একটা সময় ছিল শুভার খুব মরে যেতে ইচ্ছা করতো। সব কিছু নিয়ে এতো খুঁতখুতে ভাব ছিল মেয়েটার। আমাকে প্রায়ই বলতো, আমি আর পারছি না——ছোট’পা, প্রতিদিন এত এত কিছুর পর আমার আর ভাল লাগে না কিছু।
শুভার ছিল ম্যাট্রিকে পুওর রেজাল্ট, সেটা থেকে এলো ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারার গঞ্জনা। এক সময় সব কিছু বাজি রেখে আর্ট কলেজের জন্য ঝাঁপ দিলো, পাঁচ বন্ধুর চার জনই ফাইন আর্টসে, শুভারই কিছু হলো না।
তো এসব নিয়ে শুভার হাহাকার আর তা থেকেই নিত্য নতুন তার আত্মহত্যার অনুপ্রেরণা।
ওকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হতো। খুব আতঙ্কে থাকতাম, কোন একদিন এই মেয়েটা হয়তো অপঘাতেই মারা যাবে। আহারে ছোট ফুটফুটে মেয়েটা, একেক সময় মনে হতো, শুভাকে তো অনেকটা আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। শুভার আম্মা, আমার ছোট খালা সে সময় লালমাটিয়ায় আমাদের বাসার কাছাকাছি থাকতেন।
যখন মাত্র হাটতে শিখেছে, আমাদের বাসায় আসতে খুব পছন্দ করতো, এ বাসাতেই পড়ে থাকতো বেশিটা সময়। আর আমার ঘরের জিনিষপত্র তছনছ করতো। চোখের সামনে ওকে দেখলাম বড় হতে। সেই মেয়ে যখন এই সব অলুক্ষুনে কথা বলে...... ছোটবেলায় শোনা লক্ষীর পাঁচালী মনে পড়তো...আত্মহত্যা মহাপাপ, নরকে গমন।
আমার বিয়ের আগে একটা সময় আমাদের দুজনের মধ্যে বেশ একটা সখী সখী ভাব ছিল।
বয়সের পার্থক্য ছিল কতই বা, ৬/৭ বছরের! দুজনেই দুজনের সাথে সবকিছু শেয়ার করতাম, কীর্তি কুকীর্তি সব কিছু। চরম গোপনতম কথাটাও একে অন্যের কাছে গচ্ছিত রাখতাম, দামি আমানত এর মতোন। আর কত কত মারাত্মক আর দুর্ধ্বর্ষ্য সব ঘটনা যে দুজন মিলে ঘটিয়েছি। সেই সময়ের ঘটন-অঘটন-পটিয়সি আমরা দুই পিচ্চি বাসার মুরুব্বিদের কাছে ছিলাম মুর্তিমান আতঙ্ক।
আমিই শুভাকে আগলে রাখতাম, আমার ডানার ছায়ায় ওকে আড়াল করে।
জগত সংসারের কোন অশুভ জিনিষ যেন ওকে ছুতে না পারে। এত ভোলে-ভালা ছিল আমার এই পিচ্চি বোনটা। মনে আছে একবার এক বিকালে শুভা এলো আমাদের বাসায়, তখন ওর কলেজের সেকেন্ড ইয়ার চলছে। ওর মধ্যে একটা খুব আদুরে ভাব ছিল, সব সময় আমাদের বাসায় ঢোকার সাথে সাথে ও দুইটা কাজ করতো, গলা থেকে ওড়নাটা খুলে ছুড়ে মারতো সোফার ওপর, পায়ের জুতাগুলা ছুড়ে ফেলতো দুইটা দুই দিকে, তারপর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করে দৌড় দিত আম্মার ঘরে। আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে বসে থাকা ছিল তার একটা প্রিয় কাজ।
সেদিন যথারীতি আম্মার ঘরে আমিও ছিলাম—হটাৎই আমার চোখ গেল শুভার গলার দিকে। কাঁধের একটা পাস আর গলায় লাল লাল ছোপ, আর তাতে দাঁতের স্পষ্ট দাগ।
সেদিন পুরোটা বিকাল শুভাকে আমার ঘরে রাখলাম আমার একটা ওড়না গলায় পেঁচিয়ে। আর ডিপফ্রীজের প্রায় দুই ক্রেট বরফ শেষ হয়েছিল তার গলা আর কাঁধের শুশ্রষায়। এটা ছিল শুভার জীবনের প্রথম চুমু খাওয়া, তার এই আনাড়িপনা নিয়ে পরবর্তী কালে আমরা অনেক হাসাহাসি করতাম।
