আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোহেল তাজকে খোলাচিঠি

লিখতে ভাল্লাগে না, ঠিক যে ভাল্লাগে না তাও না! আসলে পারি না। তবে কাউকে খোচাইতে ভাল্লাগে। যখন আমার কমেন্ট পড়ে কারো শুকতালু গরম হয়ে যায় তখন আমি স্বর্গীয় আনন্দ পাই! প্রিয় সোহেল তাজ, অভিনন্দন নিন। অবশেষে আপনি সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করলেন। প্রায় ২ বছর আগে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেও কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে আপনি মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবেই বহাল আছেন! দেশে গনতন্ত্র বেশি হলে অবশ্য এমনই হয়, কেউ চাইলে নিজের ইচ্ছায় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগও করতে পারেন না।

এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী আরো দুই বছর পরে জানান কী না যে আপনার সংসদ সদস্যপদ বহাল রয়েছে। সংবিধান অনুসারে অবশ্য এমনটা হওয়ার জো নেই, কিন্তু সংবিধান অনুসারে তো আপনার মন্ত্রী থাকারও কথা ছিল না। সংবিধানে পরিস্কার করে বলা আছে, যদি কোনো মন্ত্রী ‘রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন’ তাহলেই তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে যাবে, সেই পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকল নাকি রাষ্ট্রপতি সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। যাই হোক, আপনার চলে যাওয়াটা শেষ পর্যন্ত ভালোই হয়েছে। দেশ কারো ঘর সংসারের মান অভিমানের বিষয় নয়, দেশ অনেক বড় ব্যাপার।

সেখানে এসব মন্ত্রীত্ব আর সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বছরে পর বছর নাটক দেখাটা নাটক করণেওয়ালাদের জন্য সমস্যার না হলেও জনগন হিসেবে আমাদের জন্য বিব্রতকর। এখন জোর করে আপনাকে সংসদ সদস্যপদে না রাখলে আমরা একটি নাটকের হাত থেকে অন্তত মুক্তি পেতে পারি। তবে যাওয়ার বেলায় আপনি একটি খোলাচিঠি লিখে গেছেন। চিঠি পড়ে বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সন্তান অনেক বেশি প্রত্যাশা করে এদেশে রাজনীতি করতে এসেছিলেন। আপনি সজ্জন রাজনীতিবিদ ছিলেন, তাই এই চলে যাওয়া দেশের রাজনীতির জন্য বড় এক ক্ষতি।

আপনি লিখেছেন, ”২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার আমাকে রাজনীতিতে আরও বেশি উৎসাহিত করে। যে ইশতেহারটি ছিল প্রগতিশীল ও দিনবদলের একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকার। আশাবাদী হই, একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির। যে সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ পাবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার।

যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা, উদীচী ও একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। বাংলাদেশ হবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা—সব মিলিয়ে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ” বুঝাই যাচ্ছে, সে স্বপ্ন আপনার পূরণ হয়নি। আর নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, সেই স্বপ্ন আমাদেরও পূরণ হয়নি। আপনি বলেছেন, ‘সঙ্গত কারণেই’ আপনি মন্ত্রীত্ব আর সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে চলে গেলেন।

প্রিয় সোহেল তাজ, এখানেই আপনাকে আমার বিনীত প্রশ্ন, ‘সঙ্গত কারণ’ কতটুকু গেলে সঙ্গত হয়? কতটুকু হতাশা, কতটুকু অপমান, কতটুকু বেদনা বয়ে নিয়ে গেলে কারণটুকু ‘সঙ্গত’ হয়ে উঠে? আপনার চিঠি পড়ে প্রথমেই মনে হলো-ভাগ্যিস আপনার বাবা ‘সঙ্গত কারণ’ খুঁজে বেড়াননি একাত্তরে। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, প্রস্তুতিবিহীন অস্ত্রবিহীন এক অসম যুদ্ধ যখন তিনি পরিচালনা করছিলেন, তখন তাঁর আশেপাশেও খোন্দকার মোশতাকদের বিষ নিঃশ্বাস ছিল, তাঁর নিয়ন্ত্রনের বাইরেও একের পর এক বাহিনী গড়ে উঠছিল, নেতা গজিয়ে উঠছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন স্বাধীনতার ধ্রূবতারার দিকে চোখ রেখে সাঁতার কেটেছেন সেই প্রতিকূল সমুদ্রে, ‘সঙ্গত কারণ’ জানিয়ে রণে ভঙ্গ দেননি। তাঁদের ত্যাগেই আজকের এই বাংলাদেশ। আমাদের সমস্যা আজ এখানেই।

আমরা সবাই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু সেই পরিবর্তনটি জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কেউ একজন করে দেবে বলে আশা করে বসে আছি। আমরা ঘরে বসে টেলিভিশনে টকশো দেখি, পত্রিকায় খবর পড়ি, সামাজিক যোগাযোগের সাইটে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর বলি-আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম। অথচ এই স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য আমরা এবারের যাত্রায় কেউ একবারও মাঠে নামলাম না। যা-ও বা দুয়েকজন নামলেন, কিন্তু তাঁরা চেষ্টা করে গেলেন ভাসা ভাসা। সুশীল মানুষেরা রাজনীতিকে সুশীল আর শুদ্ধ করার জন্য আফসোস করে যদিও রাজনীতির মাঠে খেলতে নামলেন, কিন্তু প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের দম ফুরিয়ে গেল।

