠিক নয়, ম্যাডাম হিলারির আগমন এই সরকারকে উল্লসিত করেছে? এটিকে তারা তাদের নীতির বিজয় বলে মনে করছে। এবং সবাই জানে, আমেরিকা এভাবেই কথা বলবে এবং তা শুনে যেতে হবে। যদি শুনতে না চান তা’হলে হিলারিকে নিয়ে এত মাতামাতির দরকার ছিল না।
এত কাঠখড় পোড়ানোর দরকারও ছিল না। তারা কি জানতেন না এ প্রসঙ্গ আসবেই। হিলারির চেয়ে পদমর্যাদায় ওপরে এবং যে দেশটি ও দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি করেছে বাংলাদেশের জন্য এবং এখনও যে দেশই সবচেয়ে বড় দাতা সেই জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তো সরকার, মিডিয়া, সুজনরা এত আলোড়িত হয়নি। আমার মনে হয় বরং অর্থমন্ত্রী যদি বলতেন, ব্যাংক অব আমেরিকা ঠিকমতো চলছে না। এ নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে।
আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংক অব আমেরিকার কার্যকলাপ মনিটরিং করব তা’হলে রাবিশের মতো কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে হতো না। হিলারিরাও বুঝতেন যে তাঁদের বক্তব্য যা তারা মনে করছেন যথার্থ আসলে কত এ্যাবসার্ড। বাংলাদেশ হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুকে এ ধরনের অনেক কথা শুনতে হয়েছে এবং তিনি হাসিমুখে এমন সব মোক্ষম জবাব দিয়েছেন যে দ্বিতীয়বার সেসব প্রসঙ্গ আর রাজা বাদশাহ প্রেসিডেন্টরাও তোলেননি। আমাদের ন্যাতারা যত বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করেন তত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পড়েন কিনা সন্দেহ। একটি উদাহরণ দিই।
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াকুব গাওয়ান বললেন বঙ্গবন্ধুকে, ‘অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙ্গে দিতে গেলেন। ’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়ত ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়ত শক্তিশালী ছিল। তার চেয়েও শক্তিশালী হয়ত অবিভক্ত ভারত।
কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়। ’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্মারকগ্রন্থ/১ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ]
যা হোক অর্থমন্ত্রী ঐ ধরনের মন্তব্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে করতেই পারতেন। মতিয়া চৌধুরী মাইকের সামনে থাকলে, বিরোধীদের প্রসঙ্গ উঠলে যে প্রবলভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে যান তিনিও কিন্তু কবির আবৃত্তি করার ভঙ্গিতে বলেছেন, মার্কিন উচ্চ আদালত একটি রায় দিলে কি হিলারি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন? আমরা অন্য একটি দেশ, আমাদের আদালত একটি রায় দিয়েছে। সেটি নিয়ে অন্য দেশের মন্ত্রী কিভাবে প্রশ্ন তোলেন? কারণটা একই।
গরিবের সুন্দরী স্ত্রী দেখলে সবাই ভাবি বলে চান্স নিতে চায়। বাংলাদেশ এখন গরিবের সুন্দরী স্ত্রীÑ এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। আমেরিকার প্রিয় তো আমরাই হতে চাই। আমেরিকা কি চেয়েছে? ১৯৭১ সালে চায়নি। কিন্তু আমরা হচ্ছি নাছোড়বান্দা প্রেমিকা।
বরং আমাদের আইনমন্ত্রী যদি বলতেন, বুশ-গোর নির্বাচনে মার্কিন সুপ্রীমকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা পক্ষপাতমূলক। বাংলাদেশ তা মানে না। সুপ্রীমকোর্টের এই কার্যাবলী বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করবে।
আমাদের একটি পথ বেছে নিতে হবে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক প্রতিদিনই তো চড়চাপড় দিচ্ছে বাংলাদেশকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা দ্বিমত প্রকাশ করলেও তো অর্থমন্ত্রী বলছেন, বার বার, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না।