শুভা থাকাতে আমার শপিংএ যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়াতে খুব সুবিধা হতো। দুজনের পছন্দের এতো মিল, আমি চোখ বুজে অনেক সময় ওর পছন্দের কোন ড্রেস বা শাড়ি নির্দ্বিধায় আমার জন্য কিনে ফেলতে বলেছি। বা দুজনে দোকানে ঢুকলে একই সাথে পছন্দের জিনিষটার সামনে গিয়ে দাড়িয়েছি।
আমার বিয়ের পর শুভার জীবনটা স্বভাবতই একটু এলোমেলো হয়ে যায়। ভুল ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করা শুরু করে।
যাদের সাথে ওর আসলে যায় না। ওর নিজস্ব বন্ধুদের সাথে দুরত্ব বাড়িয়ে ফেলে। আর সব কিছু মিলে ওর হতাশার মাত্রাও বাড়তে থাকে। ভুল অনুমান, ভুল অনুসিদ্ধান্ত আর তা থেকে তৈরি অন্যায্য অভিমান। শুভার আত্মধ্বংসী প্রবণতাগুলো মাথা চাড়া দিতে থাকে।
এর মধ্যে আমার দেশ ত্যাগ, নিজের সংসারে বুঁদ হয়ে যাওয়া—কিছুদিনের জন্য যেন আমাদের ঘনিষ্ঠতায় একটু যতি টেনেছিল। আমি আগের মত আর ওর খোঁজ খবর নিতে পারতাম না। যদিও প্রথম প্রথম মেসেঞ্জারে চ্যট করার সময় আমাকে আগের মতই সব কিছু খুলে বলতো, নিজের একান্ত ফিলিংস, মনের গোপন ইচ্ছা। আমার পরামর্শ মন দিয়ে শুনতো, কোন বিষয়ে আমার ব্যাখা বেশ মেনেও নিতো। কিন্ত হঠাৎ এক সময় মনে হতে থাকে, শুভার সব কিছু আমার কাছে প্রকাশ্য থাকছে না।
কি যেন সে আমার কাছে আড়াল করতে চায়।
আরিফ কে শুভার বিয়ে করার ঘটনা আমি জানতে পারি অনেক পড়ে, অন্য সবার মত বিয়ে হয়ে যাবার পর। ততদিনে নতুন মা হয়ে আমিও বেশ ব্যাস্ত জীবন কাটাচ্ছি। আম্মা একদিন ফোনে আমাকে খবরটা দিলেন। এটা নিয়ে আমি শুভাকে কোন অনু্যোগ দেই নাই, আমার সাথে একদিন আরিফের টেলিফোনে পরিচয় করিয়ে দিলে আমি তার সাথে অনেক ক্ষন গল্প করি, মজা করি তার সাথে।
এর বছর খানেক পর ওরা দুজনই কানাডা চলে আসে, প্রথমে মন্ট্রিয়লে আমার বাসায় সপ্তাদুয়েক থেকে ওরা চলে যায় হ্যামিলটন। আরিফের চাচা থাকে যে শহরে। হ্যামিলটনে ওরা গুছিয়ে বসার পর আমি গিয়ে ওদের সাথে কয়েক দিন কাটিয়ে আসি। সে বছরেরই শেষের দিকে সুভার প্রথম বাচ্চা হয়, এক জোড়া জমজ বাচ্চা।
এখন বুঝতে পারি নিজের সংসারে ডুবে থাকার জন্য শুভার কত কিছু আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
আগে হলে যেগুলো আমি ঠিক ঠিক টের পেতাম। একদিন প্রায় মাঝরাতে টেলিফোনে হঠাৎ শুভা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল, ছোটপা, আমি আর পারছি না, আমি আরিফের হাত থেকে রেহাই চাই...... অথচ তাদের সম্পর্কের অসামঞ্জস্যগুলো ছোট ছোট করে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত হিসাবে কিন্ত ছিলই। মন্ট্রিয়লের বাসায় এক রাতে হঠাৎ করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠা আরিফের গলার উচ্চস্বর, আর শুভার ডুকরে কেঁদে ওঠা... দিনের পর দিন শুভার ফ্যকাশে হয়ে যাওয়া—হাসির উজ্জ্বলতা কমতে থাকা—ইঙ্গিত তো স্পষ্টই ছিল। শুধু আমিই তা খেয়াল করি নাই...
