আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ পলায়ন কিংবা সারপ্রাইজ কিংবা কোনটিই নয় শুধুমাত্র সামান্য একটি ভালোবাসার গল্প

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! ১৭ আসাদ সাহেব বললেন, বাবা তোমায় যে কি বলে ধন্যবাদ দেব! রাশেদ বললেন, আমি তো আপনার ছেলের মতই। আমার সাথে এত ফর্মাল বিহ্যাভ করেন ক্যান? তুমি আমার মেয়েটার জন্য অনেক করছ। খোদা নিশ্চয়ই তোমার এই কাজের প্রতিদান দিবেন। এই কথায় রাশেদের মন খারাপ হয়ে যায়। খোদা যদি তাকে এই কাজের প্রতিদান নিজে চেয়ে নেবার সুযোগ দিতেন, সে নিজের জীবনের বিনিময়ে একজনের দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করত।

১ শিউলি খুব অস্থিরভাবে রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে পায়চারি করছে। ঘটনা তেমন কিছু না। ট্রেনের অপেক্ষায় এরকম প্রত্যেক রেলস্টেশনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ পায়চারি করে। কারো থাকে বাড়িতে গিয়ে প্রিয় মুখের হাসি দেখে হৃদয় জুড়ানোর তাড়া, কারো থাকে পরদিন টাইমমত অফিসে পৌঁছে বসের মুখে সন্তুষ্টির মুখভঙ্গি ফুটিয়ে তোলার তাড়া। কেউ হয়তো ট্রেনে ওঠে দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসার জন্য, কেউ ওঠে হলে বা মেসে ফেরার জন্য, কেউ হয়তো ট্রেনে চড়ে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে পুরনো সম্পর্কের গাঁথুনিটা শক্ততর করার জন্য, আবার কেউ হয়তো কোন কারণ ছাড়াই যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাবার জন্য ট্রেনে উঠে বসে।

বিনা টিকিটে একেকটা ট্রেনে অনেকগুলো মানুষের আবেগ সকাল-সন্ধ্যা যাতায়াত করে। শিউলির পরনে সাধারণ একটা থ্রিপিস। সবুজ রঙের জামার সাথে লাল সালোয়ার। সাথে বেগুনি ওড়না। কাপড়ের রঙ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

দেখে মনে হয় এই কাপড় অনেকদিন ধরেই ব্যবহৃত হচ্ছে। মোটামুটি অবস্থাপন্ন মেয়েরা এক কাপড় বেশিদিন পরতে জন্মগতভাবে অক্ষম। তাদের কাপড়চোপড় আলমারিতে না আঁটলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আগে তারা উপযুক্ত কাপড়ের দারুণ অভাব বোধ করে। শিউলির মধ্যে সেরকম কোন বোধ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে অস্থিরভাবে হাতের নখ দাঁত দিয়ে কাটছে।

মেয়েদের হাতের নখ দাঁতে কাটা অতি স্বাভাবিক এবং অতি অস্বস্তিকর একটা দৃশ্য। শিউলি এতক্ষণ ধরে যে মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছে তার নাম রাশেদ। রাশেদ চরিত্রটি এই গল্পে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শিউলি একটু পরে এই রাশেদের হাত ধরেই পালিয়ে যাবে। ২ আসাদ সাহেব মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন। আসাদ সাহেব একজন সম্মানিত ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা।

তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ার পড়ছে। ছোট মেয়ে কেবল ইন্টার দিল। স্ত্রী গত হয়েছেন আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। আসাদ সাহেবের সামনে একটা ভাতের প্লেট।

ভাতের প্লেটে ভাত, আলুভর্তা, সবজি। পাশে একটা পানির গ্লাস। খানিকটা দূরে একটা বাটিতে কিছুটা মুরগির মাংস। আসাদ সাহেব কিছুই মুখে দিচ্ছেন না। অনেক অনেক দিন পর তিনি বড় মেয়েকে ছাড়া রাতের খাবার খাচ্ছেন।