বড় বড় ডক্টর সাহেবরা, যারা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনীতির চালিকা শক্তির মতো ভারি ভারি শব্দ এক লহমায় উচ্চারণ করেন- তাঁরা ভাবলেন আমরা, নিরীহ জনতা তাঁদের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেব মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তাঁরা জানেন না, বিজয়ের ট্রফিটা মাঠে নামার জন্য দেয়া হয় না, দেয়া হয় নব্বুই মিনিট খেলার পরে। তাঁরা শুধু মাঠে নামেন আর রাগ করে চলে যান। তারপর আমরা সবাই মিলে দূর থেকে বসে বসে সিস্টেমকে গালি দেই, রাজনীতিকে গালি দেই, সন্ত্রাসী আর মাস্তানিকে গালি দেই। আমরা বলি-রাজনীতি ভদ্রলোকদের জায়গা নয়।

অথচ পরিবর্তন এক দীর্ঘ পথযাত্রা। নির্বাচনী ইশতেহারে কালো কালো অক্ষরে মুদ্রিত হলেই এই পরিবর্তন সাধিত হয় না। প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতি ক্ষন-দন্ড-পলে তাঁকে একটু একটু করে সাধন করতে হয়। এই যাত্রাপথের ধৈর্য আমাদের প্রজন্মে আর কেউ দেখাতে পারলাম না, এই আফসোস রয়ে গেল মনে। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতেই দেখুন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই না হয় হোক। দেখুন, ১৯৯১ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়েসে নিজে মন্ত্রী থেকেই নিজের দলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করছেন এই পুঁচকে যুবনেত্রী। তারপর? তারপর দীর্ঘ পথযাত্রা। কংগ্রেসের বাইরে বেরিয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে কুড়ি বছর পরে এই মমতাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আমি মমতার রাজনীতি পছন্দ করি না, বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর উন্নাসিক আচরণের নিন্দা জানাই, কিন্তু কথা সেটি নয় এখানে।

আমি শুধু দেখিয়ে দিচ্ছি যে দীর্ঘ রাস্তা না হাঁটলে পরিবর্তনের কথা পত্রিকার পাতায়ই রয়ে যায়, জনগন সে কথায় বিশ্বাস করে না। পাকিস্তানের মতো একটি ভাঙ্গাচোরা রাষ্ট্রে ইমরান খানের মতো একজন প্লেবয় ক্রিকেটার রাজনৈতিক দল করার পরে আজ পনের বছর ধরে লেগে থেকে এখন ক্ষমতার অংশ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছেন, কিন্তু আমাদের নোবেল লরিয়েট পনের সপ্তাহও রাজনীতির মাঠে ধৈর্য ধরে ছিলেন না। এদেশের পরিবর্তনহীন স্থবিরতার দায় তাই আমাদের প্রচলিত সিস্টেমের নয়, আমাদের কোনো কোনো নেতার অন্ধ দলবাজি আর মূর্খ স্বার্থান্ধতায় নয়; এই পরিবর্তন না হওয়ার দায় আমার আর আপনারও। প্রিয় সোহেল তাজ, আপনি পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেলেন। আপনার পালানোর সুযোগ আছে।

আপনার বিদেশী লেখাপড়া আছে, আমেরিকার মতো দেশে ছিমছাম দিনযাপনের সুযোগ আছে; আপনি এই পোড়ার দেশকে ভালো কিছু দিতে এসেছিলেন, তারা নেয়নি, এই অভিমানের অজুহাতে আপনি দূরে সরে যেতে পারেন। আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, আমাদেরকে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূমিতেই বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। এখানেই আমরা ঠেলাঠেলি করে বাসে চড়ব, দুই টাকার পত্রিকা কিনে জাবর কাটার মতো দু:সংবাদগুলো প্রতিদিন পড়ে পড়ে অফিসে যাব। আর বাড়িতে বড় বড় তালা লাগাব, পাছে ডাকাতি শেষে আমার শিশুকন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় খিলগাও থানার সামনে দিয়ে। এই স্থবির অন্ধ সময়ের দায় আমি তাই আপনাকে দেই না, এই দায় আপনার মতো আমারও।

আমরাই দুষ্টচক্রকে ব্যালটে সিল মেরে মেরে বাঁচিয়ে রাখছি দীর্ঘদিন। কিন্তু বিশ্বাস করুণ সোহেল তাজ, আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম। অন্ধকার রাতে কান পেতে ছিলাম-কেউ একজন ডাকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসব। কেউ আমাদের ডাকে নি। যাঁদের ডাকার কথা ছিল, তাঁরাও হয়তো আমাদের মতোই আসলে অন্য কোনো গোডোর প্রতীক্ষায় ছিলেন।

আর এভাবেই ঝিমুতে ঝিমুতে গোটা একটা প্রজন্ম অপচয় হয়ে গেল। হায়, এই দুঃখ কোথায় রাখি আমরা! তাই পরের প্রজন্মের কাঁধে পরিবর্তনের দায় চাপিয়ে দিয়ে আসুন তবে, আমি আর আপনি পালিয়ে গিয়ে ভালোই থাকি। আরিফ জেবতিক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্লগার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।