যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না ১) আত্মহত্যা করতে চাইলে অনেক ভাবেই করা যায় বলে শুনেছি। নিজে ঠিক কোন পদ্ধতিতে কার্যসাধন করব সেই ব্যাপারে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পেরে অস্থিরতায় ভুগছি। সৃষ্টিশীল কাজে আমি বরাবর উৎসাহবোধ করি।
তাই মরতে যখন চাইছি একটি শিল্প তৈরী করে মরতে চাই। পরবর্তী জেনারেশন যেন আমাকে সামনে রেখে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যেতে পারে- এই ধারনাটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। গলায় দড়ি দেয়া কিংবা ঘুমের ঔষধ খাওয়া অথবা কীটনাশক মারার বিষ নাক-মুখ কুঁচকে খেয়ে ফেলা- বড্ড ক্লিশে হয়ে গেছে।
আমার এই হঠাৎ তৈরী হওয়া অনুভূতি কাউকে বলিনি। বললে অবধারিতভাবে প্রশ্ন হিসেবে ছুটে আসত তুমি কেন মরতে চাও? মুরুব্বী গোছের কেউ এসে নিশ্চয় বলত, জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার বাকি আছে।
এত হতাশা কেন? কিংবা বন্ধুরা শুনলে বলত, মরার টাইমে হেল্প লাগলে বলিস। নোভা কী বলত? কথাটা মাথায় আসাতে একটু উদাস হয়ে যাই। নোভা কী বলতে পারে, তা আমার থেকে ভালোভাবে কেউ বলতে পারবে না। আবার আমার থেকে ভুলভাবেও কেউ বলতে পারবে না। কাছের মানুষদের সাথে এই এক সমস্যা, তাদের সবকিছু বোঝা যায় আবার কিছুই বোঝা যায় না।
নোভা খুব সম্ভবত ব্যাথাতুর একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবে অথবা আমার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে কেঁদে ফেলতে পারে। আমি মেয়েদের কান্না দেখলে দুর্বল হয়ে যাই। ওর কান্না দেখলে লক্ষ্য ভুলে যেতে পারি। তাই বৃহৎ উদ্দেশ্যে কাউকে বলা থেকে বিরত থেকেছি। তবে এই প্রশ্নটা আমাকেও যন্ত্রণা দিচ্ছে।
আমি আসলে কেন মরতে চাই? ভেবে উত্তর পাই না। ধূর এত ভেবে কী হবে? মানুষ কয়টা কাজ ভেবে করে? কথাটা মনে হয় একটু জোরে বলেছিলাম । পাশের ঘর থেকে মা’র কন্ঠ শুনতে পাই, কীরে ইবু কার সাথে কথা বলিস?
মা’র কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। মরে গেলে মা’র কী হবে? সারাজীবন সংসারের ঘানি টানতে টানতে বেচারীর বয়স বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আমার কাছে এলেই মা’র মুখে হাসি ফুটে।
খেতে বসলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন এর চেয়ে মধুর কোনো কিছু আর পৃথিবীতে নেই। আমি সেই সুখটাই কেড়ে নিব? কেনই’বা নিব?
আয়নার সামনে বসে আছি। আয়নার ভেতরের মানুষটা আমাকে বলে, তুই বাঁচবি কেন? তুই মর, তোকে মরতে হবে। কথাটার ভেতর কিছু একটা ছিল। আমি চুপ হয়ে যাই, নীরবে মাথা ঝাঁকাই।
আয়নার ভেতরের মানুষ হেসে ওঠে। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকে। ফিসফিস করে কি জানি বলে, শুনতে পাই না। তার চোখে দেখি আগুন। ভয় পেয়ে কান এগিয়ে দেই।
এবার হেসে উঠি আমি। মানুষটার মারত্মক বুদ্ধি। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে আসে।
২)
আয়না মানুষের কথা অনুযায়ী আমাকে এখন দু’টো কিডনী নষ্ট এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর তাকে আমার কিডনী দান করে দিব।
ব্যাপারটা প্রথমে খুব সোজা মনে হয়েছিল। সাময়িক উত্তেজনা নিরসনের পর মনে হচ্ছে আদৌ ব্যাপারটা সোজা না। মানুষ খুঁজে বের করতে হবে। তার সাথে আমার সবকিছু ম্যাচিং হবে এমন কোনো কথা নেই। ডাক্তার বন্ধু পারভেজকে ফোন দেই।
কিডনী বিকল এমন কারো খোঁজ সে দিতে পারে না। পত্রিকার বিজ্ঞাপন ঘাটতে শুরু করি। মাঝে মাঝে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। চোখেও পড়ে যায় এমন একটা বিজ্ঞাপন।
-হ্যালো, ভাই আপনাদের কিডনী লাগবে।
ফোনের ওপাশে হুটোপুটি শোনা যায়।
-লাগবে ভাই? কে আপনি?
-আমি যেই হই, আপনাদের কাজে আসতে পারি।
-আমরা কিন্তু বেশি টাকা দিতে পারব না।
-ধূর,ভাই! টাকা লাগবে না।
ফোন রেখে দেয়ার শব্দ হয়।
নিজেকে গালি দেই, এভাবে কেউ কথা বলে? ইবু, কিছু শিখলে না এখনো। কিছু না!