শেষ কবে মেয়েদের ছাড়া রাতের খাবার খেয়েছেন এই সাধারণ তথ্যটা তার প্রৌঢ় মস্তিষ্ক অজ্ঞাত কারণে বিস্মৃত হয়ে বসে আছে। আসাদ সাহেবের সামনে তার ছোট মেয়ে বসে আছে। দুই মেয়ের মধ্যে এইটার রেজাল্ট ভালো। এসএসসিতে গোল্ডেন ছিল। ইন্টারেও হবে ইনশাল্লাহ।

মেয়েটার খুব ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার শখ। চান্স পেয়ে যাবে, ট্যালেন্টেড মেয়ে। ছোট মেয়ে বলল, বাবা, তুমি ভাত খাচ্ছ না কেন? আসাদ সাহেব বললেন, তোর আপাকে ছাড়া যে একা একা ভাত খাওয়া যায় এই ব্যাপারটা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম রে মা। ছোট মেয়ে ফিক করে হেসে বলল, আপার বিয়ে হয়ে গেলে কি করবে? আপার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবে? নাকি একটা হাবলার সাথে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে রাখবে? আসাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মেয়ের জন্যে ভালো ভালো কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিল।

একজনকে প্রায় পছন্দ করেই ফেলেছিলেন আসাদ সাহেব। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মেয়ে বেঁকে বসেছে। ছোট মেয়ে মারফত আসাদ সাহেব খবর পেয়েছেন, তার বড় মেয়ে আরেকজনকে মন দিয়ে বসে আছে। ছেলে তার বড় মেয়ের ক্লাসমেট। বিশাল রাজনৈতিক ছাত্রনেতা।

সাথে চামচা নিয়ে ঘোরে। নেতাগিরি করে এক বছর গ্যাপ খেয়েছে। আসাদ সাহেব আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মন বলছে, কিছু একটা ঠিক নেই। কিছু একটা।

৩ শিউলির খুব দুর্বল লাগছে। কষ্টও হচ্ছে খুব। রাশেদ এত খারাপ কেন? এখনও আসছে না কেন? আশেপাশের মানুষজন কেউ কেউ অবাক হয়ে শিউলিকে দেখছে। সম্ভবত কেউ কেউ তাদের দেখা অথবা কল্পনা করা ভ্রাম্যমাণ দেহোপজীবিনী মেয়েদের সাথে শিউলিকে মিলিয়ে দেখছে। কেউ হয়তো মিল পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না।

শিউলি একটা পিলারের সামনের বসার জায়গায় বসে পড়ল। তার মনটা শিশুর মত তুচ্ছ অভিমানে ভরে উঠল। রাশেদ এখনও আসছে না কেন? রাশেদ কি তাকে ভুলে গেছে? কিন্তু প্রিয় পাঠক, যেহেতু আমরা একটু আগে বলেই দিয়েছি এই গল্পে শিউলি রাশেদের হাত ধরে পালিয়ে যাবে, সুতরাং শিউলির অভিমান বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। একটু পরে হন্তদন্ত করে একজন পুরুষকে শিউলির দিকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। তার হাতে একটা ব্যাগ।

শিউলি গভীর অভিমানের সাথে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলেই গেছ। রাশেদ অট্টহাসি দিয়ে বলল, তোমাকে ভুলতে পারি? নিজেকে আমি, ভুলতে পারি, তোমাকে যাবে না ভোলা, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা। হাহাহাহা। শিউলি হেসে বলল, ফাইজলামি করবা না। একদম ফাইজলামি করবা না।

রাশেদ বলল, আচ্ছা বাবা করব না। এখন চল, ট্রেন ঐ চলে এসেছে। রাশেদ আর শিউলি হাত ধরাধরি করে ট্রেনের দিকে যাচ্ছে। তাদের হস্তদ্বয়ের সংযোগস্থল দিয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রবাহিত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ইউনিট ভালোবাসা। ৪ আসাদ সাহেব ফোনের এ প্রান্তে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন।

তামান্না তোমাদের ওখানে যায় নি? না আঙ্কেল। আজ তোমার বোনের বিয়ে না? না আঙ্কেল। মা, তুমি সত্যি করে বল। আমার মেয়েটা সত্যিই ওখানে নেই তো? আমাকে ভড়কে দেবার জন্য তোমরা প্ল্যান করে আমায় মিথ্যা বলছ না তো? না আঙ্কেল বিশ্বাস করুন। দরকার হলে আমার বাবার সাথে কথা বলুন আপনি, দেব? থাক থাক, দেবার দরকার নাই।