’ এই মনোভঙ্গি এবং হিলারিকে ধমকানো দুটি পরস্পর বিরোধী। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যে এত টানাপোড়েন তার একটি প্রধান কারণ অর্থ মন্ত্রণালয়। যদি তারা গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণ না চান তাহলে দ্রুত সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল এবং আইন বা কাঠামো বদলে যাঁরা চালাতে পারবেন তাঁদের দেয়া উচিত ছিল। যে ৫৪টি কোম্পানির কথা অর্থমন্ত্রী তুলছেন তার নিষ্পত্তি এতদিন কেন করেননি অর্থমন্ত্রী? সেই প্রশ্ন কিন্তু আমাদের থেকে নয়, তাঁর দল ও নীতি নির্ধারকদের থেকেও উঠছে যার খোঁজ তিনি জানেন না। অর্থ মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টি লেজেগোবরে করে ফেলেছে, যা পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও অভিঘাত সৃষ্টি করছে।
ড. ইউনূস আর যাই হোন বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের মতো অদক্ষ নন।
অর্থমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য তিনি সেই সব চামচাদের বিশ্বাস করেন যারা তাকে ছোট করে। ড. ইউনূসের সৌভাগ্য, তাঁর চামচারা তাঁকে ক্রমেই বড় থেকে বড় করে তোলেন।
হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসতে চাননি।
কিন্তু, আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাধ্যতা সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও শেখ হাসিনা। সে বিষয়ে পরে আসছি। হিলারি পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারী দেশটির রাজনীতির একজন তারকা দুই যুগ ধরে। ওবামা থেকে বেশি লোক তাঁকে চেনে।
কোকাকোলার মতো একটি ব্র্রান্ড নেম। ড. ইউনূস ঐ পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধু। ক্লিনটন ইনিসিয়েটিভে বাংলাদেশ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক বা ফাউন্ডেশনও দিয়েছে বলে শুনেছি। যদিও টাকার অঙ্কটা জানা যায়নি, বন্ধুত্ব ও অনুদান দু’টি মিলে বাংলাদেশ থেকে ড. ইউনূস বেশি গ্রহণযোগ্য ক্লিনটন পরিবারে।
সেই ইউনূসের অপসারণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে অপমান হিসেবে নিয়েছেন হিলারি। আমাদের ভুললে চলবে না হিলারি একজন মহিলা। আমাদের মহিলাদেরও তো দেখেছি। ব্যক্তিগত জেদ বা আবেগ অনেক সময় রাষ্ট্রীয় নীতিকেও পরিচালিত করে। জনাব মুহিত ঠিক বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংক গঠনে, পৃষ্ঠপোষকতায় তো আমেরিকা একটি সেন্ট দেয়নি।
তাহলে এ বিষয়ে তাদের বলার অধিকারও তো নেই। কিন্তু হিলারির জেদের রাডারে সেটি ধরা পড়ছে না। তবে, মার্কিন প্রশাসন হিলারির সঙ্গে একমত এটি ভাবার কোন কারণ নেই। রাজনৈতিক কারণে বা আসন্ন নির্বাচনের কারণে তারা হিলারির জেদ মেনে নিচ্ছে। হিলারি না থাকলে এ বিষয়ে তারা আদৌ মাথা ঘামাবে কিনা সন্দেহ।
মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট প্রয়োজনে এদের সবাইকে ঝেড়ে ফেলবে। তারা ব্যক্তিস্বার্থ ও দেশের স্বার্থ আলাদা হিসেবে বিবেচনা করে। হিলারি দেশ ও ব্যক্তিস্বার্থ এক করে ফেলেছেন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেভাবেই হোক হিলারি ম্যাডামকে একবার নিয়ে আসা ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বন্দোবস্ত করা। সেটি হয়নি।
ড. ইউনূস ইস্যু সৃষ্টি হওয়ায় হিলারি ঢাকা আসা দূরের কথা বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য মাধ্যমে যতটা পারা যায় বাংলাদেশকে শিক্ষা দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। এবং পরিষ্কার ভাষায় বলছেন, বাংলাদেশ কিছু চাইলে ড. ইউনূসকে নিতে হবে। বাংলাদেশ রাজি হয়নি, হিলারিও পাত্তা দেননি। বাংলাদেশ এখনও সেই বিনিময়ে রাজি নয়, কিন্তু হিলারি কেন আসতে বাধ্য হলেন?
