অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
শহরটা দিন দিন জলন্ত উনুন হয়ে যাচ্ছে, সেই উনুনের আঁচে সিদ্ধ হচ্ছি প্রতিদিনই। বৃষ্টির দেখা নেই, ছাদের কার্ণিশে মেঘ মুতে যাচ্ছে হয়তো গভীর রাতে কিন্তু সে পানিতে শহরের আগুণের গণগণ আঁচ কমে না।
বিকেলের দিকে খুব ক্লান্ত লাগে, দু চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়, তেমনই একটা ঘুম ঘুম আমেজে শুয়ে ছিলাম বিছানায়, জানালা বন্ধ রাখলে হাঁসফাঁস লাগ আর খুললে মনে হয় চুলার বাতাস ঢুকছে ঘরে, তবুও নিজের দমবদ্ধ ভাবটা এড়ানোর জন্যই জানালা খুলে শুয়েছিলাম।
ঘুমের আমেজটা মাটি হয়ে গেলো, খালাম্মা একটু ভাত দিবেন খালাম্মা, ক্ষিধা লাগছে, একটু ভাত দিবেন।
গলার কর্কশতা এবং বলবার অসহায়ত্ব সব মিলে একটা অস্থিরতা তৈরী হয়ে ভেতরে।
জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দেখলাম, নতুন এপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, একটু ঝুঁকে, পরনের কাপড় ময়লা, এবং তার ছোটো শরীর থেকেই বিকট এই আওয়াজ বের হচ্ছে, একটু ভাত দিবেন খালাম্মা, ভাত খাবো-
আব্দার নয়, বরং রীতিমতো অনুনয়, আমার ঘুম ঘুম আমেজটা এই কাতর অনুনয়ে শরীর ছেড়ে পালায়। লাথি খাওয়া কুকুরের মতো দৌড় দিয়ে যাই রান্না ঘরে, সেখানেও কিছু নেই। জানালা বন্ধ করে এই অনুনয় ঠেকানো যাবে না , সেটা একেবারের মাথার ভেতরে ঢুকে বসে আছে।
আমার শরীর থেকে ঘুম উধাও, রাস্তার অনুনয়, সব মিলিয়ে নিজেকে অসহায় লাগে, রাস্তায় যেসব ফকির ভিক্ষা চাইছে, তাদের উপেক্ষা করা যায়, বিনা পরিশ্রমে পয়সা উপার্জনের এই পন্থা সমর্থন করে না এমন মানুষও কম নেই, কিন্তু একজন মানুষ খেতে চাইছে এবং খাওয়ার জন্য অনুনয় করছে, এই অনুনয় এড়ানো কঠিন। নিজেকে পশুর মতো মনে হয়, শুধু নিজে ক্ষুধার জ্বালায় অন্য সব বিস্মৃত হয়ে থাকা পশু হয়ে থাকার শ্রান্তি বিবশ করে ফেলে।
আমি ঘুমের শেষটুকু ধুয়ে মুছে ময়না ভাইয়ের দোকানে চলে গেলাম। এখন কড়া এক কাপ চা না হলে চলছে না, ছেলেটাকে দেখলাম রাস্তার উপরে হাত পা ছড়িয়ে মাথা নুইয়ে বসে আছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। তার সামনে দিয়েই যেতে হবে, দুর্বল একটা হাত উঠিয়ে মিনমিন স্বরে বললো, মামা একটু খাইতে দিবেন?
আয় এই দিকে,
ময়না ভাইয়ের দোকানে তেমন বেশী কিছু নেই, বন রুটি, ৫টাকা পিসের কেক, কলা, ২টাকা দামের বিস্কুট, চিপস আর বিভিন্ন লজেন্স। পেছনে এক সারি বেঙ্গল বিস্কুল, ড্যানিশ আর নাবিস্কো।
এসবের ভেতর থেকেই বেছে খেতে হবে।
ময়না ভাই এ যা খাইতে চায় একে দেন, আর আমাকে এক কাপ কড়া করে চা দিবেন, সাথে সিগারেট।
খাও, যেটা ইচ্ছা করে।
মামা ভাত খাই নাই ৩ দিন, ভাত খাবো।
মেজাজটা চরমের চরম খারাপ হয়ে গেলো, ব্যাটা উজবুক এই খানে ভাত কই পাইবি তুই, যা আছে তাই খাবি, এমন আব্দার করে লাভ আছে, তোকে নিয়ে হোটেলে যাওয়ার আগ্রহ আমার নাই।
এইখানে খাইলে খা ব্যাটা
কিন্তু মুখে বলতে পারি না এসব। বললাম এখানে যা আছে তাই তো খেতে হবে। পাউরুটি কলা খাও।
আমি সেখান থেকে সরে সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিলাম একটা।
নান্টু আসছে, তার চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি।
ময়না ভাই সিগারেট দেন একটা।
কি রে তুই এই সময়ে এইখানে, ক্লাশ নাই আইজকা?