আচ্ছা, তোমার কি কোন ধারণা আছে সে কোথায় যেতে পারে? না আঙ্কেল। আসাদ সাহেবের মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তার বড় মেয়ে তার সাথে মিথ্যা বলেছে। সে বলেছিল সে তার অমুক বান্ধবীর বোনের বিয়ে খেতে যাচ্ছে, ঐখানেই রাত কাটাবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা সত্যি নয়। তার মানে সে অন্য কোথাও গেছে।

এমন কোথাও, যেখানে যেতে হলে আদরের বাপকে মিথ্যা বলে যেতে হয়। আসাদ সাহেবের এক পরিচিত এস আই আছে। নাজিম নাম। সম্পর্কে তার ভাগ্নে হয়। টাউট একটা মানুষ।

আসাদ সাহেব নিরুপায় হয়ে ফোনে নাজিমের নাম্বার ডায়াল করতে শুরু করলেন। ৫ শিউলি, তুমি আবারও ভেবে দেখ। দেখেছি। আবেগ আর বাস্তবতা এক জিনিস নয়। ওসব আমি জানি।

ইউ হ্যাভ স্টিল টাইম। এখনও তুমি ট্রেন থেকে নেমে যেত পার, আমি নিজে তোমায় বাসায় পৌঁছে দেব। আমি ভেবেছি রাশেদ। কি ভেবেছ? তোমাকে ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব না। রাশেদের মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

এই সহজ সরল মেয়েটিকে সে প্রচণ্ড ভালবাসে। এই মেয়েটির জন্য সে একবার কেন, হাজারবার সমাজ সংস্কার তুচ্ছ করে বাসা থেকে পালাতে পারে। শিউলি রাশেদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, তোমার হাত ধরতে পারি? এটার জন্য আবার পারমিশন লাগে? লাগে। পার। শিউলি রাশেদের হাত ধরল।

রাতের ট্রেন দূরের গন্তব্যে ছুটে চলেছে। এই কামরার অধিকাংশ যাত্রী গভীর ঘুমে। দুটো মানব মানবীর অদৃশ্য ভালোবাসা তাদের অনর্থক কৌতূহলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। ৬ পুলিশের এসআই নাজিম-উদ-দৌলা মিটমিট করে হাসছেন। কোন চ্যালেঞ্জিং ড্যাশিং পুশিং কেস পেলেই তার মুখে একটা মিটমিটে হাসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে।

কেস খুব সিম্পল। আসাদ সাহেবের বড় মেয়ে নিখোঁজ। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আসাদ সাহেব টাকাওয়ালা লোক। টাকাওয়ালা লোকদের কেস খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হয়।

এটাও করতে হবে। মেয়ের কাছে কোন মোবাইল নেই। সে বাসা থেকে বের হবার সময় এক বান্ধবীর বাসায় যাবার কথা বলেছে, কিন্তু শেষমেশ সেখানে যায় নি। তারমানে, এক সে রেপড হয়ে গুম হয়ে গেছে, নয়তো দুই, কারো সাথে পালিয়ে গেছে। আপাতত এক নাম্বার সত্যি হবার সপক্ষে কোন যুক্তি না থাকলেও, দু নাম্বারের সপক্ষে একটা তথ্য নাজিম-উদ-দৌলার কাছে আছে।

নিখোঁজ মেয়েটা নাকি জনৈক ক্লাসমেট পলিটিকাল ক্যাডার পোলার প্রেমে মশগুল ছিল। সেই পোলার জন্য সে চার পাঁচটা বিয়ের অফার রিজেক্ট করেছে। এই নিয়ে বাপের সাথে তার সম্পর্কও একটা অবনতির দিকে যাচ্ছিল। হুম, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ, ভাবলেন নাজিম-উদ-দৌলা। কেস পানির মত পরিষ্কার।