টেলিফোনে আমি সরাসরিই প্রসঙ্গটা তুললাম আরিফের কাছে। খুব শান্ত ভাবে শুরু করলাম ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে সরকারের নো টলারেন্স নীতিমালা নিয়ে, বললাম কি ভাবে তা তার প্রক্রিয়াধীন ইমিগ্রেসন স্ট্যাটাস কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তার ক্যারিয়ারের বারোটা বাজাবে। তারপর শেষ করলাম দাওয়াত দিয়ে— তোমাদের সমস্যা নিয়ে যদি সাহায্য চাও, কাউন্সেলিং চাও, আমার বাসায় চলে আসো। আমি তোমাদের সময় দেবো, কিন্ত এই হাঙ্গামা আর নুইসেন্স যদি চলতেই থাকে—আই কান্ট হেল্প, তোমার যাতে ম্যক্সিমাম শাস্তি হয়, আমি সেই চেষ্টা করবই......।
শুভাকে নিয়ে আমার মনের শান্তি উড়ে গিয়েছিলো, সব সময় একটা কষ্টের বোঝা বুকে চেপে থাকে। এ রকম একটা মানুষের সাথে কিভাবে ঘর করা যায়?
অথচ আরিফের হাত থেকে শুভা রেহাই পেয়ে গেলো অনেক সহজেই।
এত সহজ যে কেউ তা ভাবতেই পারে নাই। শুভার মেয়ে দুইটার বয়স ততদিনে ৩বছরের কাছাকাছি। এ সময় প্রকৃতি দেখালো তার পরিহাস। রাতের বেলা কাজ থেকে ফেরার পথে একদিন আরিফ আক্রান্ত হল, একদল অল্পবয়সী ছেলেদের দ্বারা। হ্যামিলটন এর জন্য এই ধরনের ঘটনা ছিল খুবই অবিশ্বাস্য, প্রায় দুইদিন যাবতীয় প্রতিকুলতার সাথে লড়ে আরিফ বিদায় নিল সকল সম্পর্কের বাঁধন কাটিয়ে।
এ সবই প্রায় ৪ বছর আগেকার কথা, প্রাথমিক ধাক্কা সামলে এতগুলো বছর কাটিয়ে শুভার সামনে এখন নতুন জীবনের বাস্তবতা। আবার লেখাপড়া শুরু করার কথা ভাবছে শুভা। জীবনটাকে নতুন করে গোছানো দরকার। মেয়ে দুইটাকে নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা...
শুভার জীবনে সমস্যা এখনো আছে, কিছু কিছু সমস্যা হয়তো আগের চেয়ে জটিল, আর তা নিয়ে শুভার চিৎকার চেঁচামেচিও আছে—শুধু অবাক লাগে শুভা এখন একবারও মরে যাওয়ার কথা বলে না... নিজকে শেষ করে ফেলার কোন ভাবনা মাথা চাড়া দেয় না। এতগুলো বছর পার হয়ে সম্ভবত এই প্রথম জীবনে বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুজে পেলো সে...
দুই দুইটা ফুটফুটে বাচ্চা, তাদের নিয়ে কতশত পরিকল্পনা।
শুভার এখন মরার সময় কই?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।