ভারত-মার্কিন স্বার্থ এখন অভিন্ন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একটি কাজ করেছেন যা বাংলাদেশের কেউ করেনি।
করার সাহসও পায়নি। তাহলো উগ্র মৌলবাদ জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসবাদ দমনে সচেষ্ট হয়েছেন। শুধু তাই নয়, দু’টি দেশের কাছেই এই বিষয়টি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন যে, তার সরকার এই ধরনের সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসে জেরবার, ভারতও। ভারতের প্রতিরক্ষা খরচ অনেক কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছু দিতেও চেয়েছিল। পারেনি কেননা কেন্দ্রীয় সরকার খুবই দুর্বল। যদি সেখানে কোয়ালিশন সরকার না হতো বা বাংলাদেশের মতো কোয়ালিশন সরকার হতো যেখানে শরিকদের কিছু বলা বা করার সুযোগ নেই তাহলে ভারত সরকার তার প্রদত্ত অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারত। আমেরিকাও বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাস দমন নীতির কারণে খুশি। শুধু তাই নয়, মার্কিন নীতির ক্ষেত্রে একটি মৌল পরিবর্তন আনতে পেরেছেন শেখ হাসিনা তাহলো, মৌলবাদী দলসমূহ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদল।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের প্রধান শত্রু জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে উল্লেখ করত। আমার মনে আছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এক মার্কিন কূটনীতিবিদের সঙ্গে আমাদের কয়েকদলের বসার আয়োজন করা হয়েছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিল তারা বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন করতে যাচ্ছে। একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, মার্কিন মুখপাত্র বলুক, তারা এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং গণতান্ত্রিক সেক্যুলার শক্তির উত্থানই কামনা করে। তারা রাজি হয়নি। এমন কি জামায়াতকে ফান্ডামেন্টালিস্ট বলতেও রাজি হয়নি।
ঐ সময় শাহরিয়ার কবির, বিশেষ করে গত এক দশকে যুদ্ধাপরাধ ও জামায়াত বিষয়ে মার্কিন বিচার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সুধী সমাজে প্রচুর লবিং করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। তাদের বিশ্বাস জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক দল যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর একটা কারণ বোধ হয় এই যে, আমেরিকা ১৯৭১ সালে পাকি ও জামায়াতীদের গণহত্যা সমর্থন করেছিল। অনেক পরে অবস্থার একটু উন্নতি হলোÑবাংলাদেশকে তারা মডারেট ইসলামিক স্টেট হিসেবে স্বীকৃতি দিল।
আর জামায়াতকে মডারেট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক দল হিসেবে। এক মার্কিন কর্মকর্তার কাছে আমেরিকাকে মডারেট ক্রিশ্চায়ন স্টেট বলার পর তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছিলাম। যা হোক, শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে আমেরিকা খুব একটা বাধা দেয়নি। বোঝা যাচ্ছিল, তারা তাদের মনোভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। এ বছর তা সম্পূর্ণ পাল্টিয়েছে।
আগে জামায়াতী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত, তাদের পক্ষে রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতিও দিতেন। ‘কিন্তু এ বছরের ৬ মার্চ সর্বশেষ সম্পাদিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিষয়ক ব্যাকগ্রাউন্ড নোট’-এ জামায়াতকে একটি ইসলামী মৌলবাদী (ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্ট) দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাছাড়া সম্প্রতি কয়েক বার জামায়াতের পক্ষ থেকে বর্তমান ঢাকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনার সঙ্গে দলীয় নেতাদের সাক্ষাতের কথা প্রচার করা হলেও জামায়াত কার্যালয়ে যাননি মজেনা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নানা পর্যায়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করলেও জামায়াতের সঙ্গে সাক্ষাতের কোন কর্মসূচী রাখছেন না। [যায় যায় দিন, ৬.৫.২০১১]।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে অন্তত এটুকু পরিবর্তন হয়েছে।