ছেলের সাথে পালিয়ে গেলে হয় ছেলের গ্রামের বাড়িতে উঠবে, নয়তো ছেলের কোন বন্ধুর বাড়িতে উঠবে। এর বাইরে কোথাও ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। আসাদ সাহেব মারফত কেবলমাত্র পাওয়া ক্যাডার ছেলেটার নাম্বারে ফোন করতে উদ্যত হলেন নাজিম-উদ-দৌলা। তার মন বলছে এটা একটা পালানোর কেস। পানির মত পরিষ্কার কেস।

৭ রাশেদ আর শিউলি ট্রেন থেকে নেমেছে। শিউলি, আবার ভেবে দেখ। তোমার বাবা, তোমার আদরের বোন – এরাও তোমায় অনেক ভালোবাসেন। তুমি এখনও তাদের কাছে ফিরে যেতে পার। রাশেদ তুমি বারবার একই কথা বল কেন? আমি কি একবার বলি নাই সব ভেবেচিন্তেই আমি তোমার হাত ধরে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এসেছি? শিউলি, তোমার আবেগ অত্যন্ত বেশি।

এখনও সময় আছে। তুমি এখনও ফিরে যেতে পার। আমি নিজ দায়িত্বে তোমায় বাসায় পৌঁছে দেব। ধ্যাত! আর একবার যদি এই কথা বলেছ তার আমি তোমার মুখ গুঁড়া করে দিব! রাশেদ ঈষৎ হতাশ হয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে আছে। সে মাঝে মাঝে এই মেয়েটাকে একদম বুঝে উঠতে পারে না।

একদম না। ৮ আসাদ সাহেব উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করছেন। তার ছোট মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আসাদ সাহেব তার ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, জানতাম! আমি জানতাম! হারামজাদী যে আমার মুখ কালি করবে সেটা আমি জানতাম! ঘটনা সংক্ষিপ্ত। এসআই নাজিম-উদ-দৌলা জানিয়েছে, ঐ ক্যাডার পোলাও নাকি বাসায় ফেরে নি, তাকেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।

আসাদ সাহেব রাগে দাঁত কিড়মিড় করছেন। মেয়ে তার মানসম্মান সব ডুবিয়েছে। সব। ৯ মফিজ খুব সন্দিহান দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকিয়ে আছে। এইটা কে বললি? তোর ভাবী।

তুই বিয়ে করলি কবে? একটু আগে। একটু আগে? হুম। তুই আমার এখানে ক্যান আসছিস? থাকতে। মানে? থাকতে মানে থাকতে। দ্যাখ রাশেদ, গতকাল তুই ফোনে বলেছিলি তুই একা আসতেছিস, একদিন থেকেই চলে যাবি।

আমিও সেইভাবে ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। আর এখন তুই একা না, অন্য কেউ সাথে থাকলেও হত, তাও না, এক্কেবারে বিয়ে করে আমার বাসায় উঠে পড়লি! হুম পড়লাম। কয়দিন থাকবি? একদিন। তুই জানিস তোর এই থাকার কথা জানাজানি হলে কি হবে? কি হবে? কিছুই হবে না? রাশেদ, তুই এত ইম্প্র্যাকটিকাল হলি কবে থেকে বল তো? সবাই কি বলবে বুঝতে পারছিস তো? পারছি। সবাই বলবে মফিজের বন্ধু রাশেদ বিয়ে করে হানিমুন করতে মফিজের বাসায় উঠছে।

তাই তো, আর কি? মফিজ হতাশ হয়ে একবার রাশেদ, একবার শিউলির দিকে তাকাচ্ছে। শিউলি তার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে একটা হাসি দিল। ১০ রাত পৌনে বারোটা। আসাদ সাহেব গালাগালি করে জনৈক ক্যাডারের শাপশাপান্ত করছেন। একটু আগে তার ছোট মেয়ে বড় মেয়ের টেবিলে চাপা দিয়ে রাখা একটা চিরকুট পেয়েছে।

স্পষ্টতই চিরকুট আসাদ সাহেবের উদ্দেশ্যে লেখা। বাবা, আমি জানি তুমি কখনই ওকে মেনে নেবে না। কিন্তু আমি ওকে ভালবাসি। তাই তোমায় মিথ্যা বলে পালিয়ে গেলাম। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা।