আয়না মানুষের বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করা সহজ হবে না, বুঝে গেছি। প্রথমে ধরতে পারিনি, পড়ে মনে হলো দু’টো কিডনি একসাথে কেউ প্রতিস্থাপন করবে না। করলে একটা আর তাতে আমার উদ্দ্যেশ্য সফল হবে না। সাহস করে আবার আয়না মানুষের সামনে গিয়ে বসি।
দেখি সে ঝিমোচ্ছে। ডাকা ঠিক হবে নাকি বুঝতে পারি না। তবে আমাকে দোটানা থেকে মুক্ত করে দিয়ে আয়না মানুষ বলে ওঠে- কী বলবে, বল বৎস? মনে মনে বলি, শালা তোর সমস্যা কী? একবার তুই-তোকারি করে ধমক দিস? এখন আবার একেবারে বৎস বলে ডাকাডাকি? মুখে বলি, এই মানে কিডনী প্লট বাতিল করতে হবে। ভেবেছিলাম সে রেগে উঠবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, প্রাইম-মিনিষ্টারের গাড়ির সামনে লাফ দিতে।
পত্রিকায় নিউজ আসবে, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে লোক আসবে-এটা ভাবতেই আমার জিভে পানি এসে গেলো। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, লাফ দিতে গাড়ির কাছে যেতে হবে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তার আগেই নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে ধরে ফেলবে। এবার কষ্টে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল।
আয়না মানুষ তখন গভীর ঘুমে। আমারো খুব ঘুম পেয়ে গেল, সেই সাথে প্রচন্ড রাগ। আমাকে মরে যেতে বলে, হারামজাদা আয়ানার ভেতর ঘুমোচ্ছে। টের পাচ্ছি, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
মগ্নতায় ডুবে যাওয়ার সময় খেয়াল হলো, আমার সামনে ভাঙা কাচের টুকরো।
কোন ফাঁকে আয়না মানুষকে মেরে ফেলেছি। আমার আরো অনেক কাজের মত এই কাজের কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণের ভেতর তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে পড়লাম ফ্লোরে।
৩)
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমার ভেতর সুখের তীব্র একটা অনুরণন। আয়না মানুষের হত্যাকারী হয়ে এখন আমি খুনী। পুলিশকে খবর দেয়া দরকার।
তারা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। বেড়ধক মার চলবে। ভাবতেই আনন্দিত বোধ করলাম।
-হ্যালো, ধানমন্ডি থানা?
_জ্বি, এইমাত্র আমি একটা খুন করেছিন। আয়না মানুষকে।
-আসছেন?
আজব, পুলিশ পাত্তাই দিল না।
উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম, হাতে রক্তের দাগ। কাঁচের টুকরো লেগে কেটে গেছে। পুলিশের বিমাতাসুলভ আচরণে কিছুটা হতাশ। তাই বেশ বড়সড় একটা কাঁচের টুকরো দিয়ে বুকের বামপাশে আঁচড় বসিয়ে দিলাম।
ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্রিডের ওয়ান লাস্ট ব্রিদ গানটি বেজে উঠল। সুরে সুরে একটু একটু করে রক্ত পড়তে থাকে। পা টেনে টেনে সামনে এগিয়ে জানালা খুলে দেই। বাইরে ঘোর অমাবস্যা। ঘরের ভেতর ডিম লাইটের হালকা আলো, পেছনে বাজছে গান, বুকের ভেতর থেকে সুর করে পড়া রক্ত।
মাথার ভেতর মৃত্যু চিন্তা আর স্বরচিত একমাত্র কবিতা-
এক হাইপোথ্যালামিক বিস্ফোরণের পর
মানুষের রক্তের স্বাদ পেতে পাগলপ্রায় হয়ে উঠি।
যে মানুষগুলো আমাকে আঘাত করেছিল অসীম ভালোবাসায়-
আমি তাদের খুঁজে বেড়াই-পথ থেকে পথে,গলি থেকে গলিতে।
একদিন যদি পেয়ে যাই,একবার যদি পেয়ে যাই-
গাছে কাঁঠাল গোফে তেল দিয়ে
আনন্দে জোছনা পেড়ে খাই।
বুক পকেটে থাকে আমার অস্ত্র
শান দিতে দিতে এখন ক্লান্ত।
আমার কিছু মানুষ দরকার-দু হাত,দু পাওয়ালা আপন মানুষ।
আমার কলমে শান দিয়ে রেখেছি-
এফোঁড়-ওফোঁড় করে হৃদপিন্ড খাব।
আমি পারিনি, আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার এখন নরকে যাওয়ার শখ। নরক নিয়ে একটা কবিতাও লিখতেও পারি না। আমি এভাবে মরতে চাই না।
মরে গেলে কী হয়, জানি না। আমি নিশ্চিত আমার জন্য নরক অপেক্ষা করে আছে। আপ্লুত হই, চোখ ভিজে যায়। আজ খুব অল্পতেই আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। মোবাইলের রিং বাজছে।
সারাদিনে নোভাকে ফোন করিনি। নোভা জানে না, আমার জন্য নরক অপেক্ষা করে আছে। নরকে যাওয়ার ক্রিয়েটিভ রাস্তাটি কেবল জানা নেই। মোবাইল বেজে থেমে গেল। বাড়ির সামনে কুকুর লেজ গুটিয়ে শুয়ে আছে।
বুকের ভেতর থেকে সুর করে পড়তে থাকা রক্তে ভিজতে থাকা আমি। ঘরের ভেতর আয়না-মানুষের মৃতদেহ। আজ আকাশে চাঁদ নেই। তাই বুঝি আমি কোনো ক্রিয়েটিভ রাস্তা দেখতে পাই না।
পড়াশোনা করে বড় হয়ে , বিয়ে করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করার ভেতরে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই না।
নোভা জানে না, আমি নরকে যাবো। নরক পথযাত্রী ছেলের বাবা, চুপচাপ হয়ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। আজ তার সাথে দাবা খেলা হয় নি। নরকে গেলে আগুনে পুড়তে হয়, দাবা খেলা যায় না।
আমি শুধু ক্রিয়েটিভ কোনো রাস্তা খুঁজে পাই না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।