অন্য কারণটি হচ্ছে ভূ-প্রকৃতিগত ও ভূ-রাজনীতি। এক সময় বিশ্বে প্রভাব ছিল ভূমধ্যসাগরের, তারপর এসেছে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর। এখন চীন ভারত মিয়ানমারের কারণে বঙ্গোপসাগর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীনকে দমিয়ে রাখতে হলে চীনের বিপরীতে শক্তি সমন্বয় করতে হবে।
ভারত এখন বন্ধু, মিয়ানমার বন্ধু হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশও বন্ধু হলে চীনকে খানিকটা সংযত থাকতে হবে। ইতোমধ্যে মানবিক সাহায্যের নামে মার্কিন নৌবহরের ঘোরাফেরা, যৌথ দৌড়াদৌড়ি, প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ চলছে। বাংলাদেশ যদি বিগড়ে যায় তা’হলে ভারত খুব সুবিধায় থাকবে না। চীনও সুযোগ নিতে পারে। আপাতত: এই হচ্ছে অস্পষ্ট রূপরেখা।
হিলারিকে মার্কিন স্বার্থ বজায় রাখতে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চীন থেকে ঢাকায় আসতে হয়েছে।
হিলারির আলোচনা করার কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তিনি যাননি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই গেছেন এবং সব কাজকর্ম সেখানে সেরেছেন। ডা. দীপু মনিকে অবশ্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই যেতে হবে। ‘সময়ের অভাবে’ সরকারী নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে কোন নৈশভোজে যোগদান করেননি। তবে, ফান্ডামেন্টালিস্টদের মিত্র বিএনপি নেত্রীর বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন।
সময় করে ড. ইউনূস ও জনাব আবেদের সঙ্গে নাস্তা সেরেছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।
তারপরও বলব, মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলেছে। হিলারি বাংলাদেশের অগ্রগতির যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন এবং আন্তরিকভাবেই। অন্যান্য প্রসঙ্গে সাধারণভাবে যে সব কথা বলেন সেগুলোই বলেছেন। গর্জন সিং ওরফে মীর্জা ফখরুল ও জনাব আবেদরা যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের [এনজিওদের সুবিধা হয় যাতে] দাবি তুলে বলছেন এটি হিলারিরই বক্তব্য [স্পষ্টভাবে ড. ইউনূস ও জনাব আবেদ তা বলেননি] আসলে কিন্তু এ সম্পর্কে হিলারি কোন বক্তব্য রাখেননি।
ইলিয়াস আলী সম্পর্কেও না বরং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমিনুলের ব্যাপারে। কারণ, মার্কিন বাণিজ্যের সঙ্গে এটি জড়িত। সরকার ও গার্মেন্টস মালিকরা তা বুঝছেন কিনা সন্দেহ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, হিলারির সফর সরকারের কার্যকলাপের এক ধরনের স্বীকৃতি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার হয় না।
তারা নিমিষেই বন্ধুকে শত্রু ও শত্রুকে বন্ধু মনে করতে পারে। পাকিস্তান, ইরাক এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। সুতরাং হিলারি আমাদের কিছু দেবেন এমনি এমনি তা হয়না। আমরা কি দিলে কি পাব সেটি যেন মাথায় রাখি। হিলারি বা ওবামা আসবেন সে আনন্দেই যেন কাপড়-চোপড় খুলে নৃত্য না করি এবং এ প্রক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রীর গর্জন মাঝে মাঝে কাজেও দিতে পারে।
বরং হিলারিও বিশ্বব্যাংক যতবার ড. ইউনূস বা দুর্নীতি সম্পর্কে বলবেন ততবার ড. ইউনূস পয়েন্ট হারাবেন।
যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য আমরা সবাই বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিলেও আশা করি শেখ হাসিনা ঝাঁপ দেবেন না। পিতাকে তিনি ভালবাসেন। পিতার কবর এখানে। আল্লাহ তাঁকে অনেক তওফিক দিয়েছেন জানি, যদি চান হয়ত আরও দেবেন কিন্তু দেশের তজল্লি যেন থাকে সে দিকে যেন একটু খেয়াল রাখেন।
তজল্লি বাড়াতে হলে খালি তওফিকের ওপর নির্ভরশীল হলে হবে না, আশপাশেও একটু তাকাতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।