ইতি, তোমার বড় মেয়ে আসাদ সাহেব অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন। তার ছোট মেয়ে একদৃষ্টিতে চিরকুটের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে বলে উঠল, পালিয়ে বিয়ে করা খুব মজা, তাই না বাবা? আসাদ সাহেব অন্যমনস্ক ছিলেন বলে এই কথাটা শুনতে পেলেন না। দেখো বাবা, আমিও পালিয়ে বিয়ে করব। এই কথাটা আসাদ সাহেবের কানে গেল।

তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন, কি! কি বললি তুই? কিছু বলি নাই। বিয়ে নিয়ে কিছু একটা বললি মনে হয়? নাহ, কিছু বলি নাই। ১১ রাত। মফিজ খুব আনন্দের সাথে রাশেদ শিউলির ঘরে ফুলের মালা লাগাচ্ছে। আজ তাদের বাসর রাত।

মফিজ আর রাশেদ যখন একসাথে স্কুলে পড়ত, তখন তারা প্ল্যান করেছিল একে অপরের বাসর রাতে খাটের নিচে শুয়ে থাকবে। অবশ্য বড় হবার সাথে সাথে এই ভয়াবহ প্ল্যানের অসারতা ও বিপদসমূহ তাদের বিবেকগোচর হয় এবং অচিরেই তারা প্ল্যানটাকে বাতিল ঘোষণা করে। মফিজের ইচ্ছা করছে রাশেদের পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে। এত ভালো মানুষ যে জীবনে দেখে নি। জীবনেও না।

মফিজের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। কেন পড়ছে সেই জানে। ১২ রাত বারোটা বাজল। আসাদ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়ে তার বড় মেয়ে ঢুকল। তার হাতে বিশাল এক কেক।

আসাদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তুই? হ্যাঁ আমি। তুই না...? আমি না কি? তুই না পালায়ে গেছিস? নাহ! কে বলেছে এইগুলা? তাহলে, ঐ চিরকুট...? কোন চিরকুট? আসাদ সাহেবের কিছুতেই মনে পড়ল না চিরকুটটা তিনি কোথায় রেখেছেন। তার বড় মেয়ে কেকটা টেবিলে রাখল। কেকের উপর লেখা, “হ্যাপি বার্থডে, বাবা”। আসাদ সাহেবের মন হঠাৎই স্নেহে আর্দ্র হয়ে উঠল।

এখন তিনি বুঝতে পারছেন মেয়ে কোথায় গিয়েছিল। আর এটাও বুঝতে পারছেন পুরো ঘটনাটাই ছিল তাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য। আর, সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারছেন সারপ্রাইজ প্ল্যানের অংশ না হলেও, চিরকুটটা কে লিখেছে। ১৩ রাশেদ, আমার খুব খারাপ লাগছে। কেন? আমার খুব বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

জানতাম। তুমি তো সব আগে থেকে জেনে বসে থাকো! হুম। তা চলো, আমরা বের হয়ে যাই। রাশেদ আর শিউলি ব্যাগ হাতে বের হয়ে গেল। পিছনে মফিজ তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।

রাশেদের দিকে যতবারই তাকায় ততবারই অবাক হয় সে। শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে মাথা। শিউলির প্রতি রাশেদের ভালোবাসা দেখে, নিজের মধ্যেও বিশেষ কারো প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা বোধ করা শুরু করে মফিজ। নাহ, মা-কে আজই ঊর্মির কথাটা বলতে হবে। মেয়েটাকে আর ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না।

১৪ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এই পেশেন্ট যেন আপনার কি হয়? মেয়ে। ছোট মেয়ে। আর আপনার? স্ত্রী। আই সি।

শুনুন, পেশেন্টের শরীরে একটা বিশেষ ধরণের রোগ বাসা বেঁধেছে। একটা বিশেষ ধরণের ক্যান্সার। ক্যান্সার! হ্যাঁ। শুনুন, সব মিলিয়ে হয়তো পেশেন্ট আর বেশি হলে এক বছর বাঁচবে। এক বছর! হ্যাঁ।

