আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফারাও এবং বুদ্ধিমান চোর

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” অনেক অনেক দিন আগের কাহিনী। মিশরে তখন ফারাওদের যুগ। সবে মাত্র র্যাপম্পসিনিটাস মিশরের ফারাও হলেন। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডটাসসহ অনেকেই এঁকে তৃতীয় রেমেসিস নামে অভিহিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে মিশরের সমস্ত ফারাওদের মধ্যে র্যা ম্পসিনিটাসই ছিলেন সবচেয়ে ধনী ফারাও।

তার সম্পত্তির মধ্যে ছিলো জুয়েলারী, অলংকার আর স্বর্ণমুদ্রাসহ আরো অনেক কিছু। প্রতিদিনই তিনি নতুন নতুন জুয়েলারি তার ভাণ্ডারে যোগ করতেন। ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাসের সম্পদ ঘর ছোটবেলায় ক্লাসের বাংলা বইতে ‘সুখী মানুষ’ নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। যার কিছুই নেই, এমনকি গায়ে পরিধানের জন্য নেই কোনো জামা- সেই সবচেয়ে সুখী। আর যার যতো প্রাচুর্য্য, সেই ততো অসুখী।

আমাদের কাহিনীর ফারাও র্যা ম্পসিনিটাসও ছিলেন খুব অসুখী। তিনি সর্বদাই তার এই বিশাল সম্পদ নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন এই বুঝি কোনো চোর এসে চুরি করে সব নিয়ে গেলো! অবশেষ তিনি এক সিদ্ধান্ত নিলেন। এক ইঞ্জিনিয়ার (মানে তখনকার কারিগর)- কে দিয়ে র্যা ম্পসিনিটাস একটি পাথরের ঘর বানালেন, যেখানে কোনো দরজা নেই, জানালা নেই। ঘরটির এক দিক ছিলো প্রাসাদের সাথে।

সেই দিকে ইঞ্জিনিয়ার একটি পাথর এমনভাবে রাখলেন যে শুধুমাত্র র্যা ম্পসিনিটাসই একটি স্প্রিং-এর সাহায্যে পাথরটিকে সরাতে পারবেন। যাক! র্যা ম্পসিনিটাস এবার তার বিশাল সম্পদরাশি নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, আর চুরির ভয় রইলো না! ফারাও র‍্যাম্পসিনিটাসের সম্পদরাশি বিপদটা এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জানি না সত্য, না মিথ্যা- সম্রাট শাহজাহান না কি তাজমহল তৈরীর পর এর প্রধান রাজমিস্ত্রী ঈসা মিয়াকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন, যেনো একই রকম তাজমহল আর কেউ তৈরী করতে না পারে! র্যা ম্পসিনিটাসের বোধহয় উচিৎ ছিলো ইঞ্জিনিয়ারের কোনো ব্যবস্থা করা! বেশ ক’বছর পর, যখন ইঞ্জিনিয়ার মৃত্যুশয্যায়, তার দুই ছেলেকে ডেকে বললেন, “আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। তোমাদের জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না। তবে আজ তোমাদেরকে একটা গোপন কথা বলবো।

ফারাও-এর সম্পদ ঘরটির পিছন দিকে আমি একটি পাথর এমনভাবে রেখেছি, যা সামনের দিকের পাথরটির মতোই স্প্রিং- এর সাহায্যে খোলা যাবে, যা কেউ জানে না। এমনকি ফারাও পর্যন্ত না! তোমাদের যখন যা প্রয়োজন হবে, ঠিক ততটুকুই নিবে- বেশি না। ” ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে রাতের আঁধারে সম্পদ ঘরটির কাছে গিয়ে তাদের বাবার কথামতো ঠিক জায়গায় সেই পাথরটির দেখা পেলো। এরপর ঘরটির ভিতরে ঢুকে পকেটে এবং ব্যাগে যতটুকু ভরলো, ততটুকু নিয়ে চলে এলো। পরদিন সকালবেলা ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস সম্পদ ঘরে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলেন কিছু জিনিস কম মনে হচ্ছে।

কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না, কীভাবে চোর এই ঘরে ঢুকবে! এভাবে বেশকিছু দিন পর, যখন তার খুব প্রিয় একটি নেকলেস পাওয়া গেলো না, তখন তিনি চোর ধরার জন্য ঘরের ভিতরে এক ফাঁদ পাতলেন। সেদিন রাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই আগে ঘরটিতে ঢুকতে গিয়ে ফাঁদে পা আটকে গেলো। বড় ভাই অনেক চেষ্টা করেও ছোট ভাইকে মুক্ত করতে পারলো না। ছোট ভাই তখন বললো, “আমাকে এখানে পেলে ফারাও আমাকে চিনে ফেলবে, তখন তোমাকেও খুঁজে ফেলবে। আমাদের দুজনকেই তখন মেরে ফেলবে।

পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসবে। তারচেয়ে বরং, আমার মাথা কেটে নিয়ে যাও, এতে আমাদের পরিবারের কোনো বিপদ হবে না!” অন্য কোন উপায় না থাকায়, বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে গেলো। পরদিন সকালে ফারাও সম্পদ ঘরে গিয়ে মুন্ডুবিহীন শরীর দেখে চিনতে পারলো না। ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস হতাশ হলেও বুদ্ধি হারান নি। তিনি বুঝতে পারলেন, আরেকজন এই চুরির সাথে জড়িত আছে, যে মাথাটা কেটে নিয়ে গিয়েছে।

তিনি এই মুণ্ডুবিহীন শরীরটাকে প্রাসাদের বাইরে ঝুলিয়ে রাখলেন, গোপনে কিছু সৈন্য পাহারা দিতে লাগলো। কেউ যদি এই শরীরটা নিতে আসে, তখনই তাঁকে পাকড়াও করা হবে, কারণ সে হবে চোরের দ্বিতীয় সঙ্গী। ভাইয়ের মাথা কেটে আনার পর থেকে বড় ভাই খুব মনোকষ্টে ছিলো। চিন্তা করছিলো কীভাবে ছোট ভাইয়ের দেহ সমাধিস্থ করবে। সে এক বুদ্ধি বের করলো।

এক গাধার পিঠে করে কিছু মদের পিপে নিয়ে প্রাসাদের সামনে দিয়ে যেতে লাগলো। সৈন্যদের কাছে এসে সে একটি পিপা ফুটো করে দিলো, সেখান থেকে মদ ঝরতে লাগলো। এরপর শুরু করলো কান্না। সৈন্যরা সে কান্না শুনে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। “পিপা ফুটা হয়ে মদ ঝরছে।

মালিক আমাকে আস্ত রাখবে না,” বলে আবার কান্না শুরু করলো বড় ভাই। সৈন্যরা তাকে সান্তনা দিলো, বললো ব্যাপারটা তারা দেখবে। বড় ভাইও খুশি হয়ে পিপার মদ সৈন্যদের খাওয়াতে লাগলো, একটু বেশি পরিমাণে। সব সৈন্যরা মদ খেয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। রাতের বেলা বড় ভাই এসে ছোট ভাইয়ের শরীরটা নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করলো।

ফারাও আবারো বুদ্ধির খেলায় চোরের কাছে হেরে গেলো! এবারো ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস হতাশ হলেন না। আরেকটি বুদ্ধি বের করলেন, তবে এবার সাহায্য করতে হলো ফারাও-এর সুন্দরী মেয়েকেও। ফারাও রাজ্যে ঘোষনা দিলেন, সবাইকে তাদের জীবনের সবচেয়ে বুদ্ধিমূলক কাজের কথা রাজকন্যাকে বলতে হবে এবং রাজকন্যার যারটা ভালো লাগবে, তাকে সে যা চাইবে, তাই দিবে। ব্যাপারটা হলো যে ব্যক্তি সম্পদ ঘরে মাথা কাটা এবং শরীর নিয়ে যাবার কাহিনী বলবে বুঝতে হবে সেই চোর, এবং তখন তাকে ধরা হবে। সেই সময়ে মনে হয় সবাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ছিলো, যে কারণে মনে হয় কেউ মিথ্যা কথা বলতে পারে সে চিন্তা ফারাও-এর মাথায় আসেনি! বড় ভাই এবার তার জীবনের সবচেয়ে বড় বুদ্ধির খেলা খেললো।

এক কবরস্থানে গিয়ে এক লাশ থেকে একটি হাত কেটে নিলো। সেই হাতকে চাদরের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে ধরে রাখলো যেনো মনে হলো আসল হাত। বড় ভাই যখন রাজকন্যাকে সম্পদ ঘরে ছোট ভাইয়ের মাথা কাটা এবং প্রাসাদের সামনে থেকে শরীর নিয়ে যাবার কাহিনী বলতে লাগলো, রাজকন্যা হঠাৎ করে বড় ভাইয়ের হাত ধরে ফেললো, চিৎকার করে সৈন্যদের ডাকতে লাগলো। কোথায় বড় ভাই! কোথায় হাত! সেখানে তো এক মৃতদেহের হাত! বড় ভাই ততক্ষণে হাওয়া! এবার ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস হতাশ হলেন। ঠিক করলেন যে চোরের বুদ্ধির কাছে তিনি বার বার হেরে যাচ্ছেন, তার সাথে আর বিরোধ নয়।

ঘোষণা দিলেন, চোরকে নিজের পরিচয় প্রকাশ করার। তখন বড় ভাই এসে ফারাও-এর কাছে নিজের পরিচয় দিলো। ফারাও র্যা ম্পসিনিটাস খুশি হয়ে বড় ভাইকে রাজসভায় শুধু স্থানই দিলেন না, রাজকন্যার সাথে বিয়েও দিলেন। এরপর থেকে বড় ভাই আর রাজকন্যা সুখে শান্তিতেই বসবাস করতে লাগলো। (সব মিথোলজী যেভাবে শেষ হয়, এটা সেভাবে শেষ হলো না, বরঞ্চ মনে হলো রূপকথা।

তাই এটাকে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডটাস মিশরীয় মিথ বললেও আমার এটাকে মিশরীয় রূপকথাই বলতে ইচ্ছে করছে। ) হেরোডটাস- যিনি এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.