অনেক দিন পরে ক্যাম্পাসে সুমনার সাথে দেখা হয়ে গেল ঐশির।
--আরে সুমনা! কী খবর? কত্তদিন পরে দেখা!
--হুম, এই জানো? প্রমি আত্নহত্যা করেছে!
কথাটা শুনে চমকে ওঠে ঐশি।
--কী বলো? কবে? কেমন করে?
--রবিবারে, ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে।
এটুকু বলে সুমনা আর কথা বলতে পারে না। দুই বান্ধবী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপরে বিদায় নিতে হয়, সুমনার ক্লাসের তাড়া আছে। খবরটা শোনার পর ঐশির সারাটা দিন আর কোন কাজে মন বসে না। ঘুরে ফিরে বারবার প্রমির কথা মনে পড়ছিল। এত উচ্ছ্বল মেয়েটা এত সহজেই মরে গেল? বাসায় ফিরে কয়েকদিনের পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে খবরটা বের করল, ‘’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর আত্নহত্যা’’। হ্যাঁ, খবরটা ঐশির চোখে পড়েছিল, কিন্তু তখন পড়া হয় নি।
এখন মন দিয়ে পড়ল ও। পত্রিকাওয়ালারা লিখেছে, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়াতে কয়েকদিন ধরে প্রমি বিষন্নতা ভুগছিল। পরে সে ফ্যানের সাথে ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্নহত্যা করে। ঐশি মনে মনে প্রমির গালে কয়েকটা চড় কষায়, চিৎকার করে ওর বলতে ইচ্ছে করে, ‘’ফার্স্ট ক্লাস পাস নি তো কী হয়েছে? সেকেন্ড ক্লাস তো পেয়েছিলি! সেটা দিয়েও তো কিছু একটা করে খেতে পারতি! আর এখন? এখন কী হলো, তুই মরে গেলি!’’ মনটা ওর এত খারাপ হলো যে কারো সাথে দুঃখটা শেয়ার করতে ইচ্ছে করলো। তাই নিলয়কে ও ফোন করল।
খবরটা শুনে নিলয় বলল, ‘’এই সামান্য কারণে আত্নহত্যা? নাকি আরো কোন কারণ আছে? দ্যাখ গিয়ে, কী কাণ্ড ঘটিয়েছে!’’
--তোদের উটকো চিন্তার জ্বালায় একটা মেয়ে দেখি মরেও শান্তি পাবে না!
ফোনের লাইনটা কেটে দিল ঐশি। আর কারো সাথে কথা বলার মত মুড এখন আর নেই ওর।
পত্রিকার পাতা উল্টালে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা আত্নহত্যার খবর আপনার চোখে পড়বেই। কখনো মা তার সন্তানসহ আত্নহত্যা করেছে, কখনো শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী আত্নহত্যা করেছে। ইভ টিজিং এর শিকার হয়ে অনেকে আত্নহত্যা করেছে।
বাবা- মায়ের সাথে সামান্য অভিমান বা আবদার রক্ষা না করার কারণে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের আত্নহত্যা খবরও পত্রিকাতে এসেছে। এছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতা, প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার কারণেও আত্নহত্যার খবর প্রায়ই পত্রিকাতে আসে। এই তো কিছুদিন আগে সাংবাদিক মিনার মাহমুদ খবরের শিরোনাম হলেন, আত্নহত্যা করে। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে আত্নহত্যার ঘটনা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবার কারণে ছাত্রীহলগুলোতে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
দেহের কোথাও আঘাত পেলে তা সারিয়ে তোলার জন্য লোকে পরিচর্যা করে, ডাক্তারের কাছে যায়।
কিন্তু কারো মনের ভেতরে যে কত রক্তপাত প্রতিনিয়ত ঘটছে তার খবর আমরা রাখি না। যত্ন করে সারিয়ে তোলা হয় না সেই ক্ষতস্থান। এই ব্যস্ত সময়ে কারো সময় নেই অন্যের কষ্টের কথা শোনার, অনুভব করার। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব এত বেড়ে যাচ্ছে যে, নিজের কথাগুলো আর কেউ কারো সাথে শেয়ার করছে না। যোগাযোগব্যবস্থার চরম উৎকর্ষতার যুগেও একেকজন ব্যক্তি হয়ে পড়ছে যোগাযোগবিহীন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
আত্নহত্যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ।
স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেলে একজন ব্যক্তি নিজেকে ধবংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যাতে জীবনের পজিটিভদিকগুলো তখন তারা ভেবে দেখতে পারে না। আত্নহত্যাই তখন তাদের কাছে একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যক্তি যেমন হুট করে নিতে পারে, তেমনি দীর্ঘদিন পরিকল্পণা করেও নিতে পারে।
অনেকে আত্নহত্যা করবে বলে ঘোষণাও দিয়ে থাকতে পারে। আমাদের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে, সেটা হলো, বলে কয়ে কেউ আত্নহত্যা করে না। এটি ভুল ধারণা। বরং অনেক ক্ষেত্রে আত্নহত্যার ইচ্ছা ব্যক্তি তা হুমকির মাধ্যমে, চিঠি, নোট, ডায়রী, গল্প বা কবিতা লিখেও প্রকাশ করতে পারে। ব্যক্তি তখন ঘনঘন মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে।
আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেবার পরে ব্যক্তি ঘুমের ওষুধ, দড়ি, বিষ, ছুরি, পিস্তল এই জাতীয় ধবংসাত্নক জিনিস জোগাড় করে থাকে। এছাড়াও তখন ব্যক্তির খাওয়া ও ঘুমে প্রচুর অনিয়ম করতে দেখা যায়, সারাক্ষণ অস্থিরতায় থাকে। কারো সাথে বিদায় নেবার সময় এমনভাবে কথা বলে, যেন আর কখনো দেখা হবে না। অনেকে হঠাৎ করে তার সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়। এ ধরনের লক্ষণ বিষন্নতায় ভোগা কারো মধ্যে লক্ষ্য করলে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, তাকে কখনোই একা থাকতে দেওয়া যাবে না।
তার কাছ থেকে ছুরি, চাকু, ঘুমের অষুধ এ ধরনের জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। তার খাওয়া ও ঘুমের অভ্যাসগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় তাকে দিন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সে যেন প্রকৃতি সান্নিধ্যে থাকতে পারে বা সূর্যের আলো পায় এমন ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে আশার বাণী শোনান, বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়।
আর তার পাশে থাকুন, তার কথা শুনুন, মানসিকভাবে সমর্থন দিন, বলুন, আমি সব সময় তোমার সাথেই আছি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।