আর আরেকটা কথা, এখন পর্যন্ত এর চিকিৎসা করিয়ে কেউ ভালো হয় নি। হবার সম্ভাবনাও কম। ওর চেয়ে আমি বলি কি, আপনারা এই এক বছর মেয়েটাকে আদর স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে ভরে রাখুন। সে যা চায়, যেটাই চায়, সেটাই তাকে এনে দিন। তাতে করে জীবনের শেষে এসে মেয়েটা শান্তি পাবে...ও কি আপনি কাঁদছেন কেন? এখন তো আপনার মন শক্ত করতে হবে, অনেক শক্ত।

১৫ রাশেদ আর শিউলি একটা বড় দোতলা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ বলল, তুমি আগে যাও। আচ্ছা। শিউলি বেল টিপল। ভিতরে পদশব্দ পাওয়া গেল।

একটু পরে খুলে গেল দরজা। আসাদ সাহেব কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ তার চোখ কঠিন রইল না, অচিরেই স্নেহার্দ্র করুণার্দ্র হয়ে সে চোখ হতে পানি পড়তে লাগল। আসাদ সাহেব মেয়ের মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শিউলি বলল, তুমি আমায় ক্ষমা করেছ তো বাবা? আসাদ সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হ্যাঁ মা।

তোকে ক্ষমা না করে পারি? তুমি কি এখনও আমার উপর রাগ করে আছ বাবা? না রে মা, রাগ করে নাই। তোমার জামাইকে নিয়ে আসব? সে তো তোমার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে। নিয়ে আয় মা। কান্নায় আসাদ সাহেবের শুভ্র দাড়ি ভিজে যায়। অবশেষে রাশেদ আর আসাদ সাহেব মুখোমুখি হলেন।

একটু পরে আসাদ সাহেবের প্রশস্ত বুকের বাকি অংশে রাশেদের মাথার ঠাই হল। ১৬ অ্যাই! কি? চলো না পালিয়ে বিয়ে করি! রাশেদ হেসে ফেলে, আমরা তো বিবাহিতই। তাতে কি! জানো, পালিয়ে বিয়ে করা আমার সারাজীবনের শখ। এটাও মানুষের শখ হয়? রাশেদ হাসতে থাকে। হ্যাঁ হয়।

অ্যাই, চলো না একদিন পালিয়ে যাওয়া প্রেমিক প্রেমিকার অভিনয় করি। এক কাজ করি, পরশুদিন তো বাবার বার্থডে আছে, চলো পালিয়ে বাবার বাসায় চলে যাই। সত্যি? হ্যাঁ সত্যি। শুধু যাবার টাইমটুকু অভিনয় করব। তুমি প্রেমিক প্রেমিক ডায়লগ দিবা, আমি প্রেমিকা প্রেমিকা ডায়লগ দিব।

তোমার ক্যাবলা বন্ধু মফিজের বাসায় আমরা পালিয়ে বিয়ে করা দম্পতির মত রাত কাটাব। রাজি? রাজি। মফিজকেও তুমি সেইভাবে অভিনয় করতে রাজি করাবা। আমাদের দেখে যেন ভিরমি খেয়ে যায়। রাজি? অবশ্যই রাজি।

আর বাবাকেও ফোন করে রাজি করাবা। বাবা যেন আমাকে দেখে প্রথমে রাগে ফেটে পড়ে, তারপর যেন সব রাগ গলে পানি হয়ে যায়। তারপর তুমি আস্তে করে এসে বাবার সামনে দাঁড়াবা, বাবা তোমাকে মেনে নিবে। ঠিক আছে? ঠিক আছে। শিউলির আপাতদৃষ্ট উদ্ভট প্রস্তাবে রাশেদ রাজি হয়ে যায়।

শিউলিকে সে বড় ভালোবাসে। শিউলির কোন ইচ্ছাকে সে অপূর্ণ রাখতে চায় না। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ এক বছরের কোন ইচ্ছাকেই খাটো করে দেখার সুযোগ রাশেদের নেই। (সমাপ্ত। কমেন্ট না দিলে খায়ালামু, হাহাহাহাহা) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।