যেমন কর্ম তেমন ফল।
রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণিতে বছর দুয়েক আগে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে পাম্প বসিয়েছিল ওয়াসা। পাম্পের জায়গা দেয় স্থানীয় বাড়িমালিকদের সংগঠন শেওড়াপাড়া কল্যাণ সমিতি। প্রতি মিনিটে তিন হাজার লিটার উত্পাদনক্ষমতার সেই পাম্প থেকে এখন প্রতি মিনিটে পানি পাওয়া যায় ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার। সম্প্রতি পাম্পটি সরেজমিন করা হয়।
পাম্পের ফটকে দাঁড়াতেই এগিয়ে আসেন অপারেটর রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, পাম্পে পানি ওঠে না। লোকজনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে দূরে দূরে থাকি। বদলি করে দিলে শান্তি পেতাম।
ঘুরে দেখা যায়, পাম্পটিতে উত্পাদন পরিমাপের কোনো মিটার নেই।
অথচ এটা থেকে মিনিটে তিন হাজার লিটার পানি উত্পাদন দেখানো হচ্ছে নথিপত্রে। বিষয়টি ওয়াসার কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। নাম গোপন রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরে জনপ্রতি দৈনিক ১৫০ লিটার প্রয়োজন ধরে পানির চাহিদা ২৩০ কোটি লিটার। ওয়াসা প্রতিদিন ২০০ কোটি লিটারেরও বেশি উত্পাদন দেখাচ্ছে। মাত্র ৩০ কোটি লিটার ঘাটতি হলে রাজধানীতে পানি সংকটের এত অভিযোগ ওঠার কথা নয়।
তিনি বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি সংকটের খবর আসে।
রাজধানীর মধ্য পীরেরবাগের অলি মিয়ার টেকের পাম্পেও কোনো মিটার নেই। এটার বিপরীতে প্রতি মিনিটে উত্পাদন দেখানো হচ্ছে পাঁচ হাজার লিটার। পাম্প অপারেটর মো. শাহরিয়ার বলেন, এই পাম্পে আগে পাঁচ হাজার লিটারেরও বেশি পানি উঠত। এখন বড়জোর দুই হাজার লিটার ওঠে।
অনুসন্ধানে ঢাকা ওয়াসার পানি উত্পাদনের হিসাব জালিয়াতির চিত্র ধরা পড়েছে। এতে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উত্পাদন করে, কাগজ-কলমে তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে হিসাব দাখিল করা হচ্ছে। আর এ হিসাবের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজধানীতে তেমন পানি সংকট নেই। যেটুকু হচ্ছে, সেটা লোডশেডিংয়ের কারণে। অথচ সমপ্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে নাখালপাড়াতেই পানির দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছিল এলাকাবাসী।
পাম্প (গভীর নলকূপ) ও পানি শোধনাগার থেকে উত্পাদিত পানির হিসাবের সমন্বয় করেন ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অরুণ কুমার বিশ্বাস। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,"কোন পাম্পে কী পরিমাণ পানি উত্তোলন হয়, তার পরিমাণ নির্ণয়ের দায়িত্ব আমার নয়। সব জোন (অঞ্চল) থেকে হিসাব পাঠায়। কমার্সের ভাষায় বলতে পারেন আমি জাবেদা করি মাত্র।
ঢাকা ওয়াসার অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোবারক হোসেন বলেন, পাম্পে একটি মিটার সংযোজন করা হয়।
ওই মিটার দেখে বোঝা যায় ওই পাম্প থেকে প্রতি মিনিটে কী পরিমাণ পানি উত্তোলিত হয়।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পাম্পেই পানি উত্পাদনের হিসাব রাখার মিটার নেই। কিছু পাম্পে থাকলেও তা নষ্ট। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. লিয়াকত আলী বলেন, পাম্পে মিটার না থাকলেও তো সমস্যা নেই। পরিমাপের পরের দিনই তো উত্পাদন কমে যায় না।
আর পানির সমস্যাটা কেবল শুষ্ক মৌসুমেই হয়। আর আমার জানামতে বেশির ভাগ পাম্পেই মিটার আছে। কাজেই হিসাবে উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু বড় ধরনের ব্যবধান হবে না।
যেভাবে জালিয়াতি : পাম্প স্থাপনের পর প্রথমে কী পরিমাণ পানি উত্পাদন হয়, সেটা দেখেই পাম্পের উত্পাদনক্ষমতা নির্ধারণ করে ওয়াসা।
এ ক্ষেত্রে পানির স্তর অনুযায়ী একটি পাম্পের উত্পাদনক্ষমতা মিনিটে তিন থেকে পাঁচ হাজার লিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি
পাম্পেরই উত্পাদনক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু ওয়াসা আগের হিসাবকেই আমলে নেয়। অথচ বাস্তবে তিন হাজার লিটার উত্পাদনক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পের ক্ষমতা একপর্যায়ে দশ ভাগের এক ভাগে নেমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
শেরে বাংলানগরের আগারগাঁওয়ের ২ নম্বর পানির পাম্পের অপারেটর গিয়াস উদ্দিন বলেন, পাম্পে মিটার থাকলেও বর্তমানে সেটা বিকল।
কাজেই পানি মাপা যায় না। প্রথম দিকে মিনিটে পাঁচ হাজার ২০০ লিটার পানি উত্পাদন হয়েছে। সর্বশেষ ৫৫০ লিটার দেখতে পেয়েছি। পাম্পটির ওভারহোলিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
রাজধানীর ইস্কাটনের পানির পাম্পের অপারেটর আমির হোসেন বলেন, এই পাম্পে আগে চার-পাঁচ হাজার লিটার পানি উঠত।
এখন দেড়-দু হাজারে ঠেকেছে। প্রস্তাব গেছে নতুন করে মেরামতের। হয়তো শিগগিরই মেরামত করা হবে।
ঢাকা ওয়াসার একজন প্রকৌশলী জানান, ঢাকা শহরে পানির স্তর অঞ্চলভেদে প্রতিবছর এক থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে সব পাম্পেই ক্ষমতার সমপরিমাণ পানি উত্পাদিত হচ্ছে না।
যেমন রূপনগর পাম্পে সাড়ে তিন হাজারের স্থলে বর্তমানে উত্পাদিত হচ্ছে এক হাজার ৩০০ লিটার।
ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা বলেন, গত ১২ এপ্রিল ২২১ কোটি লিটার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওয়াসা উত্পাদন করেছে ১৯৯ কোটি লিটার। ১৩ এপ্রিল করেছে ২০০ কোটি লিটার। এই পানির ১৫ শতাংশ শোধনাগার এবং বাকি ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেছে গভীর নলকূপ থেকে। কিন্তু পাম্পগুলোতে যে হারে উত্পাদন কম হচ্ছে, তাতে ওই পরিমাণ পানি উত্তোলন হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এ ছাড়া পাম্প অপারেটরদের বিরুদ্ধে জ্বালানি চুরির অভিযোগ তো রয়েছেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।