না আইজক্যা প্রফেসর আইবো না। বইয়া ছিলাম বাসায়, শালার ঘুমটাও আসতেছিলো কিন্তু ঘুমাইতে পারলাম না।
আমারও একই অবস্থা, প্রায় ঘুমায়া পড়ছিলাম, হঠাৎ কইরা শুনি কে জানি কলিং বেল বাজায়। আম্মা দরজা খুলছিলো, শুনলাম কে জানি বলতেছে আমরা ইসলামের দাওয়াত নিয়া আসছি, বাসায় পুরুষ মানুষ থাকলে পাঠায়া দেন।
আমি বাইরে গেলাম, দেখলাম কয়েকটা হুজুরমতো লোক খাঁড়ায়া আছে, আমরা পাশের মসজিদ থেকে আসছি, আমাদের ধর্ম ইসলাম, মহান ধর্ম, মহান আল্লাহ তালা বলেছেন পৃথিবীতে যতদিন একজনও মুমিন থাকবে ততদিন আমি এই পৃথিবীকে ধ্বংস করবো না।
পৃথিবীতে কাফিরদের খাদ্যের যোগান হচ্ছে মুসলিমদের জন্যই। আমরা যদি ইসলামের পথে না যাই তাহলে আমরা পিছয়ে যাবো।
যা ঘুম আসছিলো, সেই বয়ান শুনে ঘুম গেলো গিয়া, বলে ওবামা, আমেরিকার মানুষরা খাইতে পারে কারণ পৃথিবীতে আমরা মুসলিমরা আছি। আমরাই ওদের খাওয়াইতাছি।
শুইন্যা ফিক কইরা হাইসা দিলাম। বেচারারা বললো, যদি কাজ না থাকে আমরা মাগরিবের পর আর আলোচনা সভা করতেছি, আপনি যদি আসেন। কোনো কাজ আছে?
আমি কোনো কাজের অজুহাত দিতে পারলাম না, বললাম চেষ্টা করবো আসতে।
যদি কোনো কাজ না থাকে তাহলে এখনই চলেন না আমাদের সাথে, আসরের নামাজটা পড়লাম জামাতে, তারপর একটু দ্বীনের আলোচনা করলাম।
অনেক কষ্ট করে নিস্কৃতি পেয়ে আসলাম, ঘুমটার ১২টা বাজলো এই যা।
তারপর?
তারপর আর কি, আমাকে ছাইড়া ওরা গেলো নীচের তলায়, সেখানেও একই কথা, বাসায় পুরুষ মানুষ থাকলে পাঠায়া দেন। ক্যান পাঠাইবো পুরুষ মানুষরে, পুরুষ মানুষ বাইরায়া কি ওগো হোগা মারবো না কি ওগোরে হোগা পাইতা দিবো? শালার, ঘুমটার গোয়া মারা গেলো।
সিগারেট শেষ করে দেখলাম ছেলেটা কলা রুটি খেয়ে পানি খাচ্ছে। কায়দা করে একটা বিড়ি ধরালো। আর যাই হোক ওর বিড়ির দাম আমি দিবো না।
সন্ধ্যা হয়ে যাবে এখনই। মারুফকে দেখা যাচ্ছে, নান্নুকে সাথে নিয়ে আসছে। পেছনে সোহেল ভাইকেও দেখা যাচ্ছে। অনেক দিন পরে সোহেল ভাইয়ের চেহারা দেখলাম।
কি খবর ভাই, অনেক দিন পরে উদয় হইলেন কোথা থেকে? পরীক্ষা কেমন হইলো।
পরীক্ষা ভালোই হইলো, তোরা আছিস কেমন?
আমরা তো ভালোই আছি। পরীক্ষা শেষ হইছে কবে?
গত পরশু, ক্যান।
নাহ দুই দিন কই ডুব দিয়া ছিলেন।
আরে পৃথিবীর সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলো না, একটু আপডেট হইয়া নিতাছি, এই কয়দিন তো কোনো সংবাদই রাখতে পারি নাই। পৃথিবীর খোঁজখবর রাখা দরকার বুঝলি।
এইটা অনেক কাজের জিনিষ, বুঝতে হবে কোন দিকে হাওয়া যাইতেছে, সেইটা বুঝলেই তুই পার পাইয়া গেলি।
তো পৃথিবীর খবর কি বুঝলেন।
আর কি বুঝবো, শ্রীলঙ্কায় আবার গেঞ্জাম শুরু হবে, প্রভাকরণ মইরা গেলে সব শান্ত হইয়া যাবে এমনটা ভাবা ভুল। এইটা নিয়া অন্য সবাই যা শুরু করছে, জাতিসংঘের বান কি মুন বলছে এইটা মানবিক বিপর্যয়, এইটা খুব অদ্ভুত বিষয় বুঝলি। জাতিসংঘ কখন কোনটাকে মানবিক বিপর্যয় মনে করে বুঝা যায় না।
আমরাও আসলে বুঝি না সোহেল ভাইয়ের কথার মাজেজা,তাই কথার মাঝখানেই বললাম, সোহেল ভাই ফারুক আসছিলো বুঝলেন, ওরে দেখলে অজ্ঞান হইয়া যাইতে পারেন। ওরে নিয়া কি করা যায় বুঝতেছি না, পরে সময় নিয়া আপনেরে বলবো সব কিছু।
এখন কইলে সমস্যা কি?
