প্রবাসী নীল নদের দেশ মিশর। আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে থেকে নীল নদকে ঘিরে গড়ে ওঠা সভ্যতা । সে যুগের রাজারা হলেন ফারাও। খৃস্টজন্মের ৩১০০ বছর আগে রাজা মেনেস হন প্রথম ফারাও। এর পর একাধিক্রমে ৩১ টি বংশ শাসন করেছে প্রাচীন মিশরকে।
এই দীর্ঘ সময় গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে মিশরের প্রতিটি ধুলিকনায়। ফারাওদের শাসনাধীন এই সময় কালকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। পূরাতন , মধ্য এবং নতুন রাজত্ব কাল। পুরাতন রাজত্বকালের শাসকেরা ছিলেন ৩য় থেকে ৬স্ট রাজবংশ(২৬৮৬ খৃঃপূর্বাব্দ থেকে ২১৮১ খৃঃপূঃ) , মধ্যম রাজত্ব কালে রাজত্ব করেছেন একাদশ থেকে চতূর্দশ রাজবংশ, (২০৫০ খৃঃ পূঃ থেকে ১৬৫০) এবং নতূণ রাজত্বকালে শাসকেরা ছিলেন অস্টাদশ থেকে বিংশতম রাজ বংশ (খৃঃ পূঃ ষোড়শ থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত) নতূন রাজবংশকালে র্যামেসীয় যুগে মিশর শৌর্য্যে বীর্য্যে খ্যাতির শীর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সে যুগে মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল যে মৃত্যুর পর আত্মা দেহ থেকে পৃথক হয়ে প্রবেশ করে পরলোকের অনন্ত যাত্রাপথে ।
সে আত্মা একদিন ফিরে আসবে। দেহ লাভ করবে পূনর্জন্ম। দেহ পঁচে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে তাকে মমী করে রাখা হত। পরকালের যাত্রায় প্রয়োজন ছিল সমস্ত পার্থিব দ্রব্য সামগ্রীর। মৃতব্যাক্তি যাতে পরলোকে কোন অভাবে না পড়ে তাই তাদের সমাধিতে রাখা হত ধন রত্ন, টাকা পয়সা, নিত্য ব্যবহার্য্য সামগ্রী ইত্যাদি।
পূরাতন রজবংশকালে রাজা বা ফারাওদের সমাধির উপর নির্মান করা হত পিরামিড। যত গোপনেই রাখা হত সে সমাধি কোনটিই কিন্তু অটুট থাকত না। চোর ডাকাতেরা লুটে নিয়ে যেত সমাধি। নতুন রাজত্বকালে পিরামিড থেকে সমাধিস্থল স্থানান্তরিত হল আরো দক্ষিনে নীলনদের পশ্চিম তীরে রাজধানী থিবিসের উলটো দিকে অনূচ্চ পাহাড়ের উপত্যকায় নাম ভ্যালী অফ দি কিং। পাথর কেটে তৈরী করা হত ভূ গর্ভীয় সমাধি।
ভ্যালী অফ দি কিং এ কয়েকশ সমাধি। এর দুটো অংশ। পূর্ব উপত্যকা হল ফারাওদের সমাধি ক্ষেত্র। এখানে ৬২ জন ফারাওয়ের সমাধি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। পশ্চিম উপত্যকায় সমাধি আছে ২জন ফারাওয়ের বাদ বাকি সবাই উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, পুরোহিত বা প্রজাদের।
সমাধি আবিস্কার- ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি আবিস্কারের প্রথম কৃতিত্ব বৃটিশ প্রত্নতত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টারের, দ্বিতীয় ব্যাক্তি হলেন লর্ড কারনারভন(জর্জ হারবার্ট) বৃটিশ প্রত্নতত্ববিদ কার্টার মিশরে এসেছিলেন ১৭ বছর বয়সে ১৯৯১ সালে। ১৯০৭ সাল থেকে লর্ড কার্নারভনের খননকাজের সুপারভাইজারের কাজ নেন। এর আগে কাজ করেছেন আমেরিকান প্রত্নতত্ববিদ ডেভিড স্যামুয়েলের সাথে। ডেভিড রাজাদের উপত্যকাতে খুজে পেয়েছিলেন তুতেনখামেনের নামাঙ্কিত কাপ, সোনার পাত ইত্যাদি। ১৯১৪ থেকে শুরু করেন ভ্যালী অফ থে কিং এ খনঙ্কাজ শুরু করেন কার্টার মাঝে কিছুদিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনে বন্ধ থাকার পর আবার শুরু করেন ১৯১৭ সালে।
হতাশ লর্ড কারনারভন কোন উল্লেখযোগ্য আবিস্কারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে ১০ লক্ষ পাউন্ড খরচ করা শেষে কার্টারকে একরকম জবাবই দিয়ে দিয়েছিলেন লর্ড “ এই শেষবার এর পর আর খরচ করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে” ১৯২২ সালের ৪ঠা নভেম্বর র্যা মেসিস-৪ এর সমাধির পাশে সমাধিক্ষেত্রের কর্মীদের পাথরের কুড়েঘর পরিস্কার করছিলেন। খননকাজে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য পানির পাত্র পাথরের ভূমির উপর এনে রাখল এক ছেলে। একটু খেয়াল করে কার্টার দেখলেন সেই পাথরের রং এবং প্রকৃতি আশে পাশের পাথর থেকে ভিন্ন। আরো একটু পরিস্কার করার বুঝলেন সেটি হল পাথরের সিড়ির প্রথম ধাপ।
পরদিন আবার পরিস্কার শুরু করে সিড়ির দ্বাদশ ধাপে পৌছে দেখতে পেলেন প্লাস্টারের উপর রাজকীয় ছাপযুক্ত দরজা। কার্টার বুঝলেন কোণ এক রাজার সমাধিতে ঢোকার দরজা সেটা। টেলিগ্রাম পাঠালেন লর্ড কার্নারভনকে। ২২ শে নভেম্বর কার্নারভন, কার্টার এবং লর্ড কন্যা প্লাস্টারের দরজায় ছিদ্র করতেই বেরিয়ে এল গরম বাতাস। ছিদ্রের ভিতর দিয়ে মোমবাতি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করলেন কার্টার।
হাওয়ায় দুলছে মোমবাতির শিখা, অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কার্টার। পেছনে দাঁড়ানো লর্ড প্রশ্ন করলেন “ ভিতরে কিছু দেখতে পাও?” উত্তর দিলেন কার্টার “ আশ্চর্য্য অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাচ্ছি লর্ড” ছিদ্র আরো একটু বড় করে ভেতরে গেলেন তিনজন। শুরু হল অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্বিক আবিস্কার। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ১০ বছর ধরে কার্টার কাজ করে গেলেন তুতেনখামেনের সমাধিতে। মূল সমাধিকক্ষে কাজ করেছেন আড়াই বছর।
প্রতিটি জিনিসের ছবি তুলে, নাম্বার দিয়ে, সযত্নে পরিস্কার করে তা পৌছালেন মিশরের প্রত্নতত্ব যাদুঘরে। সমাধিতে পাওয়া ৫০০০টি দ্রব্য সামগ্রী উদ্ধার করে পৌছে দিয়েছেন যাদুঘরে। ফারাও তুতেনখামেন আজ ও আছেন তার সেই পাহাড়ের গুহার সেই সমাধি কক্ষে।
তুতেনখামেনের জীবনী-
রাজা হিসেবে ফারাও তুতেনখামেনের কোন সাফল্য ছিল না, কোন দেশ বা যুদ্ধ জয় ও করেননি, নেই কোন কালজয়ী কীর্তি কিন্তু সর্বাধিক পরিচিত ফারাও হলেন তুতেনেখামেন । তুতেনখামেনকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন- কে ছিলেন তার বাবা মা, তার শাসনকাল কেমন ছিল, কিভাবে মারা গেলেন, তার সন্তান সন্ততি কারা ছিল ইত্যাদি।