না এই একটা পরীক্ষা দিয়া শেষ করতে পারেন নাই, অনেক ধাক্কা গেছে, এখন আর এই বাড়তি ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না।
নান্টুকে দেখেই হাঁক দিলেন সোহেল ভাই, এই নান্টু এই দিকে আয় তুই।
নান্টু হাঁকডাক শুনে ভড়কে গিয়ে বললো, বলেন সোহেল ভাই , কি করছি আমি?
তোর না বনশ্রী বসুন্ধরায় বন্ধু আছে?
হ আছে কয়েকটা, ক্যান ঐ দিকে কি কাম।
আরে ঐ দিকে কোনো কাম নাই, কিন্তু ঐ দিকে র্যাব একটা স্কুল খুলছে, সেইটা কই খুলছে এইটা জানতে চাইছিলাম।
খবরটাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। পুলিশ, বিডিআর, আর্মি, নেভী, এয়ারফোর্স, আনসার, সবারই নিজেদের ছেলেমেয়ে পড়ানোর আলাদা স্কুল আছে। পাবলিক ক্যান্টঃ স্কুল এন্ড কলেজ, নেভী স্কুল এন্ড কলেজ, বিএএফ শাহীন স্কুল কলেজ, রাইফেলস স্কুল, পুলিশ লাইন স্কুল, এত স্কুল থাকতে র্যাবের জন্য আলাদা স্কুল থাকাটা দোষের কিছু না, কিন্তু ঢাকা শহরে র্যাব স্কুল খুলে ফেলছে এইটাই আশ্চর্যের কথা। ওদের স্কুলটা কোথায়?
আমি কিভাবে বললো, সোহেল ভাই হাত উল্টে বললেন, ঐ দিন দেখলাম কয়েকটা ছেলে মেয়ে যাচ্ছে, সবারই কালো শার্ট, কালো প্যান্ট আর কালো টাই , বুকে হলদে রংএর ব্যাজ।
ও ঐটা? ঐটা তো ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজের ড্রেস।
ও তাই নাকি, এত রং থাকতে কালো রংয়ের পোশাক কেনো, এই গরমে কালো পোশাক পড়ে ঘুরে উজবুকরা, ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল কি উজবুক না কি। এত রং থাকতে এইটা বাছাই করছে।
হইলেও হইতে পারে সোহেল ভাই, স্কুলের মালিক আবার সেনাবাহিনীর লোক।
কি রে মারুফ তোর কয় দিন কোনো পাত্তাই পাইলাম না, কই ডুব দিছিলি তুই?
আর কইস না, আইলা আইলো যেই দিন, রিকশায় ছিলাম।
রিকশাওয়ালার প্লাস্টিক ছিলো না। বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের অবস্থা খারাপ। গা ব্যাথা জ্বর। এই সাইরা উঠলাম।
একটা সেনোরা কিনতে পারলি না রিকশা থামায়া।
নান্নুর কথা শুনে আমরা যতটা উদ্ভ্রান্ত হয়েছি, তারচেয়ে বেশী হয়েছে মনে হয় মারুফ।
সেনোরা, মানে?
মানে বুঝো না। সেনোরা, সর্বোচ্চ শোষণক্ষমতা সম্পন্ন স্যানিটারি ন্যাপকিন।
আমি সেনোরা কিনে কি করবো?
আরে ব্যাটা বিজ্ঞাপনটা দেখছোস তুই? এক মাইয়া হাঁটতেছে, বৃষ্টি হইতেছে ধুমায়া, ঐটা দেখোস নাই তোরা?
টিভির বিজ্ঞাপনটা মনে পড়লো। একটা মেয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, ও যেদিক দিয়ে হাঁটছে সেখানের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
ওর গায়ে পানি পড়ছে, সেটাও শুকিয়ে যাচ্ছে।
হ এক প্যাকেট কিনে একটা তুই নিতি আর আরেকটা দিতি রিকশাওয়ালারে।
সেনোরা কি মাথায় দিয়া বইতাম না পইড়া বইতাম রিকশায়?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।