তুতেনখামেনের সমাধি আবিস্কৃত হয় ১৯২২ খৃঃ, তার মৃত্যুর প্রায় ৩০০০ বছর পরে । সেটাই হল একমাত্র সমাধি যা এতদিনকাল ছিল সম্পুর্ন অক্ষত। তার সমাধি থেকে আমরা ধারনা পাই সে যুগের মিশরের জীবনযাত্রা, শাসন পদ্ধতি , ধর্মীয় বিশ্বাস, মৃত্যপরবর্তী অন্ত্যস্টিক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে। ফারাও তুতেনখামেন ছিলেন অস্টাদশ বংশের শাসক। বাবা ছিলেন আখেনাটেন।
ফারাও আখেনাটেন ছিলেন ভিন্নমতাবলম্বী, খামখেয়ালী। হাজার বছরের প্রচলিত দেবতা আমেনের স্থলে দেবতা আটেনকে শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে পূজা শুরু করেন, রাজধানী স্থানান্তর করেন আখেটাটেন এ, ভিন্ন ধরনের অঙ্কন শৈলীর প্রবর্তনের চেস্টা করেন। তুতেনখামেনের জন্ম খৃঃ পূঃ ১৩৪১ সালে আখেটাটেন এ। বাবা নাম রেখেছিলেন তুতেনখাটেন বা আটেনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মা ছিলেন রানী “কিয়া”- ফারাও আখেনাটেনের একজন পত্নী।
আখেনাটেনের প্রধানপত্নী ছিলেন নেফেরতিতি। খৃঃপূঃ১৩৩৩ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে শাসনভার নেন তুতেনখামেন। এজন্যেই ইতিহাসে তিনি “বালক রাজা” ধারনা করা হয় শক্তিশালী উপদেস্টা পরিষদ ছিল তার যেমন সেনাপতি “হেরোমহেব” এবং পূরোহিত “আই” রাজা হওয়ার পর বিয়ে করেন সৎ বোন, নেফেরতিতি কন্যা আনখেসেনেপাটেনকে। তার শাসনকাল ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। প্রজা এবং পূরোহিতদের অসন্তোষ কমাতে আটেনের পরিবর্তে আবার প্রচলন করেন “আমন”কে শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে।
রাজধানী স্থানান্তর করেন থিবীস এ। নিজের নাম পরিবর্তন করে তুতেনখাটেনের স্থলে রাখেন তুতেনখামেন এবং স্ত্রীর নাম আনখেসেনেপাটেনের স্থলে আনখেনসেনেমুন। তাদের ছিল দুই কন্যা সন্তান। দুই সন্তানেরই মাতৃগর্ভে থাকা কালীন সময়ে মৃত্য হয়। সন্তানদ্বয়ের মমী পাওয়া যায় তুতেনখামেনের সমাধিতে।
মমী দুটোর সিটি স্ক্যান করে বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৫/৬ মাস এবং ৯ মাস। তিনি ছিলেন হালকা পাতলা গড়নের উচ্চতা ১৮০ সেঃমিঃ মত। সামনের দাত গুলো ছিল উচু। মাথা ছিল কিছুটা লম্বা। ১৮বছর বয়সে ১৩২৩ খৃঃপূঃ অব্দে মারা যান তুতেনখামেন।
এত অল্প বয়সে কেন মারা গেলেন তুতেনখামেন তা এক রহস্য। অনেকে তার মৃত্যুকে খুন হিসেবে বর্ননা করে থাকেন। তার মাথার খুলিতে হাড় ভাঙ্গাকে এর কারন হিসেবে উপস্থাপন করেন। সিটি স্ক্যান করে তার পায়ের হাড় ভাঙ্গা পাওয়া গেছে। অনেকে ধারনা করেন তার হাড় ভাঙ্গা স্থানে সংক্রমন হয়ে মারা যান তুতেনখামেন।
সাম্প্রতিক কালের ডি এন এ পরীক্ষায় তার দেহে ম্যালেরিয়ার জীবানুর ডি,এন,এ পাওয়ায় ম্যালেরিয়া কে মৃত্যুর কারন হিসেবে চিন্তা করা হয়ে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।